‘নাক নেই’ বোধের রুগ্নতা সারিয়ে তোলার যাত্রা

জাহিদুর রহিম

প্রকাশিত : মার্চ ০২, ২০১৮

রুদ্রকে খুব চেনা লাগে, ছোটবেলার বন্ধুর মতো। তার কবিতা চেনা বলেই কি? তিন বা চার বা পাঁচ বছর আগে কোনও এক বিকেলে বইমেলাতেই আমাদের পরিচয় হয়েছিল। সে পরিচয়ের আগেই তার কবিতা আমার আমার ‘ভালো লাগে’ বলেছিলাম বুঝি কয়েকজনকে। পরিচয় করায় দিছিল পলিয়ার। রুদ্র আগায় এসে বললেন, ‘সিগারেট খাবেন?’ আমি বলি, সাথে তো নেই। উনি কালো পাঞ্জাবির পকেট থেকে যত্ন করে আগায় দেন।

এরপরে সিগারেট টানতে টানতে দুজনেই যখন আলাদা হচ্ছি, আমরা বলছিলাম আমাদের অনেক কথা আছে। এরপরে দিন সপ্তাহ মাস বছর যায়, দেখা আর হয় না। হয়তো রুদ্র কখনো ফোন দিয়া বলল, কই? আমি বলি, আমি তো ঢাকার বাইরে। এসে ফোন দেই? তিনি বলেন, আচ্ছা।

পরের সপ্তাহে আমি ফোন দেই, কই?
রুদ্র বলে, আমি তো কাজে ব্যস্ত। কাল সময় হবে?
এই করে করে দিন যায়। আমাদের ‘কাল’ আর আসে না। আবার পরের বছর বইমেলায় দেখা হয়। আমি বলি, সিগারেট খাবেন? উনি বলেন, সাথে নেই। আমি পকেট থেকে বের করে আগায় দেই। আর দুজন দুই বিপরীত দিকে যেতে যেতে বলি, খুব শিগ্রই বসবো। অনেক কথা আছে। দুজনেই কি জানি যে, আমাদের সময় মিলবে না?

তবু তাঁকে চিনি, কারণ তার কবিতা আমার চেনা, স্কুলের ঘণ্টার মতো।

ঘণ্টা বাজছে স্কুলে
ছুটি ছুটি বলে মানুষ ছুটে যাবে সন্ধ্যার দিকে
নেশার দিকে, কথা-ক্লেদ ও আগুনের দিকে;

অক্ষর তো জড়, কিন্তু রুদ্র পাঠককে অক্ষরের জড়তা মুক্ত করেছেন। যেমন এই কবিতায়, যে মুহূর্তে বলা হলো, ‘মানুষ ছুটে যাবে সন্ধ্যার দিকে’ এক আলোকিত আরোহণ হলো সাধারণ শব্দের কবিতায়। কিন্তু এই আরোহণ জোরপূর্বক নয়, স্বেচ্ছায় ইচ্ছায়, স্বাভাবিকতায় আর প্রফুল্লতায়। কবিতায় অদ্ভুত বিকৃত শব্দের উপমার ব্যবহার তো আমরা দেখেছি কবিদের, কবি বোদলেয়ারেই বেশি। ‘হুগোর যুগে’র প্রাবল্যকে অস্বীকার করতে বোদলেয়ারের এটা ছিল পলায়ন কৌশল।

রুদ্র উপমা ব্যবহারেকবিতা আরোহণে পালিয়ে যাননি ‘একান্ত কবি মন’ থেকে। ‘বীভৎস মেঘেরা এত নিচু হয়ে আসে কেন’ একটুও বেখাপ্পা লাগে না। মনে হয়, ভালোবেসে কেউ ডেকে আনছে মেঘ। রুদ্রের কবিতা ভালো লাগার প্রথম এবং হয়তো প্রধান কারণ এখানে তথাকথিত ছন্দের বেড়া দিয়ে কল্পনাকে আটকে রাখার চেষ্টা নেই। কলম চলেছে সাবলীল, আছে এক নির্মাণ, ক্রমশ পরিণতি। এক উৎফুল্ল অনুভবের ইঙ্গিত, বুদ্ধদেব বসু কথিত ‘মুখের সহজ ভাষার পাশাপাশি প্রাণ-স্পন্দনের জোর’। এটা রুদ্রের কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, আমার কাছে। আত্মসচেতনতার জায়গা থেকে বোধের রুগ্নতা সারিয়ে তুলতে এক যাত্রা। এ যাত্রা কবিতার যাত্রা।

যে পাখি দিনভর ডানা মেলে উড়ে গেল একা একা
তাকে ফেলে কত দূর গেল মেঘ?

কবিতা তো শেষপর্যন্ত জীবনের বিলীয়মান মুহূর্তকে ধরে রাখার চেষ্টা। সে চেষ্টার যেই নানা পথ সেটাই কবিতার বৈচিত্র্যতার কারণ। যে যে পথেই এই মুহূর্তকে ধরতে যাক, পাঠককে এর সবটা না হলেও এক জলছাপ দেখাতেই হয়। রুদ্র তাই করেছেন। তার এই কাব্যে কাব্য ভাষার মিল ব্যতিরেকে সব কবিতার ‘প্রচ্ছদ’ সম্পূর্ণ আলাদা। মানে, বিষয়গুলো ছোট ছোট মুহূর্তের এক বিকাশ যেন। সেই বিকাশের পথে আধুনিকতার প্রথাসিদ্ধ পথে বারবার শব্দকে নিয়ে নেমেছেন কঠিন পথে। কিন্তু কবিতা কখনোই মিষ্টতা হারায়নি। ছদ্ম কাঠিন্যের আড়ালে কবিতার লাবণ্যের শরীর বারবার দেখা যায়।

একটা ডিপ্রেশনভর্তি জাহাজ
একটা মদ ভর্তি জাহাজকে ক্রস করে যাচ্ছে
উলটো পিঠে বসে আছে চাঁদ

তীরে, বসে বুদ্ধের মাথা আঁকছি
নাক এবড়োথেবড়ো
চোখ স্থির
ঠোঁটে বাকা হাসি

কবিতায় কবি তো একটা ছবিই দেখান। একটা মুহূর্তের ছবি। যেই মুহূর্ত তার বোধকে ব্যাপকভাবে আহত করেছে উস্কে দিয়েছে নিজের স্বরে ব্যক্ত করতে ওই মুহূর্ত। আমি রুদ্রের কবিতার ভেতর সেই স্বরের সন্ধানে নেমেছি আর দেখেছি, বোধের আহত মুহূর্তেও সচেতনতার সংযম এক মুহূর্তেও তাকে ছেড়ে যায়নি। একারণে তার কবিতায় কোনও শব্দই অতিরিক্ত লাগে না, বরং এক ধারণ করে এক পারস্পারিক অনিবার্যতা, আধুনিক কবিতার যেটা এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।

অগণন ভুলের পাশে
লালফুল পদ্মের দেহ ঘেঁষে
স্নানে ডুবে মরবে বলে
ফিরছে পাখি

কবিতায় শব্দ তো আবেগে ডুবানো থাকেই। কিন্তু কবির জন্য চ্যালেঞ্জ হলো, তিনি পাঠকের চিন্তাকে কতটা নতুন বর্ণালিতে বিভক্ত করে কবিতার শরীর দেখান। সেটা যদি চমকে ভরপুর হয় তবে অনেক সময় আরোপিত লাগে। মনে হয়, কবি বাধ্য করছেন দেখতে। কবি তো কেবল সংকেত দিয়ে যাবেন। দেবেন পাঠককে দেখার স্বাধীনতা। রুদ্র কবিতায় পাঠককে চিন্তার স্বাধীনতা দিয়েছেন। একটু বেশিই দিয়েছেন বলা যায়। অনেক দৃশ্য আরও কম ইঙ্গিতে ছেড়ে দিলেও ক্ষতি ছিল না।

শেষপর্যন্ত কবিতা কবির নিজের বেঁছে নেয়া একান্ত জীবন বয়ান। সেই বয়ানের বিশ্বাস যোগ্যতা থাকতেই হয়, কিন্তু এর কোনও সত্য-মিথ্যা নেই, আছে কেবল এক গতি। রুদ্র তার গতিময় বয়ানে নিজেকে কত নিখুঁতভাবে ভাঙতে পারলেন, তা সময় ও তার পাঠক বিচার করুক, আমি বিভ্রমের চেয়ে ক্ষণস্থায়ী সুগন্ধি কিছু নেই জেনেও সময়ের সমুদ্রের বেলাভূমি আর ঝাউবন পার হয়ে, যেখানে কখনো জোয়ারের পানি আসে না, শুকনো বালিতে লিখে রাখলাম একটি নাম, যার ‘নাক নেই’।

একুশে বইমেলা ২০১৮