চিত্রকর্ম Kujta Makolli

চিত্রকর্ম Kujta Makolli

লাগামের বাইরে

অমিতাভ পাল

প্রকাশিত : মার্চ ০৭, ২০১৮

মনের বিভিন্ন অবস্থায় যেকোনো সাধারণ বাক্য তার চেহারা পাল্টায়। রেগে যাওয়া মানুষ আর ভয় পাওয়া মানুষ একই বাক্য একভাবে বলে না। আর বলে না বলেই বাক্যটাও একইরকম থাকে না। কবিতাতেও যেকোনো বিষয় অবস্থা, পরিপ্রেক্ষিত এবং প্রসঙ্গ অনুযায়ী বিভিন্ন হয়ে যায়। এটা যেমন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হয়, তেমনি বিষয়টির ভিতরের চূড়ান্ত বাস্তবতা প্রকাশের প্রয়োজনে কবিকেও বের করে আনতে হয় বিষয়টির মনের অবস্থার খবর। আর সেটাই বলে দেয় বিষয়টিকে কিভাবে ঊপস্থাপন করতে হবে। এই উপস্থাপন ভঙ্গিই কবিতার ভাষা।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে দেশি শব্দ, বিদেশি পরিভাষা কিংবা মুখের ভাষা ব্যবহারের বিভিন্ন আন্দোলনের অর্থ কি? খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। আর এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ভাষা ব্যবহারের রীতি, পদ্ধতি ও নিয়মের বৈজ্ঞানিক কারণগুলিকে স্পষ্ট করে বুঝে তারপর নামতে হবে উত্তরের খোঁজে। যদি আপনার ধৈর্য, সময় ও কৌতূহল থাকে তাহলে আমার সঙ্গে নেমে পড়তে পারেন এবারের অভিযানে। যাত্রার একেবারে শুরুতে চলুন দেখে নেয়া যাক প্রথমে যেমন বলেছিলাম, মনের বিভিন্ন অবস্থায় বাক্যের বদল কিভাবে হয় এবং কেন হয়, সেটা বুঝে নেয়ার চেষ্টা করি।

ভাষা আসলে নিরেট এবং জড়। পাহাড়, নদী ও পাথরের মতো সে পড়ে থাকে, যতক্ষণ না কোনো মন বা ভাবনা তাকে অনুবাদ করে। আর সেই অনুবাদের মাধ্যমেই ভাষা পেয়ে যায় উপস্থাপনের যোগ্য পোশাক। সেই পোশাকে আঁকা থাকে অনুবাদক মন তৈরি হয়েছে যে মানুষটির ভিতরে, তার ছবি। কথাটাকে আরো প্রাঞ্জল করতে চাইলে বলতে পারি, মনের ধারক মানুষটির সামাজিক, দেশীয় ও সময় নির্দেশিত যে রুচি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, সেটাই ভাষাটিরও পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলেই ভাষা একটা দেশের তো হয়ই, একটা অঞ্চলের,  এলাকার এমনকি একটা নির্দিষ্ট জনপদেরও হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশ ভাষার এই গঠনজনিত কার্যকারণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটা উদাহরণ। এ দেশে একই ভাষা অসংখ্য বিভিন্ন চেহারায় প্রকাশিত হয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, মানুষের সাংস্কৃতিক আচরণ ভাষা গঠনে কতটা অপরিহার্য।

যেকোনো ভাষাতেই মূল শব্দগুলি তৈরি হয় বিভিন্ন কাজকে বর্ণনা করার প্রয়োজনে। এটা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় প্রাচীন ভাষাগুলিকে বিশ্লেষণ করলে। এসব ভাষার যখন জন্ম হয়েছিল, সেসময় মানুষের সামনে ছিল অজানা এক বিরাট পৃথিবীর বিপুল জগৎ। এর প্রতি পদেই রহস্য, রোমাঞ্চ আর এগিয়ে যাবার হাতছানি। আর মানুষের মনে ছিল সাহস। সেই সাহসের ওপর ভর করে অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মানুষ তার এগিয়ে যাবার পথ তৈরি করেছে নিজের কর্মনিষ্ঠা দিয়ে। সেই কর্মনিষ্ঠায় সে বের করতে চেয়েছে বস্তুসমূহকে কাজে লাগানোর উপায়। তাই সংস্কৃত ভাষায় আমরা দেখি একই সূর্যের অনেকগুলি নাম, যাদের অর্থ খুঁজলে দেখা যায়, বিভিন্ন কাজের কারণেই এসব নামে ডাকা হতো তাকে। সংস্কৃত ভাষা এক অদ্ভুত ডিটেইলে ভরা ভাষা। এ ভাষায় মেয়েরাও বহু নামে উজ্জ্বল। বহু ক্রিয়া তাদের দিয়েছে বহু পরিচিতি। আর এ পরিচিতিগুলির প্রত্যেকটা সেই সময়ের মানুষের সাংস্কৃতিক ব্যাসার্ধের সমানুপাতিক। অর্থাৎ মানুষ তখন যা কিছু করতো, তার ভিত্তিতেই তৈরি হতো সেইসব শব্দ। ভাগ্যিস হতো! তা নইলে সব শব্দ তৈরি হয়ে গেলে আমরা আর আমাদের সময়ের শব্দগুলি তৈরি করতাম কি করে?

অর্থাৎ ভাষার একটা খুব পারপাসিভ ভূমিকা আছে মানুষের জীবনে। যেন একটা টুলবক্স, যে ইঞ্জিনই আসুক তার কারখানায়, সে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারবে তার উপাঙ্গসমূহ ব্যবহার করে। অনেকটা ম্যাকগাইভারের ওই সুইস নাইফটার মতোই যেন। আর পিছনে তো আছেই মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষুরধার উপস্থিতি, ফলে আর ভয় কি? ভাষা তৈরির এই প্রক্রিয়া প্রাচীন নদীগুলির মতো এখনো সচল। শুধু সচলই না বরং আরো উন্নত, আরো যথার্থ। এ প্রক্রিয়াতেই মিশে আছে মনের বিভিন্ন অবস্থায় ভাষা অনুবাদের প্রাচীনতম সমীকরণ। এ সমীকরণ মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের মতো, নির্দিষ্ট অবস্থায় জি এর মান সর্বদাই ধ্রুব। তবে এ সমীকরণ শুধু মিশেই নেই প্রক্রিয়ার সাথে, ছড়িয়ে পড়েছে মানববসতির কোণায় কোণায়। ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতিমূহূর্তে। ভাষা তাই অজস্র রূপে এতে রূপবান। আর রূপ মানেই তো ধারালো, ব্যবহারযোগ্যতায় ভাষাও তাই ধারালো হয়ে উঠেছে সেই দা`এর মতো। প্রতিদিন শ্রমিকের কর্মশক্তি যাকে এগিয়ে দেয় প্রতিটি দৈনন্দিন কাজে।

প্রতিটি যন্ত্রের মতো ব্যবহৃত হওয়াই ভাষারও নিয়তি। আর ব্যবহৃত না হলে সে লুপ্ত হবে, পড়ে থাকবে ধূলায়। আর সেটা যেন না হয়, সেদিকে সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখে কবি। কবিই ভাষার অস্ত্রে সজ্জিত দিনানুদিনের কামলাখাটা শ্রমিক। সে একদিন কাজ না পেলে ঘরে তার খাবার তো জুটবেই না, কাজের অস্ত্র ভাষাটাও যাবে জীর্ণ হয়ে। তখন তাকে শান পাথরে ঘষে জীবিত রাখতে হবে এ অস্ত্রের ধার। নইলে যে পরের দিন কাজ করতে গিয়ে বারবার বিঘ্ন ঘটবে। ভাষার অস্ত্রে এ শান দেয়াটাই বোধহয় কবির সাধনা। কেননা বিষয় তো যেকোনো কিছুই, ছুতারের হাতে পড়া একটা কাঠের টুকরার মতো। কবির ভাষা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠিন প্রতিবাদ। কেননা রাজকীয় ভাষার শরীরেও সে এঁকে দিতে পারে অত্যন্ত স্থানীয় একটি শব্দের নকশা। আর এটা সে করে বোধগম্যতার কাছে দায়বদ্ধতার কারণে। পৃথিবীতে এমন কোনো কবি নেই, যে চায় না তার কবিতা পৌঁছাক সকল হৃদয়ের অতলে। এক্ষেত্রে কবিরা কম্পিউটার ব্যবসায়ীদের মতোই। এসব ব্যবসায়ীরা জানে, তাদের কম্পিউটার ব্যবহার করার কৌশল যদি জটিল হয়, তাহলে তাদের উৎপাদিত লাখ লাখ কম্পিউটার অবিক্রিত থেকে যাবে। যেকোনো যন্ত্রের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। পৃথিবীতে এমন কোনো সময়ের এমন কোনো কবিতা নেই যা জনতার বোধগম্যতার বাইরে। যদি এমন কোনো কবিতা কখনো মেলেও, বুঝে নিতে হবে পাঠকের মনযোগ সেসময় ছিল অন্য কোথাও নিবিষ্ট বা অতীত আচ্ছন্নতায় মুগ্ধ। নইলে বুঝতে চাইলে বুঝতে পারে না কে?

মানুষ ভাষা তৈরিই করেছে বোধগম্যতাকে আরো বেশি করে ধরাছোঁয়ার মধ্যে আনতে। অভিজ্ঞতা, অনুভূতি আর যাবতীয় আত্মকে ভাষা দিয়েই সে স্পষ্ট করতে চায়। তার এ ইচ্ছার সবচেয়ে বেশি প্রকাশ ঘটে কবিতায়। মানুষ যেদিন বুঝেছে সে আসলে একটা সমষ্টির অংশ এবং একই সঙ্গে বিশেষ, সেদিন থেকেই কবিতার ওপর অর্পিত হয়েছে ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে যোগাযোগের দায়িত্ব। আর এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভাষাকে আরো বেশি পারপাসিভ, আরো বেশি দুমড়ে মুচড়ে নেয়ার কাজটা প্রতিদিন করছে কবিতা। এতে ভাষা হচ্ছে নমনীয়, সাবলীল এবং ব্যবহারের পক্ষে সহজ। আমি বলতে চাই এবং তোমাকে শোনাতে চাই, এই আকুল আকাঙ্ক্ষাই আসলে ভাষার প্রাণ। আর এ আকাঙ্ক্ষা পূরণে যা কিছু দরকার, তাই-ই করতে প্রস্তুত কবি। তাকে লাগাম পরাবে কে?