বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানসম্মততা: বর্ণমালা ও বানানে

শেষ পর্ব

চৈতন্য চন্দ্র দাস

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৮

৯. ‘ঈয়’ প্রত্যয়যুক্ত সকল শব্দে, এমনকি বিদেশি শব্দেও ‘ঈ’-কার হবে। যেমন- মানবীয়, রাজকীয়, ভারতীয়, ইতালীয়, ইরানীয়, আরবীয়, দর্শনীয়, বায়বীয়, জাতীয়, সম্মাননীয়, রাষ্টীয়, নারকীয়, শাস্ত্রীয় ইত্যাদি।
(ঘ)  অতৎসম/বিদেশী শব্দের বানানের কিছু বৈশিষ্ট্য:
১. কোনো অতৎসম/বিদেশী শব্দে কখনও ‘ণ’ হয় না। যেমন- গিন্নি (তৎসম গৃহিণী), ঘরনি, ধরন, অঘ্রান (তৎসম অগ্রহায়ণ), পরান (তৎসম প্রাণ), সোনা (তৎসম স্বর্ণ), কান (তৎসম কর্ণ), কেরানি (তৎসম করণিক), ঝর্না (তৎসম প্রসবণ), ক্যান্টনমেন্ট, মাচেন্ট, বার্নিশ, লন্ডন, ফান্ড ইত্যাদি।
২. কোনো অতৎসম/বিদেশি শব্দে কখনও ‘ষ’ ব্যবহার করা যাবে না। যেমন- ফসল, নকশা, রসিদ, শার্ট, স্টার, ফটোস্ট্যাট, পোস্ট, মাস্টার, ডাস্টার, স্টেশন, প্লাস্টিক, বুস্টার, রোস্টার, কোস্টার, রেজিস্ট্রি, রেজিস্ট্রার ইত্যাদি।
৩. অতৎসম/বিদেশি শব্দে কখনও ঈ/ ী বা ঊ/ ূ ব্যবহার করা যাবে না। যেমন- গাড়ি, বাড়ি, আরবি, ফারসি, রুপোলি (কিন্তু রূপালি), উনিশ (কিন্তু ঊনবিংশ), পুজো, নতুন, মুলো (কিন্তু তৎসম পূজা, নূতন, মূলা), বুট, শ্যুট, রুম ইত্যাদি।
৪. অতৎসম/বিদেশি শব্দে রেফ (র্ ) এর পরস্থিত ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বি-ত্ব হবে না। যেমন- কর্জ, কোর্তা, সর্দার, খর্জুর, মর্টার, বার্নার ইত্যাদি।
৫. অতৎসম বা পরিবর্তিত শব্দে ‘ক্ষ’ এর পরিবর্তে ‘খ’ লেখা বাঞ্ছনীয়। যেমন- খুদ, খুদে (তৎসম- ক্ষুদ্র), খিদে (তৎসম- ক্ষুধা), ভুখা (তৎসম- বুভুক্ষু), চোখ (তৎসম- চক্ষু), আঁখি (তৎসম- অক্ষি), ধানখেত (তৎসম- ধান্যক্ষেত্র), খোদ, খোদা, খোশ, খবিশ, খাস, খুর, খেপ, খ্যাপা ইত্যাদি।
৬. বিদেশি শব্দে অবিকৃত উচ্চারণের ক্ষেত্রে এ/ে ব্যবহৃত হবে। যেমন- এন্ড (ঊহফ), নেট, বেড, শেড, মেস, এম.এ, এক্স্ট্রা ইত্যাদি। কিন্তু বিকৃত বা বাঁকা উচ্চারণে ‘এ/’ে এর পরিবর্তে ‘অ্যা/্যা’ ব্যবহার করতে হবে। যেমন অ্যান্ড (অহফ), ব্যাট, অ্যাবসার্ড, ক্যাসেট, ম্যানেজার ইত্যাদি।
৭.ইংরেজি ‘ং’, আরবি-ফারসি ‘সা’ ( ث), ‘সিন’ (س), ‘সোয়াদ’ (ص) বর্ণগুলোর প্রতিবর্ণরূপে বাংলায় দন্ত্য ‘স’ ব্যবহৃত হবে। কিন্তু ইংরেজি ংয, ংরড়, ংংরড়, ঃরড় এবং আরবি-ফারসি ‘শিন’ (ش) এর প্রতিবর্ণরূপে বাংলায় তালব্য ‘শ’ ব্যবহার করতে হবে। যেমন- স্যার, সরি, স্ট্যান্ড, সালাম, ইসলাম, আসমান, শার্ট, ডিভিশন, মিশন, পজিশন, এশা, শাবান (হিজরি মাস), শখ, শামিল, শান ইত্যাদি।
৮. তদ্ভব ও অর্ধ-তৎসম শব্দে ‘য’ এর পরিবর্তে ‘জ’ ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। যেমন- সুরুজ (তৎসম সূর্য), কাজ (তৎসম কার্য) ইত্যাদি।
৯. বিদেশি শব্দে সাধারণত বর্গীয় ‘জ’ ব্যবহৃত হয় । যেমন- কাগজ, হাজার, বাজার, জুলুম, জালিম, জাহির, হাজির, হাজি, জ্যাকেট, জিন্স, জার্নাল, জোন, জজ, জেন্টলম্যান, জেব্রা ইত্যাদি। কিন্তু ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত কিছু শব্দে যাল, যোয়াদ এবং ইংরেজি ‘ু’ এর মতো উচ্চারণের ক্ষেত্রে ‘য’ ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- আযান, ওযু, রমযান, কাযা ইত্যাদি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কেউ ইচ্ছা করলে এ সমস্ত শব্দে ‘জ’ ব্যবহার করে আজান, ওজু, রমজান, কাজা লিখতে পারেন।

বাংলা শব্দের বানানের ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি স্মরণ্য বিষয়
১. বিসর্গযুক্ত ‘ই’ কিংবা ‘উ’- এর পরে ‘র’ এর সন্ধি হলে বিসর্গটি লোপ পায় এবং ‘ই’ ও ‘উ’- এর স্থলে যথাক্রমে  ‘ঈ’-কার ( ী) এবং ‘ঊ’-কার ( ূ ) হয়ে যায়। যেমন- নিঃ+রব= নীরব, নিঃ+রস= নীরস, চক্ষুঃ+রোগ= চক্ষূরোগ ইত্যাদি।
২. বিসর্গযুক্ত অ-কারের পরে যেকোনো বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণ এবং অন্তঃস্থ ‘য’, অন্তঃস্থ ‘ব’, র, ল, হ যুক্ত হলে বিসর্গ (ঃ)- এর স্থলে ও-কার   হয়ে যায়। যেমন- সদ্যঃ+জাত= সদ্যোজাত, মনঃ+যোগ= মনোযোগ, তপঃ+ধন= তপোধন, মনঃ+হর= মনোহর, মনঃ+রমা= মনোরমা, তিরঃ+ধান= তিরোধান, মনঃ+লোভা= মনোলোভা, পয়ঃ+নালী= পয়োনালী ইত্যাদি।
কিন্তু, বিসর্গযুক্ত অ-কারের পরে যেকোনো বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণ এবং দন্ত্য ‘স’ যুক্ত হলে বিসর্গ (ঃ) লোপ পায় না। যেমন- সদ্যঃ+স্নাত= সদ্যঃস্নাত, পয়ঃ+প্রণালী= পয়ঃপ্রণালী, মনঃ+কষ্ট= মনঃকষ্ট, পুনঃ+পুনঃ= পুনঃপুনঃ, দুঃ+সাধ্য= দুঃসাধ্য, অন্তঃ+সত্ত্বা= অন্তঃসত্ত্বা ইত্যাদি।
৩. ‘অদ্ভুত’, ‘অদ্ভুতুড়ে’ এবং ‘ভুতুড়ে’ শব্দের ‘ভূত’ ছাড়া সকল ‘ভূত’ ‘ঊ’-কার ( ূ ) বিশিষ্ট। যেমন- ভূতপূর্ব, অভিভূত, অন্তর্ভূত, কিম্ভূতকিমাকার, প্রভূত, পরাভূত, বশীভূত, উদ্ভূত, আবির্ভূত ইত্যাদি।
৪. ‘অঞ্জলি’ এবং অঞ্জলিযুক্ত সকল শব্দে ই-কার ব্যবহৃত হয়। যেমন- শ্রদ্ধাঞ্জলি, কৃতাঞ্জলি, পুষ্পাঞ্জলি, অর্ঘাঞ্জলি, কনকাঞ্জলি ইত্যাদি।
৫. সকল ‘জীবী’ যুক্ত শব্দে দুটোই ঈ-কার ( ী) হবে (যদিও ‘জীবিকা’ শব্দে ‘ইকা’ প্রত্যয় যুক্ত থাকায় শেষে ই-কার হয়)। যেমন- বুদ্ধিজীবী, শ্রমজীবী, কর্মজীবী, পেশাজীবী, মিথোজীবী, পরজীবী, কৃষিজীবী, আইনজীবী ইত্যাদি।
৬. কোনো শব্দ তৎসম না হলে অর্থাৎ অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশী বা বিদেশী হলে একটি সহজ সূত্রের সাহায্যে এরূপ শত শত শব্দের বানানের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা যায়। এ সমস্ত অর্ধ-তৎসম শব্দে কখনও  ণ, ষ, ঈ, ঈ-কার ( ী ), ঊ, ঊ-কার ( ূ ), ক্ষ এবং য  ব্যবহার করা যাবে না। উদাহরণ নিম্নরূপ:

তৎসম    অ-তৎসম    তৎসম    অ-তৎসম    তৎসম    অ-তৎসম
কর্ণ    কান    হস্তী    হাতি    ধান্যক্ষেত্র    ধানখেত
গৃহিণী    গিন্নি বা ঘরনি    কূম্ভীর    কুমির    ক্ষুদ্র    খুদে
প্রস্রবণ    র্ঝনা    পূর্বালি    পুবালি    চক্ষু বা অক্ষি    চোখ বা আঁখি
কাষ্ঠ    কাঠ    রূপালি    রুপোলি    কার্য    কাজ
বাটী    বাড়ি    দুর্গাপূজা    দুর্গাপুজো    সূর্য    সুরুজ

৭. বিসর্গ (ঃ)- এর উচ্চারণ হলো হলন্ত/হসন্ত ‘হ’। অর্থাৎ, বিসর্গ (ঃ)= হ্। বিসর্গের উচ্চারণ সংস্কৃতে থাকলেও বাংলা ভাষায় এর ব্যবহার কম। এক সময় প্রচলন থাকলেও প্রমিত বানানের নিয়ম অনুসারে সাধারণত পদান্তে বিসর্গ (ঃ) হয় না। যেমন- ফলত, মূলত, কার্যত, প্রায়শ, বস্তুত, জ্ঞানত, দৃশ্যত  প্রধানত ইত্যাদি। তবে, কেনো শব্দে বিসর্গের উচ্চারণ রক্ষিত থাকলে বিসর্গ (ঃ) ব্যবহার করতে হবে। এমন শব্দ হিসেবে পুনঃপুনঃ, দুঃখ ইত্যাদি উল্লেখ করা যায়।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের ভারতীয় আর্য প্রশাখা থেকে আগত ভাষাসমূহ ব্যতিরেকে পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় শব্দের বানান লিখবার এতো সূত্রবদ্ধ উপায় নেই। নেই বর্ণমালা বিন্যাসের এমন সুশৃঙ্খল পদ্ধতি। যেকোনো দক্ষতা অর্জনই শ্রমসাপেক্ষ্য ব্যাপার। বাংলা বানানে দক্ষতা অর্জন করতে হলেও পরিশ্রম আবশ্যক। কিন্তু পরিশ্রম যতোটা দরকার, তার চাইতে বেশি দরকার ভাষাপ্রীতি এবং ভাষা-শিখনের সদিচ্ছা। সেক্ষেত্রে পরিশ্রমের মাত্রা কমে যাবে বহুলাংশে। ইংরেজি বানানের আর উচ্চারণের বৈপরীত্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে যুক্তিহীনতার প্রসঙ্গটি গুণিন-বিদিত।

বাংলা ভাষার নিন্দুকেরা অবশ্য বাংলা ভাষাতেও বানানে-উচ্চারণে এরূপ বৈপরীত্য লক্ষ্য করে প্রায়শই অনেক বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলেন। বিজ্ঞের মতো তাঁরা বলে ফেলেন পদ্মা, গ্রীষ্ম, অশ্ম, আত্মা, ইত্যাদি বানানে ‘ম’ এর স্থলে যথাক্রমে দুটো করে ‘দ’, ‘ষ’, ‘শ’, ‘ত’ ব্যবহার করাই যেতো। ‘বিজ্ঞ’ শব্দের যথাযথ উচ্চারণ ‘বিগ্গঁ’। কিন্তু তথাকথিত ঐ সব বিজ্ঞভাষাবিদ (!) নিজেদের উচ্চারণ-দারিদ্র্য ঘুচাবার জন্যে কিংবা জানবার আগ্রহহীনতার কারণে ‘বিজ্ঞ’ শব্দটিকে শুদ্ধ করে ‘বিগ্গ’ লেখবার পক্ষে। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- পদ্মা, গ্রীষ্ম, অশ্ম এবং আত্মা উচ্চারণে অর্থাৎ শব্দগুলোতে ব্যবহৃত ‘ম’ নাসিক্য ধ্বনি বিধায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নাসিক্য চিহ্ন চন্দ্রবিন্দু ( ঁ) ব্যবহৃত হয়েছে। উল্লিখিত শব্দগুলোর প্রকৃত উচ্চারণ যথাক্রমে পদ্দাঁ, গ্রিশ্শোঁ, অশ্শোঁ এবং আত্তাঁ। দু-চার ক্ষেত্রে বানানে-উচ্চারণে বৈপরীত্য কিন্তু বাংলা ভাষাতেও আছে। এ তত্ত্ব ঐসব বিজ্ঞ পণ্ডিতের হাতে আছে কিনা জানি না। তারা এ ব্যাপারে শীঘ্রই কিছু বলবেন বলে আশা রাখছি।
যতটা ভক্তি নিয়ে এবং নিবেদিতপ্রাণ হয়ে আমরা বিদেশি শব্দ শিক্ষা করি, আমি শতভাগ নিশ্চিত, বাংলা ভাষার প্রতি তার চাইতেও তুলনামূলকভাবে কম ভক্তি প্রদর্শন করেও ততোধিক শুদ্ধ বাংলা শেখা সম্ভব। তাই, আসুন আমরা ‘স্বদেশি ঠাকুর’ ফেলে দিয়ে ‘বিদেশি কুকুরের’ আরাধনা বাদ দিতে না পারি, অন্তত ‘স্বদেশি ঠাকুর’কে ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রদর্শনের জায়গা থেকে সরে আসি।
আসুন, আমরা সকলেই সত্যিকার অর্থেই বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি। যে ভাষার জন্যে ভাষাসংগ্রামীরা জীবন দিয়েছেন, তাদের আত্মাকে আমরা যেন অপমান করবার চেষ্টা না করি। বিদেশি ভাষা শেখা অবশ্যই গুণনীয় কাজ। এবং তার দরকারও আছে। তাই বলে বাংলাকে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ভাষা বানিয়ে নয়। আজ থেকেই আমাদের বিশ্বের সকল বাংলাভাষীর প্রথম ভাষা হোক আমাদের প্রিয়তমা মাতৃভাষা ‘বাংলা’।

লেখক:  সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর