হাজির!

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু

প্রকাশিত : এপ্রিল ০১, ২০১৮

হঠাৎ চিৎকার করিয়া কেহ উত্তর দিল, ‘হাজির।’ কাহাকেও ডাকিতে শুনি নাই, তথাপি অতি করুণ ও ভক্তি উচ্ছ্বসিত স্বরে উত্তর শুনিলাম, ‘কি আজ্ঞা প্রভু?’ কে তোমার প্রভু, কাহার হুকুমে এরূপ উদ্দীপ্ত হইলে?

কী আশ্চর্য! একটি কথাতেই জীবনের সমস্ত স্তরগুলি আলোড়িত হইল। সুপ্তস্মৃতি আজ জাগরিত- যাহা অশব্দ, আজ তাহা শব্দায়মান; যাহা বুদ্ধির অগম্য ছিল, আজ তাহা অর্থযুক্ত হইল।

এখন বুঝিতে পারিতেছি, বাহির ছাড়া ভিতর হইতেও হুকুম আসিয়া থাকে। মনে করিতাম, আমার ইচ্ছাতেই সব হইয়াছে। আমি কি এক? একটু মন স্থির করিলেই দুই-এর মধ্যে যে সর্বদা কথা চলিতেছে তাহা শুনিতে পাই। ইহারাই আমাকে চালাইতেছে। ইহাদের মধ্যে কু-মতি আমি, সু-মতি তবে কে?

এ সম্বন্ধে ২৭ বৎসর পূর্বের কয়েকটি ঘটনা মনে পড়িতেছে। কোনোদিনও লিখিতে শিখি নাই, কিন্তু ভিতর হইতে কে যেন আমাকে লিখাইতে আরম্ভ করিল। তাহারই আজ্ঞায় ‘আকাশ স্পন্দন ও অদৃশ্য আলোক’ বিষয়ে লিখিলাম। পরে লিখাইল, ‘উদ্ভিদজীবন মানবীয় জীবনেরই ছায়ামাত্র’। জীবন সম্বন্ধে বেশি কিছুই জানিতাম না। কাহার আদেশে এরূপ লিখিলাম? লিখিয়াও নিষ্কৃতি পাইলাম না; ভিতর হইতে কে সমালোচক সাজিয়া বলিতে লাগিল, ‘এত যে কথা রচনা করিলে, পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছো কি- ইহার কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা? জবাব দিলাম, ‘যে সব বিষয় অনুসন্ধান করিতে গিয়া বড় বড় পণ্ডিতেরা পরাস্ত হইয়াছেন, আমি সেইসব কী করিয়া নির্ণয় করিব? তাহাদের অসংখ্য কলকারখানা ও পরীক্ষাগার আছে, এখানে তাহার কিছুই নাই; অসম্ভবকে কি করিয়া সম্ভব করিব?’ ইহাতেও সমালোচকের কথা থামির না। অগত্যা ছুতার কামার দিয়া তিন মাসের মধ্যে একটা কল প্রস্তুত করিলাম। তাহা দিয়া যেসব অদ্ভুত তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইল তাহা আমার কথা দূরে থাকুক, বিদেশি বৈজ্ঞানিকদিগকে পর্যন্ত বিস্মিত করিল।

অল্পদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে অনেক সুখ্যাতি হইল এবং বিলাতের সম্বর্ধনা সভায় নিমন্ত্রিত হইলাম। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক উইলিয়াম রামসে বহু সাধুবাদ করিরেন; পরে বলিলেন, ‘কাহারও কাহারও মনে হইতে পারে যে, এখন হইতে ভারতে নূতন জ্ঞানযুগ আরম্ভ হইল; কিন্তু একটি কোকিলের ধ্বনিতে বসন্তের আগমন মনে করা যুক্তিসঙ্গত নহে।’ সেদিন বোধহয় আমার ওপর কুমতিরই প্রাদুর্ভাব হইয়া থাকিবে, কারণ স্পর্ধার সহিত উত্তর দিয়াছিলাম। বলিয়াছিলাম, আপনাদের আশঙ্কা করিবার কোনও কারণ নাই, আমি নিশ্চয় বলিতেছি, শীঘ্রই ভারতের বিজ্ঞান ক্ষেত্রে শত কোকিল বসন্তের আবির্ভাব ঘোষণা করিবে।’ এখন সেদিন আসিয়াছে; যাহা কুমতি বলিয়া ভয় করিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি তাহাই সুমতি। তখনকার শুভ লগ্ন পাঁচ বৎসর পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। একদিনের পর আর একদিন অধিকতর উজ্জ্বল হইতে লাগিল এবং সম্মুখের সমস্ত পথগুলিই খুলিয়া গেল।

এমন সময় যে হুকুম আসিল তাহাতে সোজা পথ ছাড়িয়া দুর্গম অনির্দিষ্ট পথ প্রগণ করিতে হইল। তখন তারহীন যন্ত্র লইয়া পরীক্ষা করিতেছিলাম। দেখিতে পাইয়াছিলাম, কলের সাড়া প্রথম প্রথম বৃহৎ হইত, তাহার পর ক্ষীণ হইয়া লুপ্ত হইয়া যাইত। বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে লিখিয়াছিলাম, দিবারম্ভেই পরীক্ষা শ্রেয়; কারণ সারাদিন পরীক্ষার পর কল ক্লান্ত হইয়া যায়। অমনি ভিতরকার সমালোচক বলিয়া উঠিল, ‘কল কি মানুষ, যে ক্লান্ত হইবে?’

কল কেন ক্লান্ত হয়? এই প্রশ্ন কিছুতেই এড়াইতে পারিলাম না। অনেকগুলি আবিষ্কার কেবল লিখিবার অপেক্ষায় ছিল। সেসব ছাড়িয়া দিয়া নূতন প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করিতে হইল। ক্রমে দেখিতে পাইলাম, জীবনহীন ধাতুও উত্তেজিত এবং অবসাদগ্রস্ত হয়। উত্তেজনা স্থগিত রাখিলে স্বল্পাধিককালে ক্লান্তি দূর হয়। উদ্ভিদে এইসব প্রক্রিয়া অধিকতররূপে পরিস্ফুট দেখিলাম। এইরূপে বহুর মধ্যে একত্বের সন্ধান পাইয়াছিলাম।

জীবতত্ত্ববিদের হস্তে এইসব নূতন তত্ত্ব রাখিয়া পদার্থবিদ্যা বিষয়ে অনুসন্ধান করিবার জন্য ফিরিয়া আসিব, মনে করিয়াছিলাম; কিন্তু হিতে বিপরীত হইল। রয়্যাল সোসাইটিতে সব পরীক্ষা দেখাইয়াছিলাম। সর্বপ্রধান জীবতত্ত্ববিদ বার্ডন সেন্ডারসন বলিলেন, ‘জীবনতত্ত্ব বিষয়ে আপনি যে পরীক্ষা করিয়াছেন সে সম্বন্ধে আমাদের চেষ্টা পূর্বে নিষ্ফল হইয়াছে; সুতরাং আপনার কথা অসম্ভব ও অগ্রাহ্য। এ শাস্ত্রে আপনার অনধিকার চর্চা হইয়াছে। আপনি পদার্থবিদ্যায় যশস্বী হইয়াছেন, আপনার সম্মুখে প্রশস্ত পথে বহু কৃতিত্ব রহিয়াছে, আপনার অজ্ঞাত পথ হইতে নিবৃত্ত হউন।’ তখন কুমতির প্ররোচনায় বলিলাম, নিবৃত্ত হইব না, এই বন্ধুর পথই আমার। আজ হইতে সোজা পথ ছাড়িলাম। আজ যাহা প্রত্যাখ্যাত হইল তাহাই সত্য। ইচ্ছায়ই হউক অনিচ্ছায়ই হউক, তাহা সকলকে গ্রহণ করিতেই হইবে।

এই দুর্মতির ফল ফলিতে অধিক বিলম্ব হইল না। সবদিকের পথ একেবারে বন্ধ হইয়া গেল এবং সমস্ত আলো যেন অকস্মাৎ নিভিয়া গেল। কিন্তু ইহার পর হইতেই অন্তরের ক্ষীণ আলো অধিকতর পরিস্ফুট হইতে লাগিল। প্রখর আলোকে যাহা দেখিতে পাই নাই, এখন তাহা দেখিতে পাইলাম। আশা ও নিরাশার অতীত, এভাবে বিশ বছর কাটিল।

এক বছর পূর্বে হঠাৎ যেন নির্দেশ শুনিতে পাইলাম, ‘বিদেশ যাও।’ বিদেশ যাত্রা! সেখানে কে আমার কথা শুনিবে? এবার কঠিন স্বর শুনিলাম, ‘আমার নাম হুকুম, তোমার নাম তামিল! লাভালাভ বলিবার তুমি কে?’ আজ্ঞা শিরোধার্য করিয়া লইলাম।

তারপর সমস্ত দিকের রুদ্ধ দ্বার একেবারে খুলিয়া গেল। কাহার হুকুমে এরূপ হইল? একি স্বপ্ন? বিরোধী যাহারা ছিলেন, এখন তাহারাই পরম মিত্র হইলেন। যাহা প্রত্যাখ্যাত হইয়াছিল, এখন তাহা সর্বত্র গৃহীত হইল। বিশ বৎসর আগে যাহা কুমতি মনে করিয়াছিলাম, পুনরায় দেখিতে পাইলাম, তাহাই সুমতি।

সুতরাং কোনটা সুমতি আর কোনটা কুমতি, জানি না। কোনটা বড় আর কোনটা ছোট, তাহা মন বোঝে না। সুদিনের বৃহৎ সফলতা ভুলিয়া দুর্দিনের বিফলতার কথাই মনে পড়িতেছে। তখন সর্বত্রই পরিত্যক্ত হইয়াছিলাম, কেবল দু’একজনের অহেতুক স্নেহ আমাকে আগলাইয়া রাখিয়াছিল। আজ তাহারা অন্ধকার যবনিকার পরপারে। অস্ফুট ক্রন্দন কি সেথায় পৌঁছিয়া থাকে?

জীবনের যখন পূর্ণশক্তি তখন কোলাহলের মধ্যে তোমার নির্দেশ স্পষ্ট করিয়া শুনিতে পারিতাম না। এখন পারিতেছি; কিন্তু সব শক্তি নির্জীব হইয়া আসিতেছে। একদিন তোমার হুকুমে মাঝখানের যবনিকা ছিন্ন হইবে, মৃত্তিকা দিয়া যাহা গড়িয়াছিলে তাহা ধূলি হইয়া পড়িয়া রহিবে। কি লইয়া তখন সে তোমার নিকট উপস্থিত হইবে? কী লইয়া তখন সে তোমার নিকট উপস্থিত হইবে? অল্পই তাহার সুকৃতি, অসংখ্য তাহার দুষ্কৃতি। তবে বলিবার কি আছে? কোনটা সুমতি আর কোনটা দুর্মতি, এই ধান্ধাতেই জীবন কাটিয়াছে। সাফাই করিবার কথা যখন কিছুই নাই তখন তোমার পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত সে কেবল বলিবে, ‘আসামী হাজির!’

লেখকের ‘অব্যক্ত’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো