এক মাজেদার কাহিনি

শাহরুখ পিকলু

প্রকাশিত : অক্টোবর ২১, ২০১৮

বনানীর কামাল আতাতুর্ক থেকে বেরুলেই এয়ারপোর্ট রোড। উত্তরে চলে গেছে প্রশস্ত রাস্তা যা প্রথমে জিয়া থুক্কু শাহজালাল এয়ারপোর্টে গিয়ে পড়ে, আরো গেলে উত্তরা-আব্দুল্লাহপুর হয়ে গাজিপুর। আর দক্ষিণ দিকে হাঁটা শুরু করলে পড়বে মহাখালী, আরো গেলে তেজগাঁ-সাত রাস্তার মোড়-মগবাজার হয়ে একেবারে মাঝ টাউনের ঝিললুপ্ত মতিঝিল। ঝিলটা আশির দশকেও ছিল, কিন্তু তা ভরাট করে বিশাল খেলার মাঠ করা হয়েছে। ঢাকার নামি ক্লাবগুলোকে ছোট ছোট বাংলো-টাইপ ক্লাবঘর দেয়া হয়েছে, যদিও বেশিরভাগই এখন জুয়ার আসরের আখড়া। হাতিরঝিলও যাওয়া যায়। সেটার পত্তন বা প্রায় পত্তন না-হতে যাওয়া নিয়ে লম্বা লম্বা কাহিনি আছে। খামোখা ফালতু বকা শুরু করলাম। বয়স হলে সব গল্পেরই শাখা-প্রশাখা ছড়ায়, জীবনধর্মটাই অমন, আমি তো সেই এক জীবনই যাপন করছি। তবে তা কিছুটা ভিন্ন বৈকি।

আমি প্রায়ই বাঁ-দিকে অর্থাৎ দক্ষিণের দিকে হেঁটে মহাখালীর দিকে যাই। ফুটপাথের প্রায়ই বেহাল দশা থাকে। একদল তা ঠিক করলেই আরেক দল এসে কাটাকুটি করে খাল বানানোর চেষ্টা করে, ‘উন্নয়ন কাজ চলিতেছে, সাবধানে চলুন’। উন্নয়ন হয়তোবা হচ্ছে কিন্তু সাবধানে চলা দায়। প্রায়ই গা ঘেঁষে বাস-মোটর-অটো চলে যায়, মোটরসাইকেল চালকদের গালাগালও খেতে হয়। কারণ তারা যেন সব কোণাকাঞ্চির মালিক। এই রাস্তার ফুটপাথে চলে অনেক ক্রিয়াকলাপ- বাচ্চারা খেলে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আড্ডাবাজি করে, মেয়েরা কাঁখে গ্যাদা বাচ্চা নিয়ে সুখ-দুঃখের আলাপ করে, কুটনামিও করে। ফুটপাথ ঘ্যাঁষা দেয়ালের সামনে বেশ কিছু চায়ের দোকান দেখা যায়- সেটাও এক আড্ডাখানা বটে। এমন এক চায়ের দোকান চালায় মাজেদা। মজিদ তার বড় ছেলের নাম, তাই প্রায়ই সে মজিদের মা বলে ডাক শোনে।

দেয়ালের ওপাশেই কাঁচা-পাকা ঘর উঁকি দেয়। ছোট ছোট দরজার ফাঁক দিয়ে তা দেখা যায়। সরকারি জমি, লেখা আছে ক্লিনার্স সোসাইটির নাম। কিন্তু কে বা কাহারা সেখানে আধাপাকা বাড়ি গেঁথে টিনশেড দিয়ে ভাড়া খায়, তা ঠিক জানা নেই। হয়তো আছে, অপ্রিয় সত্য বলতে নেই। দেয়ালের বেষ্টনির ভিতর মানুষ কিলবিল করছে, তা বেশ বোঝা যায়। মাজেদা একটা একশো বর্গফুটের ভাড়া দেয় দুই হাজার টাকা, তবে সরকারকে না। তাছাড়া ঘুষ দিয়ে বিদ্যুৎ বা রান্নার গ্যাসও পায়। সরকারি খাতায় তা ‘সিস্টেম লস্’।

মাজেদা তার দোকান দিয়ে সংসার চালায়। চা, বিস্কুট, কলা, লজেন্স, চিপস্, কেক, সিগারেট আর পান বিক্রি করে। তার ছেলে মজিদের বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। আছে তার দুটা মেয়ে, একজন সতের আরেকজন প্রায় বিশ। দুজনেই গার্মেন্টসে কাজ করে। বড়টার বিয়ের চেষ্টা চলছে। মা আর দুই মেয়ের আয়ে টেনেটুনে সংসার চলে। মজিদ সারাদিন ভেড়েণ্ডা ভাজে, কিছুই করে না। তবে কিছু টাকা ম্যানেজ করতে পারলেই ফেন্সি খায়, মাঝে মাঝে ইয়াবা। অনেকে বলে, সে কোনো এক নেতার পেয়াদার কাজ করে। নেতার কথায় একে ওকে প্যাঁদায়। একটা মিশন পেলে যা আয় হয় তাতে দু’এক বোতল বিদেশি মদও জুটে যায়। সেদিন সে রাজা। মাজেদার স্বামী ট্রাকচালক ছিল, মরেছে কিনা কেউ জানে না। কিন্তু এদিকের পথ যখন আর মাড়ায় না তাই মৃত ধরে নেয়াতেই ঝামেলা কম। সে নিখোঁজ আজ দুই বছরের উপর হলো। কোথাও হয়তো নতুন সংসার পেতে বসেছে। এমন যে হয় না, তাতো আর না।

মাজেদার বয়স চল্লিশের কিছু বেশি। কিন্তু এখনও খুবই টাইট শরীর। কমবয়সী পোলাপানরাও আড়চোখে তার বুক আর নিতম্বের দিকে সুযোগ পেলেই তাকায়। মাজেদার খারাপ লাগে না, যদিও সে ‘ওই খানকির পোলা কি দ্যাখস? ওক্করে চোক্ষু গাইল্যা দিমু’ খিস্তিখেউড় করে। তাতে ছেলেগুলোর কিছু এসে যায় না। তাদের সিম্পল লজিক, ‘দ্যাখনের জিনিস দেখুমই তো’। মানিক নামে একটা অবিবাহিত ছেলে থাকে এই সেমি-বস্তিতে, সে এক সময়ে মজিদের বন্ধু ছিল কিন্তু এখন আর নেই। সবাই তাকে মাইনকা ডাকে শুধু মাজেদা ছাড়া। সে মহাখালীর এ্কটা গ্যারেজে হেলপারের কাজ করে। একদিন নিজের কারখানার মালিক হওয়ার স্বপ্ন দ্যাখে। মাজেদা তাকে সেই স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করে। ছেলেটাকে বেশ কিছুদিন হলো মাজেদার খুব পছন্দ। মজিদ তাকে দু’চোখে দেখতে পারে না।

সেমি-বস্তিতে মাজেদা আর মাইনকাকে নিয়ে অনেক কানাঘুষা। যেনবা সবার ফেভারিট পাসটাইম। মজিদ-মাইনকার হাতাহাতিও হয়েছে কয়েকবার। মজিদ তাকে তার প্যান্টে গুঁজে রাখা ছোরাটাও দেখিয়েছে কয়েকবার। মাইনকা মাজেদার দোকানে ফ্রি খায়, মাঝে মাঝে মাজেদার অনুপস্থিতিতে দোকানটার দেখাশোনা করে, অনেকের কাছ থেকে বাকি আদায় করে দেয় আর সুযোগ পেলেই মাজেদার বিছানার সঙ্গী হয়। মেয়েরা দেখেও না দেখার ভান করে, মজিদ বাড়ি থাকে না বললেই চলে, অন্যত্র রাত কাটায়, সে কোনোদিন চোখে কিছু দেখেনি। কিন্তু সবাই তার কান ভারি করে, ওর ছোট বোন দুটোও। মজিদ শুধু গজরায় আর ভাবে, ‘হালার পুত মাইনকা, তুই আমার মায়রে লাগাস, তোর ভুঁড়ি না নামাইলে আমার শান্তি নাই।’

একদিন মাইনকা গ্যারেজে না গিয়ে বাসায় বসে টিভি দেখছিল। আগের রাতেই সে মাজেদাকে বাসায় থাকার কথাটা বলেছিল। মাজেদা দুপুরের কিছু পরে দোকান বন্ধ করে নিজের ঘরের দিকে গেল, যাওয়ার সময় মাইনকার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ’বাবা মানিক, এইদিকে আয় তো, আমার এই প্যাটরাটা নামাইয়া দে।’ সুরসুর করে বিছানার থেকে নেমে মাইনকা গায়ে একটা স্যান্ডো পরে চলে গেল মাজেদার ঘরে। মাজেদার মেয়েরা তখন কাজে আর মজিদ কোন চুলোয় গেছে কে জানে! ঘরে ঢুকেই মাইনকা দরজার খিলটা আস্তে করে লাগিয়ে দিল। ‘আয় আমার বুকে আয়’ বলে মাজেদা বুকের উপর থেকে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে দিল। তার পরনে নেই ব্লাউজ বা ব্রা। তার সুডৌল বক্ষযুগল যেন মাইনকাকে ডাকতে লাগলো। ‘খাড়াইয়া দ্যাখস কি, আয়।‘ মাইনকা ঝাপিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঁচ ইঞ্চি দেয়াল ভেদ করে উহ-আহ শব্দ শুনতে পেল অনেকেই। ঘিঞ্জি বসবাসে আবার কিসের প্রিভেসি! লোকজন জড় হলো, মেয়েরা নিজেদের মধ্যে চুটিয়ে যা ইচ্ছা তাই বলতে লাগলো। খানকি শব্দটা খুব শোনা গেল।

মাতাল মজিদ তখন অনন্ত জলিলের সিনেমা দেখে সেমি-বস্তিতে ফিরলো, গলায় তার মাতালের বেসুরো গান। গেল সে মায়ের ঘরের দিকে। লোকজন তাকে দেখে একটু চুপ মেরে গেল। কিন্তু চোখে-মুখে তাদের উত্তেজনা, একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। হাতাহাতি, খিস্তি-খেউড় এই আর কী! এমন সময়ে এক মোল্লা কিসিমের লোক এসে মজিদকে বললো, ‘এই রকম বেলেল্লাপনায় গজব নামে বাবা মাজিদ’। মজিদ তার দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা কিছুটা ঠাওর করতে পারলো। টলতে টলতে সে জিগ্যেস করলো, ‘মাইনকা হালায় কই? মায়ের দোকান মনে লয় বন্ধ দ্যাখলাম’। মোল্লা মাজেদার ঘরের দিকে তাকিয়ে চোখের একটা ইঙ্গিত করলো। ‘শুয়োরের বাচ্চা’ হুঙ্কার দিয়ে সে মায়ের দরজায় কষে একটা লাথি মারলো। মদের টানে তার এখন অসুরের শক্তি। দরজার একটা পাল্লা ছুটে ঝুলতে লাগলো। ঘরে ঢুকে সে বিছানায় উলঙ্গ মাজেদা আর তার উপর চেপে থাকা মাইনকাকে দেখলো। অনেকগুলো উৎসুক চোখ সেই দৃশ্য দেখার জন্য ভাঙা দরজায় ঠেলাঠেলি করতে থাকলো। কেউ ভিতরে ঢুকলো না, মজিদের হাতের ছুরিটা দেখার পরও।