সিনেমা হল বাঁচাও আন্দোলন ও কিছু কথা

বেলায়াত হোসেন মামুন

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৩, ২০১৮

সিনেমা হল বাঁচাও আন্দোলনে আমি কখনও খুব আগ্রহবোধ করিনি। তারেক ভাই (তারেক মাসুদ) যখন `রানওয়ে` প্রদর্শনীর পাশাপাশি সিনেমা হল বাঁচানোর জন্য ডকুমেন্টেশন করছিলেন, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সিনেমা হল রক্ষার জন্য সুপারিশ করছিলেন, তখনও এই বিষয়ে আমি সন্দেহাতীতভাবে একমত ছিলাম না। তবে তারেক ভাইয়ের সিনেমা হল বন্ধ হওয়া নিয়ে দুঃশ্চিন্তার কারণ অনুভব করতে পারতাম।

এমনিতে জঙ্গি তৎপরতার প্রথম টার্গেট ছিল, যাত্রা ধ্বংস করা। এরপর সিনেমা হলে ওরা আক্রমণ করে। যাত্রা বা সিনেমা ইসলামি চরমপন্থি লোকজনের জন্য অশান্তির বিষয়। যে কারণে ইসলামি চরমপন্থি লোকজন চলচ্চিত্রকে পছন্দ করে না, ঠিক সেই একই কারণে চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির জারি থাকা জরুরি, এ খুব সহজ অঙ্ক।

কিন্তু সিনেমা হল কেন্দ্রিক কোনো সাংস্কৃতিক তৎপরতা কখনো হয়েছে বলে শুনিনি। দেখিওনি। বিশেষত বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলো একেবারেই ব্যবসাপ্রবণ। শতকরা ৯৯ ভাগ সিনেমা হল মালিক ব্যবসা করার জন্যই সিনেমা হল বসিয়েছে। ব্যবসা যখন ভালো ছিল তখন সিনেমা হল টিকিয়ে রেখেছে। ১০-১২ বছর সিনেমার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না বলে সিনেমা হল তুলে শপিং কমপ্লেক্স দিচ্ছে। ওদের কাছে গিয়ে যতই আব্দার করা হোক না কেন, তাতে ওরা ওদের সিদ্ধান্ত বদলাবে না।

আমরা চলচ্চিত্র ভালোবাসি। তাই সিনেমাহল বন্ধের খবরে মন খারাপ হয়। কিন্তু আমরা যে ধরনের চলচ্চিত্র দেখতে ভালোবাসি তা কি এসব সিনেমা হল কখনও চালায়? না চালায় না। চালাতে চেষ্টা করেও অনেকে ব্যর্থ হয়েছে মালিকপক্ষের অসহযোগিতায়। কখনো সিনেমা হলের মালিক ভালো চলচ্চিত্র চালাতে দেয়নি। কখনো সিনেমা হল ব্যবসায়ীদের সমিতি যাদের `চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি` বলা হয়, তারা চালাতে দেয়নি।

চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মাফিয়াতন্ত্রের মূল প্রতিষ্ঠান। ওরাই ভালো চলচ্চিত্রকে সবসময় বাধা দিয়েছে। আজ চলচ্চিত্রের ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে বলে ওদের দুর্বল ভাবার কোনো কারণ নেই। ওরা আজও একজন ভিন্নধরনের চলচ্চিত্রের নির্মাতার পাশে এসে দাঁড়াবে না। তাহলে চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীর জন্য আমাদের সামাজিক আন্দোলনের কারণ কি?

কারণ হয়তো এই যে, চলচ্চিত্র বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সাংস্কৃতিক তৎপরতা। আর তা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে এমন পরিস্থিতি দেখাটা দুঃখজনক। আর তাছাড়া সিনেমা হল বন্ধে লাভ হচ্ছে ইসলামি চরমপন্থি লোকজনের। ওরা বোমা হামলা করে সিনেমা হল বন্ধ করতে চেয়েছে। দুঃখজনক বিষয় এটাই যে, আজ আর সিনেমা হল বন্ধের জন্য বোমা মারতে হচ্ছে না। ব্যবসা না থাকায় ব্যবসায়ীরা তাদের দোকান (সিনেমাহল) নিজেরাই বন্ধ করে দিচ্ছে।

এতে সরকারের এবং রাষ্ট্রের মাথাব্যথা থাকা দরকার। চলচ্চিত্র-সংসদকর্মীদের দায় ওই টুকুই যে, তারা সরকারকে বলবে যে, সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেলে কী ধরনের সাংস্কৃতিক বিপর্যয় আসবে। কিন্তু এর বেশি কিছু করার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ আন্দোলন করে যে সিনেমা হল বাঁচাতে চেষ্টা করবে চলচ্চিত্র সংসদকর্মীরা সেখানে কখনো চলচ্চিত্র সংসদকর্মীদের পছন্দের সিনেমা চলবে না। সেখানে চলবে বাজার গরম করা চলচ্চিত্র। মননকে জাগ্রত করার চলচ্চিত্র সেখানে ঢুকতে পারবে না।

তাই চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীদের উচিত, জাতীয় এবং আঞ্চলিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে তৎপর হওয়া। কারণ চলচ্চিত্রের চর্চা করতে হলে জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে চলচ্চিত্র কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। এ দাবিতে সরকারের হুঁশ ফেরাতে পারলে তা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য স্থায়ী উপকারের কারণ হবে। আর সিনেমা হল ব্যবসায়ীদের আপাতত সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। সিনেমা ব্যবসা যখন ঘুরে দাঁড়াবে তখন রাতারাতি বহু সিনেমা হল কচুরিপানার মতো জন্মাতে থাকবে। ও নিয়ে অত দুঃশ্চিন্তার কারণ নেই।

লেখক: চলচ্চিত্র সংসদকর্মী