অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম

অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম

একুশ শতকে বার্ট্রান্ড রাসেল: সমাজ, বিজ্ঞান ও যুদ্ধ

রিফাহ সানজিদা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৫, ২০১৮

বার্ট্রান্ড রাসেল ( ১৮৭২-১৯৭০) তার সময়ের অত্যন্ত গুণী কিছু লেখক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, সোশ্যালিস্ট এবং পলিটিক্যাল ক্রিটিক/অ্যাক্টিভিস্টদের একজন। তার সমাজ ও বিজ্ঞানের যুগপৎ আলোচনার গুরুত্ব অসীম। তার ইম্প্যাক্ট অব সায়েন্স অন সোসাইটিতে (১৯৫১) তিনি বিজ্ঞানের প্রভাব নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেন।
প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিশ্বাসগত আর প্রায়োগিক বিজ্ঞানের আলোচনায় রাসেল সমাজের প্রভাবগুলো আলোচনা করেন। অন্তত এই সময়ে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ক্ষমতার আগ্রাসনের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানের প্রভাবে তার এমন আলোচনার স্পষ্ট প্রতিফলন পাওয়া যাবে। বিজ্ঞান আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ, এমন রচনা ছাত্রজীবনে অনেকবার লেখা হলেও সেই তুলনায় এর সামাজিক প্রভাব নিয়ে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এর প্রভাব এবং কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে খুবই কম। সমাজের থেকে আলাদা করে বিজ্ঞানকে দেখতে গেলেই ভুল করবেন। অবশ্য বিজ্ঞানকে আশীর্বাদ হিসেবে নেয়ার প্রচলন খুব বেশিদিন আগেও ছিল না। মানে আজ থেকে তিনশো বছর আগেও চার্চের প্রভাবে বিজ্ঞান মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো না। প্রথমে আলোচনা করা যাক বিজ্ঞানের বিশ্বাসগত দৃষ্টিভঙ্গির অবস্থা কেমন ছিল তা নিয়ে। এবং কিভাবে সেটা বিজ্ঞানের প্রভাবে বদলাতে শুরু করে।
চন্দ্র-সূর্য গ্রহণ বা ধূমকেতুর মতো বিষয়গুলোতে প্রচলিত কুসংস্কারে মহাকবি শেক্সপিয়রও বিশ্বাসী ছিলেন। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সময় প্লেগ আর গ্রেট ফায়ারের কারণ হিসেবে কমিটি চিহ্নিত করে, গণিতের শিক্ষক টমাস হবসের রচনাগুলো, যা ঈশ্বরের অসন্তুষ্টির কারণ। তাদের ধারণা এ কারণে দুর্যোগ নেমে আসছে।
তবে চার্লস এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট ছিলেন না। কারণ হবস তার শিক্ষক ছিলেন। সেসময় ডাকিনীবিদ্যায় বিশ্বাস কমে আসতে শুরু করে। যদিও ইংল্যান্ডে ডাকিনীদের সর্বশেষ বিচারের মুখোমুখি করা হয় ১৬৬৪ সালে। তবে এসব কুসংস্কারে রাজা দ্বিতীয় চার্লস বিশ্বাসী না হলেও একেবারে সে সম্ভাবনা উড়িয়েও তিনি দেননি। কারণ পিউরিট্যানরা শয়তানের পুজোয় বিশ্বাসী ছিল। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সময় এসব কুসংস্কার কমে আসে। কারণ সেসময় রাজা রয়েল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিজ্ঞান একটা ফ্যাশনের বিষয়ে পরিণত হলেও অনেক বিষয়ে পরিবর্তন আনে। চিকিৎসাশাস্ত্রে এই বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি আসতে দেরি হয়ে যায়। এর কারণ ধর্ম আর বিজ্ঞানের চিরাচরিত বিশ্বাসের সাংঘর্ষিক অবস্থান। বিজ্ঞানকে মুখোমুখি হতে হয় সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।
রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লসের সময় ভেসিলিয়াস প্রথম শবদেহ ব্যবচ্ছেদ করা শুরু করলে তখনকার চার্চ সমাজে এ নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়। অভিযোগ ওঠে, তিনি মানুষকে জীবিত অবস্থায়ই কাটাছেড়া শুরু করেন। সম্রাট পিণ্ডরোগ আক্রান্ত ছিলেন বলে ভেসিলিয়াসকে তিনি শাস্তি বা নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেন। স্বাস্থ্য সচেতন সম্রাটের কল্যাণে ভেসিলিয়াস রক্ষা পান। মনোরোগী বা উন্মাদরোগে যা এখন সিজোফ্রেনিয়াক বা ডিপ্রেশনের রোগ বলে পরিচিত। আগে এসব মনোরোগীদের ওপর নেমে আসত ভয়াবহ অত্যাচার। কারণ এসব রোগের কারণ হিসেবে মনে করা হতো অপদেবতাদের আছর। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এহেন উন্নতির ফলে অবর্ণনীয় যে দুঃখকষ্ট কমে এসেছে, তা সত্যি। তবে সপ্তদশ শতাব্দীর সময় থেকে শুরু হওয়া এসব উন্নতির পর ও লিস্টার এবং লুই পাস্তুরের আগে চিকিৎসাশাস্ত্র খুব একটা বিজ্ঞান নির্ভর হতে পারেনি। পর্যবেক্ষণের ফলে নেয়া ধারণা অবশ্যই অনুমান নির্ভর সিদ্ধান্তের চেয়ে বেশি বিজ্ঞানসম্মত, অন্তত বিজ্ঞান তাই মানে।
তবে সপ্তদশ শতাব্দীর আগপর্যন্ত এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে শুধুমাত্র মনঃপ্রসূত ধারণাকেই প্রাধাণ্য দেয়া হতো। যেমন এরিস্টটল ভাবতেন, মেয়েদের দাঁতের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে কম। তবে তিনি কখনোই মেয়েদের দাঁতের সংখ্যা গুণে দেখলেই আসল তথ্য পাওয়া যায় এমনটা ভাবেননি। তেমনি কাউকে পাগলা কুকুর কামড়ালে সে পাগল হবে না, তবে অন্য প্রাণী হবে, ঘোড়ার জন্য ছুচোর কামড় বিপদজনক এমন ধারণায় পরিপূর্ণ এরিস্টটলের কথিত বইটি। গ্রিকরা এসব যুক্তি এজন্যই প্রাধাণ্য দিতেন কারণ, কুকুর বিড়ালের মতো সাধারণ প্রাণী ছাড়া অন্যসব প্রাণীর গতিবিধি ওরা লক্ষ্য করেনি। তেমনি জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে বলা যায়, আলেকজান্ডারের প্রাচ্য বিজয়ের পর সেখানকার কুসংস্কার প্রবেশ করে হেলেনীয় সংস্কৃতিতে, প্যাগানরা বিশ্বাস করতে শুরু করে জ্যোতিষশাস্ত্রে। তবে জ্যোতিষশাস্ত্র চার্চের বিরোধিতার মুখে পড়লেও সেটা কোনও বৈজ্ঞানিক কারণে নয়। মানুষ অধিকমাত্রাতে দেবির ওপর নির্ভর হয়ে পড়বে এ আশংকা থেকে চার্চ এসবের বিরোধিতা করে। আবার আধুনিক মনস্ক বুদ্ধিজীবিরা চার্চের বিরোধিতার ফলে ভাবতে থাকে, জ্যোতিষশাস্ত্র নিশ্চয়ই বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার। এভাবে চলতে থাকায় বিজ্ঞান সম্মত ধ্যান-ধারণা কিংবা কুসংস্কার সবই তখন অনুমান নির্ভর সিদ্ধান্ত হয়ে ওঠে। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার ব্যবহার করে ফলপ্রসূ সিদ্ধান্তের অনীহা সেসময় ব্যাপক প্রচলিত ছিল। তেমনি গ্যালিলিওর টেলিস্কোপকে চূড়ান্তভাবে এড়িয়ে যায় চার্চ সমাজ। কারণ তাদের দৃঢ় ধারণাই ছিল, ওটা বিজ্ঞান সম্মত একটা বস্তু যা মানুষকে শুধুমাত্র বোকা বানাতেই তৈরি করা হয়েছে। তাই ওর মধ্যে দিয়ে বৃহস্পতির চাঁদ দেখার চিন্তা অনেক দূরের ব্যাপার।

চলবে...