পরকীয়া আর কোনো ক্রাইম নয়

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৮

মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের চারশো সাতানব্বই ধারাটিকে আনকন্সটিটিউশনাল ঘোষণা করে স্ট্রাইক ডাউন করলেন। কি ছিল এই ধারাটিতে? একজন পুরুষ যদি আরেকজন পুরুষের পারমিশন ছাড়া ওই দ্বিতীয় পুরুষের বউয়ের সাথে শোয় তাহলে সেই প্রথম পুরুষটি হলো ক্রিমিনাল এবং হাজতবাসের যোগ্য। মানে পরের ধন লুকিয়ে লুকিয়ে ভোগ করলে যা হয় আর কি! বিবাহিত পুরুষটি চাইলে অন্য কোনো পুরুষকে তার স্ত্রী তথা অস্থাবর সম্পত্তিতে হাত লাগানোর অধিকার দিতে পারে, সেক্ষেত্রে সেটা ক্রাইম নয়। আবার লুকিয়ে লুকিয়ে পেরেম তথা সঙ্গম রচানো পুরুষটি নিজে যদি বিবাহিত হয়, কিন্তু সেই প্রেমিকা যদি বিবাহিত না হয়, তবে সেই অ্যাক্ট অ্যাডাল্ট্রির ধারাভুক্ত নয় বা অপরাধ নয়, কারণ যে মেয়ের বিয়েই হয়নি সে কারো ধন বা সম্পত্তি নয়, সে বানের জলে ভেসে আসা পাবলিক, কাজেই তাকে চুরি করে ভোগ করার গপ্পটাই আসে না, যেন সে যে কারোর ভোগে লাগার জন্য উন্মুক্ত! আরো মজার বিষয় হলো, চারশো সাতানব্বই এর ক্রিমিনাল চার্জেস লাগে শুধু পুরুষের বিরুদ্ধে, কারণ ভোগ তো করে সে একা, সঙ্গের সরলা স্ত্রীটি এসবের কিই বা জানে, যেন তাকে পরের ঘর থেকে বোচকার মতো তুলে আনা হয়েছে। সে কেবল বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওপরের দিকে চেয়ে থেকেছে ঘরঘর করে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে!

এবার মুক্তি পেলো দুজনেই। পরপুরুষের সাথে শুতে যায় যে স্ত্রী সে কোনো বোবা কালা জড়বস্তু নয়, যে স্বামীর তোরঙ্গ খুলে তাকে চুপিচুপি উঠিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সে যা করে তার নিজ ইচ্ছায় করে। সি মে হ্যাভ হার প্রেফারেন্সেস হোয়াইল চুজিং আ লাভার অর সেক্সুয়াল পার্টনার। চিরদিনই ধরে নেয়া হয়েছে মেয়েরা যৌন পণ্য, ভোগ্যবস্তু, কিন্তু সেও যে সমান ভাবে ভোগ করে, ভালো মন্দের সেও যে সমান সমান অংশীদার এই চরম সত্যকে জেনে বুঝেও পর্দার আড়ালে রাখা হয়েছে এতদিন, তা তাদের ওপর প্রভুত্ব করার যে অদম্য বাসনা তা কায়েম রাখার জন্যই।

মুক্তি পেল সেই পুরুষটিও পরস্ত্রীকে উসকে প্রেম করার দায়ে যাকে একাই হাজতবাসের হুমকি ভোগ করতে হয়েছে। যেন সেই কচি খুকিটির কোনো দোষ নেই, তাকে ভোগ করার কথা ছিল একজনের, করেছে আরেকজন। এতে তার কোনো দায় নেই, যেন বলির পাঠা, একজন চুরি করে তুলে নিয়ে গিয়ে কোপ মেরে দিয়েছে, এখন পাঠার মালিক এসেছে বিচার চাইতে। লে হালুয়া! প্রেম করলো দুজন মিলে, শুলো দুজন মিলে, কিন্তু জেল খাটবার বেলায় তখন দোষ কেবল পুরুষের?

এই অসাম্য আর অবিচারের অন্ধকার এবার ঘুচলো। পরকীয়া আর কোনো ক্রাইম নয়।  কিন্তু হ্যাঁ, পরকীয়া যদি কারোর স্পাউসের সুইসাইডের কারণ হয় তখন সেটিকে অ্যাবেটমেন্ট অফ সুইসাইডের একটি গ্রাউন্ড হিসেবে তুলে ধরা যাবে। দ্বিতীয়ত, ডিভোর্সের গ্রাউন্ড হিসেবেও থাকতে পারে অ্যাডাল্ট্রি, বাট ইট উড স্ট্রিক্টলি কাম আন্ডার সিভিল হেড।

চারশো সাতানব্বই স্ট্রাক ডাউন হয়েছে বলে নাকি পরকীয়া বাড়বে? আমার তা মনে হয় না। মানুষের মন বড় অদ্ভুত জিনিস। সে অনেকটা নদীর মতো। সে যেই অভিমুখে ধাবিত হওয়ার সেই অভিমুখেই হবে। আইন দিয়ে তাকে কিছুটা রেস্ট্রিক্ট করা গেলেও মনের অভিমুখ বদলানো যায় না জোড় করে। এতদিন চারশো সাতানব্বই এর খাঁড়া মাথার ওপর ঝুলছিলো বলে লোকে কি ডুবে ডুবে জল খায়নি নাকি কম খেয়েছে? কোনোটাই নয়। তাছাড়া দুজন অ্যাডাল্ট মানুষ মিউচুয়াল কনসেন্টে নিজেদের জীবনে যা করে সেটার দায় তো আর কোন একজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যায় না, তুমি একাই অপরাধ করেছো এই বলে!

বরং যা কিছু নিষিদ্ধ তার ওপর মানুষের একটা আকর্ষণ থেকে যায়। অপরাধপ্রবণতা মানুষের এক অন্যতম রিপু। আগে যা অপরাধ বলে বিবেচিত হতো, যার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল, এখন তা হয়ে গেল প্রায় জলভাত। আইনের চোখে ধুলো দেয়ার আর প্রয়োজন থাকলো না। কিন্তু সেই মানুষটার চোখে, যে নাকি বিশ্বাস করে তুমি তাকে ভালোবাসো? তোমার ওপর অনেক অভিমান নিয়েও তোমার ভালো মন্দের কথা ভাবে? তুমি ভুলে গেলে ওষুধের স্ট্রিপটা হাতে ধরিয়ে দেয় মনে করে? আকাশে মেঘ দেখলে ছাতাটা ভরে দিতে ভোলেনি যে কখনো তোমার ব্যাগে? ভালোবাসার সাথে বিশ্বাসের সাথে এই লুকোচুরি খেলার দায় তবে কি এড়ানো যাবে?

আইন চলবে আইনের পথে। কিন্তু মনস্তত্ত্বের আলোয় বিষয়টা একই রকম জটিল এবং স্পর্শকাতর হয়ে থেকে যাবে চিরদিন এই আমার বিশ্বাস। তুমি যাকে ভালোবাসো সে অন্য কাউকেও ভালোবাসতে পারে, তোমার আড়ালে তার সাথেও নিবিড় হতে পারে একই আশ্লেষে, এ`কথা যেদিন সত্য হিসেবে মেনে নিতে পারবে, যেদিন বুঝতে শিখবে `আদত সে মজবুর` সেই মানুষটি আসলে প্রবৃত্তির কাছে অসহায়, সেদিন জানবে ভালোবাসা দিয়ে যাকে বাঁধা যায় না তাকে বাঁধা যায় না আর কিছুতেই। যেদিন বুঝতে শিখবে কাউকে বাঁধতে চাওয়াটাই আসলে ভুল। `অমন হলে আমি মেনে নিতে পারবো না` এই ভাবনাটা ভীষণ বালখিল্য। কারণ তোমার মানা আর না মানা দিয়ে পৃথিবীর যায় আসে না কিছুমাত্র।

সেদিন জেনো, এই সমাজ নামক অরণ্যে তুমি ততটাই নিরাপদ যতটা নিরাপত্তা তোমাকে কোনো আইন দিতে পারবে না কোনোদিন।

লেখক: কবি ও আইনজীবী, কলকাতা সুপ্রীম কোর্ট