দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ২১

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৮, ২০১৯

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

সবচেয়ে ভালো লাগে আত্মজীবনীমূলক বই। একজন শিল্পী কিংবা রাজনীতিবিদ অথবা দার্শনিক কিংবা লেখক কিভাবে তার জীবনটিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, কিভাবে বেড়ে ওঠেছেন এবং নিজের মূল্যায়ন করছেন— তা আমাকে খুব আকর্ষণ করে: কাইয়ুম চৌধুরী

তিনি শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, রঙের রাজা। রঙকে জানেন ইচ্ছেমতো খেলাতে, হাতের তুলিতে নাচাতে, সেখানে জাগিয়ে দিতে সুরের দোলা। যার তুলির স্পর্শে গ্রন্থের প্রচ্ছদ পায় চিত্রশিল্পের অনন্য স্বাদ। তার পঠন-পাঠনের গভীরতা আমাদের বিস্মিত করে। তার রয়েছে গ্রন্থের ঈর্ষণীয় সংগ্রহ। প্রিয় ফিল্ম আর সঙ্গীত। ড্রয়িংরুমের চার দেয়ালের যেদিকেই চোখ যায় ছোটবড়ো মাঝারি অসংখ্য ক্যানভাসে মূর্ত হয়ে ওঠেছে আবহমান বাংলা, সবুজ-শ্যামল নিসর্গের রূপসী বাংলা। তার রং-তুলির প্রলেপন আর মনের বিভূতিতে গড়া সেইসব ছবিতে বাংলার আকাশ, নদী, দিগন্ত, মেঘ, সবুজ শ্যামলিমা, পাখি ও নারী পেয়েছে চিরন্তন প্রবাহমানতা। জয়নুল, কামরুলের সার্থক উত্তরসুরী শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী; ড্রয়িংরুমে আসতেই তার স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের নির্যাসে ষোলকলা পূর্ণ হয়ে উঠল। বললেন, ‘কি বিষয়ে জানতে চাচ্ছ?’

হামিদ কায়সার: আপনার প্রিয় লেখক প্রিয় বই সম্পর্কে।
কাইয়ুম চৌধুরী: জানো, বইয়ের ঘ্রাণটা আমার খুব প্রিয়।
হামিদ কায়সার: পুরনো বইয়ের?
কাইয়ুম চৌধুরী: পুরনো, নতুন সব বইয়ের। বইয়ের ঘ্রাণটার মধ্যে অদ্ভুত শিহরণ জাগানিয়া একটা ব্যাপার আছে, আমার খুবই ভালো লাগে।
হামিদ কায়সার: এই ভালো লাগার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই আপনার শৈশব গড়ে দিয়েছিল?
কাইয়ুম চৌধুরী: হ্যাঁ, এটা শৈশব থেকেই পাওয়া। ছেলেবেলা থেকেই বইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা নিবিড় এবং গাঢ়।
হামিদ কায়সার: এই সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল কিভাবে?
কাইয়ুম চৌধুরী: ছেলে বেলাটা কখনো আমার এক জায়গায় কাটেনি। বাবা চাকরি করতেন। সেজন্য বিভিন্ন জায়গায় থাকা হতো। যতদূর মনে পড়ে, তখন আমরা চট্টগ্রামে থাকি। আমি একটি মক্তবে পড়তাম। তখন মক্তব সবেমাত্র চালু হয়েছে। মক্তবের টিচারকে আমরা বলতাম ওস্তাদজী সংক্ষেপে উস্তী। বাবা এই মক্তব থেকে আমাকে ভর্তি করালেন নরমাল স্কুলে। এ সময়েই পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যবই হাতে আসে।
হামিদ কায়সার: কি বই সেটা?
কাইয়ুম চৌধুরী: এখানে একটি কথা বলতে হয়, বর্তমান প্রজন্মের তুলনায় আমরা মনে হয় লাকি-ই ছিলাম। আমার জন্ম হয়েছিল আনডিভাইডেড ইন্ডিয়ায়। বইপত্র সবই ছিল কোলকাতা-কেন্দ্রিক। খুব সহজেই সেসব বই আমরা পেয়ে যেতাম। হাতেখড়ির পর্যায়ে একেবারে শৈশবে পড়েছি যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘হাসিখুশী’, সুকুমার রায়ের ‘খাই খাই’, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ‘টুনটুনির গল্প’। ‘হাসিখুশী’র ‘অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে’ কিংবা ‘হারাধনের দশটি ছেলে’ ইত্যাদি ছড়া তখন খুব আকর্ষণীয় ছিল। ইংরেজি বাংলা হাতের লেখা চর্চার জন্য বই ছিল আদর্শলিপি, বাংলা ইংরেজি উভয় ভাষাতে— সেগুলিও আমার খুব ভালো লাগতো।
হামিদ কায়সার: আরেকটু বড় হবার পর...
কাইয়ুম চৌধুরী: উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, সুকুমার রায়ের বই তো ছিলই, তারপর পড়তে শুরু করি প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, হেমেন্দ্র কুমার রায়ের বই— এরা তখন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক। ছোটদের জন্যও খুব লিখছিলেন। সেই ছোটদের জন্য লেখা বইগুলি সত্যিই আমাদের মনকে নিয়ে যেত অন্য এক জগতে। এ পর্বের পর, কৈশোরে আমাকে আকর্ষণ করেছিল দেব সাহিত্য কুটিরের বই। তখন আমি নড়াইল সাবডিভিশনাল ইস্কুলের ছাত্র। সেই সময় দেব সাহিত্য কুটিরের ‘কাঞ্চনঝঙ্ঘা’ সিরিজের ডিটেকটিভ বই পড়েছি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। লেখাতো ভালো লাগতোই, বইয়ের প্রচ্ছদ এবং ভেতরের ইলাস্ট্রেশনগুলোও ছিল অপূর্ব। প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলে একজন আর্টিস্ট এসব ছবি আঁকতেন। বইয়ের উপর গ্রীণ কালারের একটি নক্শা থাকতো, সেটাও ছিল দেখার মতো।

হামিদ কায়সার: তাহলে দেখা যাচ্ছে, বইপড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার ভেতরে বইয়ের প্রচ্ছদ এবং ইলাস্ট্রেশনের প্রতি আগ্রহটি শৈশবেই গড়ে ওঠে।
কাইয়ুম চৌধুরী: ঐ যে প্রতুলচন্দ্রের কথা বললাম, কাঞ্চনঝংঘা সিরিজের বইগুলোতে তার আঁকা প্রচ্ছদ এবং ভেতরের ছবিগুলো আমার এতই ভালো লাগতো যে, আমি নিজেই সেই ছবিগুলো আঁকার চেষ্টা করতাম। রঙিন হাফটোন, ওয়াশ কালি-কলমের কাজে, ড্রয়িং পেনের দাগ দিয়ে দিয়ে মাত্র একটি রং-য়ে যে এত স্বতঃস্ফূর্ত এবং নিখুঁতভাবে একটি পরিবেশকে ফুটিয়ে তোলা যায়— তা আমার কাছে এখনো বিস্ময়কর লাগে।
হামিদ কায়সার: দেব সাহিত্য কুটিরের বই ছাড়া তখন আর কোনো বই পড়া হয়নি?
কাইয়ুম চৌধুরী: আমাদের হাতে দেব সাহিত্য কুটিরের বই-ই বেশি আসতো। ওরা তখন পূজাবার্ষিকীও বের করছে। সেসবও ছিল খুব আকর্ষণীয়। পাঁচমিশালী লেখা থাকতো তাতে— হয়তো সুর্নিমল বসুর ছড়া, বিধায়ক ভট্টাচার্যের নাটক, রহস্যোপন্যাস, গল্প— আরো অনেক কিছু থাকতো।
হামিদ কায়সার: তখন আপনি কোন ক্লাসে পড়তেন?
কাইয়ুম চৌধুরী: ফোর-ফাইভে পড়ি, ঐতো, নড়াইল সাবডিভিশনাল স্কুলে। তখন টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বই কিনেছি।
হামিদ কায়সার: কোথ্ থেকে কেনা হতো?
কাইয়ুম চৌধুরী: রূপগঞ্জ বাজার থেকে। রূপগঞ্জ বাজারে যাবার ছিল দুটো রাস্তা— একটা সদর রাস্তা, আরেকটি ছিল চিত্রা নদীর পাশ ঘেঁষে। আমরা স্কুল থেকে চিত্রা নদীর পাশ ঘেঁষা রাস্তা দিয়ে রূপগঞ্জ বাজারে চলে যেতাম। আটআনা দিয়ে কাঞ্চনঝঙ্ঘা সিরিজের একটি বই কিনে নিজেকে মনে হতো বিরাট সম্পদশালী। সে-ই আনন্দের তুলনা হয় না। প্রতি মাসেই কাঞ্চনঝঙ্ঘা সিরিজের একটি করে বই বেরোত। সব বই যে কিনে পড়েছি, তাও নয়। বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে এনেও পড়েছি।
হামিদ কায়সার: বন্ধুরাও পড়তো সবাই।
কাইয়ুম চৌধুরী: বন্ধুরা সবাই কম বেশি পড়তো। অনেকের বাড়িতে বইয়ের ভালো কালেকশনও ছিল। আমার এক বন্ধু ‘কিশোর পাঠাগার’ নামে একটি লাইব্রেরিও করেছিল ব্যক্তিগত। আমিও সেটার মেম্বার ছিলাম। একবার মনে আছে, এক বই আনতে গিয়ে ওর সঙ্গে আমার প্রায় ঝগড়ার উপক্রম হয়েছিল।
হামিদ কায়সার: বইটা কি?
কাইয়ুম চৌধুরী: প্রবোধ কুমার স্যান্নালের ‘ওপারের দূত’। হয়েছিল কি, বইটি লাইব্রেরিতে নতুন এসেছে। আমি গিয়ে চাইলাম পড়ার জন্য। ওতো দেবে না। এক কথা, ‘আমি পড়ে নেই।’ আমি বললাম, ‘আমাকে আগে দে।’ ও কিছুতেই দেবে না। আমিও না নিয়ে ছাড়বো না। কারণ, ও বইটি না পড়ে তো শান্তি পাব না। জোর করেই বইটি ওর কাছে থেকে সেদিন নিয়ে এসেছিলাম।

হামিদ কায়সার: বই-পড়ার প্রতি আপনার আগ্রটা কি এখনো একই রকম রয়েছে?
কাইয়ুম চৌধুরী: এখনো আমি নিয়মিত বই কিনি এবং বই পড়ি। বই কেনার জন্য আলাদা খরচও রাখি। কিনেই হয়তো সঙ্গে সঙ্গে পড়া হয় না; অনেক পরে পড়ি। আবার এরমধ্যে দেখা গেল পুরনো পড়া বইও আবার নতুন করে পড়ছি। আগেতো, সন্ধ্যের পর নিয়মিত পড়তাম। এখন আর আগের মতো পারি না। কাজের চাপ এত বেড়ে গেছে, মাঝে মাঝেই পড়া হয়ে ওঠে না।
হামিদ কায়সার: এখন ভালো লাগে কোন ধরনের বই?
কাইয়ুম চৌধুরী: যে কোন বিষয়ের বই-ই। তবে, সবচেয়ে ভালো লাগে আত্মজীবনীমূলক বই। একজন শিল্পী কিংবা রাজনীতিবিদ অথবা দার্শনিক কিংবা লেখক কিভাবে তার জীবনটিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, কিভাবে বেড়ে ওঠেছেন এবং নিজের মূল্যায়ণ করছেন— তা আমাকে খুব আকর্ষণ করে। এখন আমি পড়ছি ক্যামিলি পিসারো-র জীবনী Depths of glory আরভিং স্টোনের লেখা।
হামিদ কায়সার: এটিও কি ‘লাস্ট ফর লাইফ’-এর মতোই জীবনী-উপন্যাস?
কাইয়ুম চৌধুরী: হ্যাঁ, জীবনী উপন্যাস। শঙ্খ ঘোষের ‘ভিক্টোরিও ওকাম্পো’ পড়ছি দ্বিতীয়বারের মতো। একটি বিস্ময়কর উদ্ধৃতি দিয়েছেন ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের চিঠি থেকে। চিঠিগুলি এল্মহাস্টকে লেখা। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘অত্যাচারে জর্জরিত হওয়া তবু সহ্য করা যায়। কিন্তু একটা সমগ্র যুগ যদি ভেসে যায় মিথ্যে আদর্শে, ঠকে যায়, তার চেয়ে অবমাননার কিছু নেই।’ মনে হলো আমাদের গত একুশ বছরের কথা। আরেকটি বই পড়ার জন্য কিনে রেখেছি। পড়া হয়নি। তবে, বইটি সম্পর্কে এত আলোচনা এত কথা শুনছি যে, মনে হচ্ছে বইটি বুঝি একরকম পড়াই হয়েছে।
হামিদ কায়সার: অরুন্ধুতি রায়ের...
কাইয়ুম চৌধুরী: ‘গড অফ স্মল থিংস’। দেখি, পড়বো...।
হামিদ কায়সার: পরবর্তীকালে একজন প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে বইয়ের সঙ্গে আপনার আত্মিক যোগসূত্র গড়ে ওঠার পেছনে কি শৈশবের সেই কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের শিল্পী প্রতুলচন্দ্রের প্রভাব কোনোভাবে কাজ করেছে?
কাইয়ুম চৌধুরী: হ্যাঁ, প্রতুলচন্দ্র ব্যানার্জী আমার ওপর প্রভাব ফেলেছিলেন, জীবনের প্রথম কাজটার কথাই বলি। ফেনী হাই স্কুলে পড়ার সময় হাতে লেখা পত্রিকার লেখা এবং চিত্রিত করার দায়িত্বটি দেয়া হয়েছিল আমাকে। সেটা আমি করেছিলাম সরাসরি প্রতুলচন্দ্রের প্রভাবে। প্রতুলচন্দ্র ছাড়াও সে সময় ফনী গুপ্ত-এর ছবি, সমর দের ইলাস্ট্রেশন আমার ভেতরের শিল্পী-সত্তাকে একটু একটু করে জাগিয়ে দিয়েছে। জসীমউদদীনের ‘এক পয়সার বাশী’র ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন সমর দে। সেটা ছিল অসাধারণ এক কাজ। সমর দে’র ছবির মধ্যে পরিবেশ নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ডেকোরেটিভ প্যাটার্নও গভীরভাবে ফুটে ওঠতো। এদের ছবি দেখে দেখে আমার ছবি আঁকার নেশা হয়। সত্যজিৎ রায়ের ছবির সঙ্গে তখনো আমার পরিচয় হয়নি, তবে অবনঠাকুর, গগনঠাকুর এবং এদের বোন সুনয়নী দেবী এদের ছবির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। এদের ছবিগুলো দেখেও আমি শিল্পী হবার প্রেরণা পেয়েছি।

হামিদ কায়সার: এদের ছবির সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রটি?
কাইয়ুম চৌধুরী: বাবার মারফতে আমাদের গ্রামের বাড়ি ফেনীর শর্শদি-তে ‘বঙ্গশ্রী’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বসুমতী’ পত্রিকার বিশাল এক সংগ্রহ ছিল। শর্শদীতে গেলেই ওসব পত্রিকা বের করে দেখতাম। অবনঠাকুর, গগনঠাকুর এদের ছবি নিয়মিত থাকতো তাতে। এছাড়া মিঃ টমাস বলে একজনের ছবিও নিয়মিত ছাপা হতো খুবই কমার্শিয়াল, কিভাবে ওঁরা ছাপতেন জানি না কিন্তু, পরবর্তীকালে এ শিল্পীর আর কোনো কাজের খোঁজ পাইনি। এরই মধ্যে সেভেন, এইটে পড়ার সময়ই অবনঠাকুরের বই ‘রাজকাহিনী’, ‘ঘরোয়া’, ‘আলোর ফুলকি’, ‘বুড়ো আংলা’ পড়ে ফেলেছি। সত্যজিৎ রায়-এর কাজের সঙ্গেও পরিচয় হলো। ক্লাস নাইন-টেইনে পড়ার সময় মনে মনে ঠিক করে ফেললাম কলকাতায় গিয়ে আর্ট কলেজে পড়ব। কিন্তু, ’৪৭-এর দেশবিভাগের ফলে সেখানে আর যাওয়া হলো না।
হামিদ কায়সার: শেষে?
কাইয়ুম চৌধুরী: আবেদিন স্যার করাচী থেকে এসে কবে ঢাকায় আর্ট কলেজ খুলবেন, তার প্রতীক্ষায় থাকতো হলো। তখন আমরা থাকতাম ময়মনসিংহের আকুয়া নামের এক জায়গায়। রাজনীতিবিদ নুরুল আমিনের বাসায় ভাড়া থাকতাম। সেখানেই সামনের এক বাড়িতে থাকতেন আবেদিন সাহেবের পরিবার।
হামিদ কায়সার: আবেদিন সাহেব তখন আপনার কাছে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব?
কাইয়ুম চৌধুরী: অবশ্যই। তার কাজ আমি তখন দেখেছি দৈনিক আজাদ-এর বই আকৃতির ঈদসংখ্যায়। শওকত ওসমানের ‘বনী আদম’ উপন্যাস চিত্রিত করেছিলেন। এছাড়া সরকারি কাগজ ‘মাহে নও’ নামে বাংলা মাসিকেও জয়নুল আবেদিনের কাজ নিয়মিত বেরুত। ঈদসংখ্যা আজাদে কামরুল হাসানও ফররুখ আহমেদের ভেংচি কবিতার ছবি একেঁছিলেন মুকুলের মাহফিলে। এভাবেই জয়নুল আবেদিনের, কামরুল হাসানের কাজের সঙ্গে পরিচয় ছিল। আকুয়া থেকেই ’৪৯ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দেই। তখনই জানলাম যে, আবেদিন সাহেব করাচী থেকে এসে ঢাকায় আর্ট কলেজ করবেন। এরপর ঘটলো এক চমকপ্রদ ঘটনা।
হামিদ কায়সার: আকুয়াতেই?
কাইয়ুম চৌধুরী: আকুয়াতেই, একদিন দুপুর বেলা আমাদের বাসার সামনের মসজিদের পুকুরে গোসল করছিলাম। তখন এক বন্ধু বললেন যে, ‘দেখ, দেখ আবেদিন সাহেব’। তাকিয়ে দেখি কানে আঙুল দিয়ে আবেদিন সাহেব পুকুরে ডুব দিচ্ছেন। আমার মনে তখন তুমুল উত্তেজনা। ওঁর সঙ্গেতো কথা বলার সাহস পেলাম না; দৌড়ে বাড়ি গিয়ে বাবাকে ধরলাম, ‘আবেদিন সাহেব এসেছেন, আমার ব্যাপারে আলাপ করো।’ বাবাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম আর্ট কলেজে পড়ব। পরদিন দেখি, আবেদিন সাহেব আমাদের বাসায় এসে হাজির। আমার আঁকা ছবি দেখে বললেন, ‘একে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন।’

হামিদ কায়সার: আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে তো দেখছি, আপনার বাবারও বেশ অবদান রয়েছে।
কাইয়ুম চৌধুরী: একটা জিনিস কি, বাবার একটা প্রেরণা ছিল। বাবা খালি গলায় বেশ সুন্দর গান গাইতে পারতেন। আমার শৈশবেই গান শোনার জন্য একটি গ্রামোফোন কিনে দিয়েছিলেন। প্রচুর রেকর্ডের কালেকশন ছিল তার। প্রতি মাসেই দু’তিনটি রেকর্ড কিনতেন। মনে আছে, বাবার কোলে বসে সিনেমা দেখেছি সায়গল-লীলা দেশাই অভিনীত ‘জীবন মরণ’। শচীন দেব বর্মণ ছিলেন বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে দু’জনে এক ক্লাসের ছাত্র ছিলেনÑসেই সূত্রে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়েছিল। মোদ্দা কথা, বাবা ছিলেন শিল্প-রসিক মানুষ। কিন্তু লেখালেখিও তার ছিল। পাণ্ডুলিপির কভারে ছবিও আঁকতেন। কাজেই, আর্ট কলেজে আমার পড়ার আগ্রহকে তিনি মূল্য দিয়েছিলেন।
হামিদ কায়সার: তো, আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে গেলেন?
কাইয়ুম চৌধুরী: ভর্তি হওয়ার ঘটনাও বেশ স্মরণীয়। আর্ট কলেজে প্রথমদিন যেতেই জয়নুল আবেদিন সাহেব আমাকে দেখেই বললেন, ‘তুমি ময়মনসিংহ থেকে এসেছ, না?’ তারপরই, তিনি আরেক শিক্ষক আনোয়ারুল হকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষাটা হলো, একটি কলসী দেখে দেখে আঁকতে হবে। অন্যান্য পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছিলেন মুর্তজা বশীর, রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাকের মতো আজকের নামী শিল্পীরা। পরীক্ষায় সবাই-ই উত্তীর্ণ হলাম, শুধু রশিদ চৌধুরী পাশ করতে পারলো না। আবেদিন স্যার কিছুতেই ওকে নেবেন না। রশিদ চৌধুরীও ভর্তি হতে নাছোড় হলেন। পরে রশিদ চৌধুরীকে শর্ত দেয়া হলো যে, তিনমাসের মধ্যে যদি সে নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে, তাহলে তাকে ভর্তির সুযোগ দেয়া হবে। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই রশিদ চৌধুরী নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন।

হামিদ কায়সার: প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে আপনার আত্মপ্রকাশতো ঘটেছিল আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর-ই?
কাইয়ুম চৌধুরী: হ্যাঁ, এবং সেটা ঘটেছিল বাস্তবতার প্রয়োজনেই। একমাত্র বাবার আয়ের উপর আমরা সব ভাইবোন পড়াশোনা করতাম। আর্ট কলেজের মাইনে আটটাকা ছাড়া বাবা আর কোনো টাকা দিতে পারতেন না। প্রথম বছরের পর একটা স্কলারশীপ পেয়ে যাই— সেই থেকে মাইনের টাকা ফ্রি। সে টাকা দিয়ে রং তুলি কিনি, তখন থেকেই কর্মাশিয়াল কাজ করার প্রতি আমার আগ্রহ। শিল্পী আমিনুল ইসলাম-এর সহযোগিতায় কাজ জুটেও যায়। একদিন শিল্পী আমিনুল ইসলাম বললেন, ‘প্রতিভা’ নামে কিশোরগঞ্জ থেকে একটি কিশোর পত্রিকা বেরুচ্ছে, প্রচ্ছদটা তুমি-ই করো। এটা দিয়েই শুরু হলো কমার্শিয়াল কাজ। এ কাজের জন্যে ১৫ টাকা পেয়েছিলাম।
হামিদ কায়সার: জীবনের এ পর্বে কি বই পড়তে পারছিলেন?
কাইয়ুম চৌধুরী: বইতো আমার চিরকালের সঙ্গী। বই এ সময়ে যেমন পড়েছি; তেমন কিনেছিও। মনে আছে সেকে- ইয়ারে কলেজে আমি আর মুর্তজা বশীর একটি স্কলারশীপ পেয়েছিলাম, ৩৫ টাকা। সে টাকা নিয়েই ছুটে গিয়েছিলাম দু’জন ওয়ার্সি বুক সেন্টার-এ।
হামিদ কায়সার: সেটা আবার কোথায় ছিল?
কাইয়ুম চৌধুরী: আরমানিটোলায়। আবদুল বারী ওয়ার্সি ছিলেন মালিক। এ দোকানে রং— তুলি, কাগজ এবং বাইরের বই বিক্রি হতো। তো, আমি ওয়ার্সিতে গিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিবারাত্রির কাব্য’ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ কিনতে চাইলাম। বাঁধা দিয়ে উঠলো মুর্তজা বশীর, ‘এগুলো আমার কাছে আছে তোমাকে কিনতে হবে না।’ মুর্তজার বইয়ের কালেকশন ছিল প্রচুর। সেদিন মুর্তজা-র বাঁধা অগ্রাহ্য করেই ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ কিনেছি। আরো কিনেছিলাম নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিলালিপি’, এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘তিনবন্ধু’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেকটি বই ‘স¤্রাট ও শ্রেষ্ঠী’— এ বইটির প্রচ্ছদ ছিল কামরুল হাসানের। আর, রংটংতো কিনেছিই। এই বই কেনার পরদিনই পড়ে গেলাম জ্বরে। কলেজে যেতে হলো না তিনচার দিন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব বই পড়ে শেষ করে ফেলেছিলাম। ‘শিলালিপি’ একটি অসাধারণ বই। পরে, এই ওয়ার্সি-ই বই পাবলিশ করা শুরু করলো।
হামিদ কায়সার: কি বই, সাহিত্যের?
কাইয়ুম চৌধুরী: বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকদের মৌলিক সাহিত্য কর্ম। শিল্পী আমিনুল ইসলাম এদের কিছু কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ করতেন। তিনিই আমাকে ওয়ার্সি-র বইয়ের প্রচ্ছদ করার সুযোগ করে দিলেন। ওয়ার্সি প্রকাশিত আমার করা প্রচ্ছদ-এর প্রথম বইটি ছিল আলাউদ্দিন আল আজাদ-এর গল্পের বই ‘জেগে আছি’। খুব সম্ভব দ্বিতীয় সংস্করণ। একটি ঘড়ি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম। এরপর সম-সাময়িক লেখকদের অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছি— অর্থের প্রয়োজনেই শুরু করেছিলম। কিন্তু, কাজের অনুপাতে সেরকম আয় হতো না।
হামিদ কায়সার: কারণ?
কাইয়ুম চৌধুরী: সেসময় প্রতি ইলাস্ট্রেশনের জন্যে প্রকাশকরা পাঁচটাকা দিতো। কিন্তু, টাকা চাইতে গেলেই হাতে আটআনা ধরিয়ে দিয়ে বলতো, ‘পরে এসো’। এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার, আমি কর্মাশিয়াল কাজটা শিখেছি কামরুল ভাইয়ের কাজ দেখে দেখে। তিনি করতেন কি, আমাদেরকে ক্লাশে একটা কাজ ধরিয়ে দিয়ে, নিজের ছবি আঁকতে বসে যেতেন।
হামিদ কায়সার: কামরুল হাসানও বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন?
কাইয়ুম চৌধুরী: কামরুল হাসান করেছেন। আবেদিন সাহেবও করেছেন। তিনি শামসুদ্দীন আবুল কালাম, কবি আহসান হাবীব, কবি আজিজুর রহমান-এর বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন।
হামিদ কায়সার: তখনকার প্রচ্ছদ এবং এখনকার প্রচ্ছদ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
কাইয়ুম চৌধুরী: এখন কাজের পরিধি অনেকে বেড়েছে। টেকনোলজির ডেভেলপমেন্ট হয়েছে, স্ক্রানার এসেছে। এখন আর এক কালার দু’কালার নয়— মালটিকালারের প্রচ্ছদ হচ্ছে, প্রচ্ছদের অনেক চাকচিক্য বেড়েছে; কিন্তু প্রচ্ছদ আর আগের মত নেই। সব বইয়ের প্রচ্ছদকেই মনে হয় একরকম। বইয়ের ক্যারেকটারটা ঠিক বেরিয়ে আসে না। তখনকার অনেক বইয়ের প্রচ্ছদের স্মৃতি এখনো মনে ঝলমলিয়ে আছে। ’৫৫ সালের দিকে সিগনেট প্রেসের বইগুলো পেতাম ফজলে লোহানীর দোকানে।

হামিদ কায়সার: ফজলে লোহানীর বইয়ের দোকান ছিল?
কাইয়ুম চৌধুরী: বইয়ের দোকান ছিল বাংলাবাজারে। নাম ছিল বুক্স এন্ড বুক্স। ফতেহ লোহানী, ফজলে লোহানী ‘অগত্যা’ পত্রিকা বের করতেন। ফজলে লোহানীর সঙ্গে তো পরে আমার বেশ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছিল। এই ‘অগত্যা’ পত্রিকা আমি প্রথম আবিষ্কার করেছিলাম ময়মনসিংহ থাকতে, হুইলারের বুক স্টলে।
হামিদ কায়সার: হুইলারের বুক স্টল!
কাইয়ুম চৌধুরী: অবিভক্ত ভারতে হুইলার ছিল বিখ্যাত বুক স্টল কোম্পানি। সারা ভারতবর্ষে বড় রেলওয়ে স্টেশনে এদের চ্যানেল বুক স্টল ছিল— ময়মনসিংহ রেল স্টেশনেও ছিল। বোম্বে, কলকাতার পত্রিকা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হুইলারের স্টলগুলোতে মাসের প্রথমেই তা পাওয়া যেত। তো, আমি তখন খুব সিনেমা-র পোকা ছিলাম। বোম্বের বিখ্যাত মোশান পিকচার ম্যাগাজিন বেরোতো! আমি সেটার জন্য নিয়মিত হুইলারের স্টলে যেতাম। সেখানেই একদিন ‘অগত্যা’ চোখে পড়ে। সাদামাটা প্রচ্ছদ। পরে ফতেহ লোহানীর কাছে শুনেছি, ফতেহ লোহানীই করেছিলেন সে প্রচ্ছদ। এবং ওটিই ছিল ‘অগত্যা’র প্রথম সংখ্যা। তখন ঢাকায় ব্লক করা যেত না। উলটো কাঠখোদাই করে ট্রেডল মেশিনে ছাপিয়েছিলেন। আমাদের সময়েই অবশ্য কিছু কিছু ব্লক এসে গেল। তখন সবই ম্যানুয়েলে করতে হতো।
হামিদ কায়সার: বলছিলেন ’৫৫ সালের কথা, ফজলে লোহানীর দোকান থেকে সংগৃহীত কিছু বই আপনার মনে গাঁথা হয়ে আছে।
কাইয়ুম চৌধুরী: হ্যাঁ, অবশ্যিই। সত্যজিৎ রায়ের করা সিগনেট প্রেসের প্রচ্ছদগুলো ছিলো এক কথায় অসাধারণ। নরেশ গুহের ‘দূরন্ত দুপুর’ নামের একটি কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদের কথাই ধরো, একটি ব্ল্যাক লাইনে ঝলমলে হলুদ— এক রমণী বুকের কাপড় ধরে যেন ঘামছে। পিকাসোর ড্রইং-এর আদলে।’ আরো মনে পড়ছে, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘নীল নির্জন’, বিষ্ণুদে’র ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’, এলিয়টের একটি অনূদিত কবিতার বই, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের উপন্যাস ‘বেদে’,— এটার ইলাস্ট্রেশন ছিল মাখন দত্ত গুপ্তের। অবন ঠাকুরের ‘শকুন্তলা’ বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। আমারতো মনে হয়, মাখন দত্ত গুপ্তের ইলাস্ট্রেশন এবং সত্যজিৎ রায়ের প্রচ্ছদের ধারেকাছে এখনো কেউ যেতে পারেনি। এখন কেবল প্রচ্ছদের চাকচিক্যই বেড়েছে। বুদ্ধির অভাব। মনে আছে, সিগনেট থেকে অনুবাদ গল্পের সিরিজ বেরিয়েছিল— তুর্গেনিভের গল্প, সমারসেট মমের গল্প- সেসব বই দেখে মনে হতো, বই শুধু পড়ার নয়, দেখারও। বার্নাডশ’র তো একটি কথা-ই আছে, ‘একটি পৃষ্ঠায় মেকআপ যদি আকর্ষণীয় হয়, তা একটি ছবির সমান আনন্দ দিতে পারে।’— তখন একটি বই প্রকাশের সময় অন্তত সেই যত্নটা নেয়া হতো।
হামিদ কায়সার: অর্থাৎ, বই প্রকাশটা শুধু বাণিজ্যিক স্বার্থের জন্যে হতো না, একটি শৈল্পিক রুচিবোধও কাজ করতো।
কাইয়ুম চৌধুরী: আমরা অন্তত সেটা করতাম, শামসুদ্দিন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’ বইটির প্রচ্ছদের কথাই ধরো, কালাম ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই অনেক পিছনের একটি কথা মনে পড়ে গেল, বলেছি না শৈশবে দেব সাহিত্য কুটিরের ‘কাঞ্চনঝঙ্ঘা’ সিরিজের ডিটেকটিভ বই পড়তাম। এ সিরিজের ২৪টা বেরোবার পর ওরা ‘প্রহেলিকা সিরিজ’ নামে নতুন একটি সিরিজ চালু করেছিল। প্রতিটি প্রকাশিত বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে আগামী মাসের প্রকাশিতব্য বইয়ের টাইটেল পেজের ছবি ও কাহিনী সংক্ষেপে এবং লেখকের নাম থাকতো। প্রহেলিকা-র এক সংখ্যার পেছনের পৃষ্ঠায় লেখকের নাম দেখলাম আবুল কালাম শামসুদ্দিন। উপন্যাসের নাম ‘রাতের অতিথি’। পরে অবশ্য তিনি নিজের নামটা ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। অধীর আগ্রহে বইটি কেনার জন্য আমি প্রতীক্ষা করেছিলাম। প্রকাশমাত্রই লুফে নিয়েছি। দেব সাহিত্য কুটির-এর মতো প্রতিষ্ঠান থেকে আমাদের দেশের একজন লেখকের বই বেরুচ্ছে, এটা ছিল বেশ চাঞ্চল্যকর ঘটনা। পরে অবশ্য তৎকালীন ‘সিনেমা’ পত্রিকার সম্পাদক ফজলুল হকের সুবাদে শামসুদ্দিন আবুল কালামের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সে সময়েরই ঘটনা, কবি আহসান হাবীবের ‘কথা বিতান’ বলে একটি প্রকাশনা ছিল। হাবীব ভাই আমাকে জহরুল হকের ‘সাত সাঁতার’ বইটির প্রচ্ছদ করতে দিয়েছিলেন। এর কভারটা যখন আবেদিন স্যারকে দেখাই, তখন সেখানে উপস্থিত শামসুদ্দিন আবুল কালাম বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, ঢাকা থেকে এমন ভালো কাজ হতে পারে। কালাম ভাই আমাকে বাবু বাজারের ‘ওসমানিয়া বুক ডিপো’র প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদ করার কাজ দিয়েছিলেন।

হামিদ কায়সার: শামসুদ্দিন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’র প্রচ্ছদ কে করেছিলেন?
কাইয়ুম চৌধুরী: জয়নুল আবেদিন। অসাধারণ কভার, অসাধারণ ইলাস্ট্রেশন। উভয় বাংলায় শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে এটি এখনও উল্লেখযোগ্য। ঝালকাঠি বন্দরের একটি ইলাস্ট্রেশন— তুলি দিয়ে যে এত সুন্দর ছবি করা যায়, তার তুলনা হয় না।
হামিদ কায়সার: আপনিতো প্রচ্ছদ করার সূত্রে সেই পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করে সাম্প্রতিকালের লেখকদের লেখা পড়েছেন, সেই অভিজ্ঞতায় আপনার অভিমত বলুন।
কাইয়ুম চৌধুরী: সত্যি কথা বলতে কি, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ্দের মতো শক্তিশালী লেখকদের অভাব বর্তমানে অনুভব করি। দু’একজন ছাড়া হালে আমিতো কোনো সাকসেসফুল ঔপন্যাসিকই দেখি না। এখন সাহিত্য ক্ষেত্রে যাদের পদচারণা দেখতে পাই, তারা অধিকাংশই দৈনিক পত্রিকার কলাম লেখক। সিরিয়াস লেখকের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। ছবি বলো, প্রচ্ছদ বলো, গান বলো আর সাহিত্যই বলো— এখনকার কাজে আইডেনটিটির অভাব।
হামিদ কায়সার: শেকড়চ্যুতি ঘটেছে।
কাইয়ুম চৌধুরী: চরমভাবে। আবেদিন সাহেব এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তিনি সেজন্য আমাদেরকে লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন, পাশ্চাত্যের প্রভাব থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে যাতে আমরা একটি স্বকীয় ধারা তৈরি করতে পারি। সেটা বাদ দিয়ে যতই আমি আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠি না কেন, লাভ নেই। আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটাতে হবে, সার্থকভাবে যা করতে পেরেছেন শিল্পকলায় জয়নুল, কামরুল, আরো একজন নির্ভৃতচারী মানুষের কথা বলবো, শিল্পী শফিউদ্দিন আহমেদ। তার ছবিতে দেশ আছে, মাটির গন্ধ আছে।
হামিদ কায়সার: আপনিও কিন্তু এধারারই একজন যোগ্য উত্তরসুরী।
কাইয়ুম চৌধুরী: বলতে পারি না। ঐ যে বাবার বন্ধু শচীন দেব বর্মণের কথা বলেছি; তিনি আমার খুব প্রিয়। শিল্পী আবেদীন সাহেব যেমন লোকশিল্পের কথা বলতেন, শচীন দেব বর্মণও লোকজ গানের সঙ্গে আধুনিকতার আশ্চর্যরকম সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন, তাতে তো তার গানের আবেদন বিশ্বজনীন হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। আমাদের সবাইকে আসলে ভালো কাজের জন্যে শেকড়-সংলগ্ন হতে হবে।

৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮, সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ