ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

নিজেকে গ্রাম্য ভাবতেই ভালো লাগে

অতনু তিয়াস

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৮

বেড়ে উঠেছি গ্রামে, পূজা-পার্বণ-উৎসব আর সংস্কৃতিমুখর আনন্দময় পরিবেশে। আমার গ্রামের নাম লাউটিয়া। লাউটিয়া বড়বাড়ি নামে আমাদের বাড়িটি আশপাশের এলাকায় বেশ পরিচিত ছিল। খেলার সাথিদের নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছি শৈশবের সারাবেলা। মাছধরা, ডুবসাঁতার, গায়ে ধুলোবালি মেখে এরপর সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা। এসব ছিল নিত্যদিনের কাজ। বাবাকে ভীষণ ভয় পেতাম। পেশাগত কারণে বাবা থাকতেন গারো পাহাড়সংলগ্ন মুনসিরহাট বাজারে। সপ্তাহে একদিন বাড়ি আসতেন। ওই একটা দিন আমি সুবোধ ছেলে। আর বাকি ছয় দিন ছিল পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর দিন। একান্নবর্তী পরিবারে দাদু আর ঠাকুমার আদর-আস্কারা, কাকা-কাকিমণির স্নেহ আমাকে বাঁধনহারা হতে সাহস দিয়েছে।

লাল ফড়িঙের পিছে দৌড়াতে দৌড়াতে কখন যে বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে গেছি, টেরই পেতাম না। বারোমাসে তেরো পার্বণ আমাদের বাড়িতে লেগেই থাকত। বর্ষায় পদ্মপুরাণ পাঠ, আশ্বিনে দুর্গাপূজা, কার্তিকে দিপাবলি, কার্তিকপূজা; পৌষসংক্রান্তি, চৈত্রসংক্রান্তি, এমন কোনো পূজা-পার্বণ বাদ যায়নি। আর সেসব পার্বণে আনন্দে টইটুম্বুর হয়ে থাকত মন। পৌষসংক্রান্তির রাতে মাঠের মধ্যে ঘর বানিয়ে বন্ধুদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করে রাত কাটতো। ভোরবেলায় স্নান করে পোড়ানো হতো সেই ঘর। শীতের পিঠা খেতে খেতে পোহাতাম ঘরপোড়া আগুন। নাটক, ঢপযাত্রা, যাত্রাপালা, কীর্তন সবকিছু লেগে আছে আমার এই শরীরে। রোদে শুকাতে দেয়া সদ্য আঁশ ছাড়ানো পাটের গন্ধ এখনো লেগে আছে নাকে।

ধানখেতে বাতাসের ছন্দময় ঢেউ বুকের ভেতর এখনো টের পাই। এসবই আমার কবিতার আরাধ্য বিষয়। আমি আসলে বেঁচে থাকি গ্রামের আবহ মেখে, শৈশবকে লালন করে। ফিরে যাই শেকড়ের কাছে। ঐতিহ্যের রত্নভাণ্ডার থেকে রত্নগুলো কুড়িয়ে আনতে গিয়ে যখন সামনে তাকাই, দেখি সবাই ভাবছে আমি পেছনে পড়ে গেছি। আসলেই কি! গ্রামকে ‘পেছন’ না ভেবে আমি সামনে এগোই। কারণ নগরকে ‘সম্মুখ’ মনে হয়নি কখনো। তাই নিজেকে গ্রাম্য ভাবতেই ভালো লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি একটা বুনোহাঁস। খাদ্যের খোঁজে নগরে চলে এসেছি। কিন্তু নগরের পোষ মানছে না আমার মন। তাই পালকের ভাঁজে লিখে রেখেছি, ‘আমি যেন এক মুখচোরা অবাধ্য কিশোর/সভ্যতার রাগী চোখের সামনে খালি গায়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ ক্ষমার অপেক্ষায়...’

আধুনিকতার রঙিন অন্ধকারে নিজের সঙ্গে কানামাছি খেলতে খেলতে কেটে যাচ্ছে দিন। মরে যাওয়া নদী, উজাড় হওয়া বন, ফেরারি মুক্ত বাতাস, চুরি হওয়া আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, এরা আমাকে লিখতে তাড়িত করে। তখন অনুভূতিগুলো শব্দের আশ্রয় পেতে ইতিউতি ছুটে। কিন্তু লিখতে বড়ই আলস্য। ভাবনাগুলো ভাষা পেতে চায়। তবু লেখা হয় না। খণ্ড খণ্ড অনুভূতিগুলো সুসংহত না হলে, ভাবনাগুলো স্মৃতিতে স্থায়ী না হলে আমি লিখতে পারি না। যতটুকু স্থায়ী হয় তা-ই নির্যাস, একদিন তা ভাষা পায়। তাকে শুশ্রুষা দিতে হয়, যত্ন পেলে হয়ে ওঠে কবিতা, হয়ে ওঠে গান। আনমনে গুনগুন করি। গুনগুন কথাগুলো সুরের আবেশ মেখে গান হয়ে উঠতে চায়। পাখির স্বভাবে গান গাই। গান আর কবিতায় আপন আত্মাকে ঘিরেই যেন এ আবর্তন, ‘প্রকৃত’ স্বরূপের সন্ধান স্থান ও কালের নিরিখে।

জীবনকে মনে হয় এক অনিবার্য অজ্ঞাতবাস, অসম্পূর্ণ স্বপ্নভ্রমণ। হাসতে হাসতে যাই, কাঁদতে কাঁদতে যাই, অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে যেতে চাই অমৃত আলোর দিকে... আর এই অভীপ্সাই আমাদের এগিয়ে যেতে প্রেরণা জোগায়।

অতনু তিয়াসের জন্ম ৩১ জুলাই ১৯৭৫, ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর থানার ঔটি গ্রামে, মাতুলালয়ে। বাবা, পরিতোষ দেবনাথ। মা, শচী দেবনাথ। শৈশব কেটেছে পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দার লাউটিয়া গ্রামে। দৈনিক ইত্তেফাকের ‘কচি-কাঁচার আসর’ এর বিভাগীয় সম্পাদক। কাব্যগ্রন্থ: রাংসার কলরোল (২০০৭, ঐতিহ্য), আমি অথবা অন্য কেউ (২০১৮, ঐতিহ্য)। ‘মায়ের জন্য ভালোবাসা’ গীতিকবিতার জন্য ২০০৯ সালে পেয়েছেন ডেইলি স্টার-স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক আয়োজিত ‘সেলিব্রেটিং লাইফ’ অ্যাওয়ার্ড।