তিন দশকের রাজনীতির একটি ‘ময়না তদন্ত’

মো. খালিদ সাইফুল্লাহ ফয়সল

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৮


১৯৭১ ছিলো ১৯৪৭-এর সংশোধন; আমরা ওই বছর মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম, একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমাদের অজস্র স্বপ্ন ছিলো—গণতন্ত্রের, সমাজতন্ত্রের, ধর্মনিরপেক্ষতার, বাঙালিত্বের, এবং সাধারণ মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতার। আমরা কোনো স্বপ্নকেই সফল করতে পারি নি। 



হত্যা করা হয়েছে বাঙলাদেশের স্থপতিকে, রক্তের বন্যা বয়ে গেছে; সামরিক স্বৈরাচারীরা এসে দেশকে পর্যুদস্ত করেছে। বর্তমানে বাঙলাদেশ বাস করছে ভয়াবহ মেঘমালার নিচে। হুমায়ুন আজাদ একান্ত ব্যক্তিগত ভঙ্গি ও ভাষায় বর্ণনা করেছেন বাঙলাদেশের বিপর্যয়ের ইতিবৃত্ত, লিখেছেন একটি বেতনাহত বই। এ-বই বাঙলাদেশের দেহ ও হৃদয়ের অপার বেদনার প্রকাশ; হাহাকার নয় নিঃশব্দ রোদন। 


বঙ্গবন্ধুকে লেখক মহানায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যিনি-খুড়কুটোকে দাবানলে, নিস্তরঙ্গ জলরাশিকে মহাপ্লাবিত এবং ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিকে লেলিহান শিখায় পরিণত করার ক্ষমতা রাখতেন। ১৯৬৮-৭২ এর মুজিবের কাছে সোহরাওয়র্দী, ফজলুল হক, ভাসানীর মত অগ্রজরা - মাঝারি, আর অনুজরা তুচ্ছ আর হাস্যকর। 

শেখ মুজিবের রহমানের মতো ‘রাজনীতির বটবৃক্ষে’র উৎপাটন ঘটেছে শুধুমাত্র কিছু কুচক্রী, আর চাটুকার দ্বারা পরিবৃত থাকার কারণে। লেখক বঙ্গবন্ধুর পতনের অনেকগুলা কারণ থেকে মোটা দাগে উল্লেখ করে গেছেন মূলত দুটি বিষয়কে  

১)ফজলুল হক মণিসহ অন্যান্য আত্মীয়দের অবিরত দু্র্বৃত্ততা। মণি কর্তৃক প্ররোচিত হয়ে তাজউদ্দিনকে সংসদ থেকে বহিষ্কার, মণি ও মার্কসবাদী নেতা সিরাজুল ইসলামের অন্তর্কোন্দলের দরুন ছাত্রলীগের দ্বিখন্ডিতা। 

২) চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা’কে ‘রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে’ রূপান্তর। তাছাড়া, জরুরি অবস্থা জারি, বাকশাল প্রতিষ্ঠা, লালবাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর ভূমিকার কথাও লঘু দাগে বলেছেন। 

লেখক হুমায়ূন আজাদ বেশ তীব্রভাবে সরকার ও দেশের শাসনকর্তাদের অপমান-অপদস্থ করেছেন। এছাড়াও, সীমাবদ্ধতা স্বরূপ তিনি –

প্রথমত, বাঙালি মুসলমানের কৃ্ষ্টি-সংস্কৃতি-আচার-আচরণকে মানদণ্ড ধরে তিনি বৈশ্বিক মুসলমানদের বিচার করছেন, সুকৌশলে ইসলামের নৈতিক দিকগুলাকে তিনি কটাক্ষ করছেন। 

দ্বিতীয়ত, তিনি প্রশ্ন রেখেছেন যে, “..........জিয়া আদৌ যুদ্ধ করেছেন কিনা?” 

লেখক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যুদ্ধের অবস্থান নিয়ে দ্বিধান্বিত...! 
অথচ ইতিতাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, জিয়াউর রহমান Z ফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছেন, বীরউত্তমে ভূষিত। এখানে তিনি বেশ পক্ষপাত দুষ্টতা দেখিয়েছেন। 

তৃতীয়ত, এরশাদের নপুংসকতা নিয়ে অযথা টানা-হেঁচড়া করেছেন যার কোন ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণতা নেই।

চতুর্থত, জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের সামরিক সরকার ছাড়া আর কোন প্রকার দুনীর্তি-লুঠতরাজ-নিপীড়নের কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। 

পঞ্চমত, তিনি তার বইয়ে শুধু নাস্তিকতার ছাপ রাখেন নি, তিনি যে কট্টরপন্থী ইসলাম-বিদ্বেষী; মোটা দাগে সেটার ছাপ রেখেছেন! 

নিজের ব্যক্তিগত পাঠ প্রতিক্রিয়ায় বলবো যে, “আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম” বইটি তিন দশকের রাজনীতির একটি ‘ময়না তদন্ত’। ১৯৭১-২০০২ পর্যন্ত বাংলাদেশের কদর্য রাজনীতির বিভৎস চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই বইটিতে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতা গ্রহণ, সামরিক অভ্যুত্থান, বেঈমান মোস্তাককে ক্ষমতাচ্যুত জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ, দৃশ্যপটে নপুংসক এরশাদের কাকতলীয় আগমন, খালেদা জিয়া – শেখ হাসিনা সরকারের রদবদল, বিচারপতিদের নিস্ক্রিয়তা, দৃশ্যপটে বিএনপির আগমন, অপারেশন ক্লিনহার্ট ইত্যাদি। 

জাতির বিবেকেরা যে কি পরিমাণ চাটুকার-ভাঁড়-হীন-বেমানবিক হতে পারে তার প্রতিমূর্তি হচ্ছে - বিচারপতি সায়েম, সাত্তার, আহসান উদ্দিন চোধুরী- শাহাবুদ্দিন আহমেদ, হাবিবুর রহমান, বিচারপতি লতিফুর রহমান’রা। যাদের মুখোশ নগ্ন ও খুল্লাম খোলাভাবে মোচন করা হয়েছে এই বইয়ে। 

বুদ্ধিজীবি আবুল ফজল ও সৈয়দ আলী আহসান`রাও বাদ যাইনি তার কোপদৃষ্টি থেকে। চীন পন্থী আর মস্কোপন্থীদের ঢালাও সমালোচনা করে একেবারে শুঁইয়ে দিয়েছেন!

তিনি অর্থনীতির ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রকে আর সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা আকন্ঠভরে গেঁয়ে গেছেন গনতন্ত্রের ‘কোকিলকন্ঠী’ পাখি হয়ে।


লেখক চেয়েছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙলাদেশ হবে জ্ঞানে-প্রজ্ঞায়-সচ্ছল-উজ্জ্বল-সৎ-ভবিষ্যৎমুখী-মুক্তচিন্তা-যুক্তিশীলতা-প্রগতিশীলতা-সৃজনশীলতার জাজ্জ্বল্যমান আদর্শ। 

ইতিহাস, ঐতিহ্যের এই অনব্দ্য বইটি পড়ার জন্য সব পাঠকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, ক্ষেত্র বিশেষে নিজেদের ক্রোধ-গোস্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি.........।।

একুশে বইমেলা ২০১৮