জাতির উত্থান ও পতন

পুনর্মুদ্রণ

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৯

সকলেই বলেন, জাতির উন্নতির জন্য চাই শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য ও সামরিক শক্তি। কথাটা সত্য, কিন্তু এটা কি ষোলো আনা সত্য? প্রাচীন মিশর, আসিরিয়া, মোহেনজোদাড়ো, গ্রীস ও রোমে এর সবই ছিল। কিন্তু কোথায় আজ তাহারা? কেন তাহারা ধ্বংস হইল? সূরা হজ্জের ৪৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলিতেছেন—

“কত না নগরকে আমি ধ্বংস করেছি। তারা ছিল অত্যাচারী। এরপর সেসব ছাদসহ ভূমিসাৎ হয়েছে। কত না আছে পরিত্যক্ত কূপ আর কত না উচ্চ দুর্গ।”

সুখসমৃদ্ধশালী সবা নগরের ধ্বংস বর্ণনা করিয়া সূরা সবা’র ১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “তারা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছিল। এরপর আমি তাদেরকে কাহিনি করেছি এবং তাদেরকে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছি।”

উন্নতির সমস্ত জাগতিক কারণের সঙ্গে যদি আধ্যাত্মিক কারণ না থাকে, তবে সে উন্নতি কখনো স্থায়ী হইতে পারে না। একটি নধর সবুজ গাছের যদি মূল শিকড় কাটিয়া দেওয়া যায়, গাছ কয়েক ঘণ্টা বা দিন বাঁচিয়া থাকিতে পারে। তারপর কিন্তু সে শুকাইয়া মাটিতে পড়িয়া যায়। জাগতিক উন্নতিও এইরূপ।

সূরা নহলের ১০২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ একটি নগরের দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। সে ছিল নিরাপদ ও নিরুদ্বেগ, সকল স্থান থেকে তার জন্য উপজীবিকা আসত। এরপর নগরবাসীরা আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি অকৃতজ্ঞ হলো। ফলে তিনি তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে ক্ষুধা ও ভয়ের পোশাক পরিয়ে মজা চাখালেন।”

ধারাবাহিক দুষ্কর্মের ফলে যে জাতির নানা দুঃখকষ্ট ঘটে, তা নিচে উদ্ধৃত প্রামাণ্য হাদিস হইতে ষ্পষ্ট বোঝা যায়—

“কোনো জাতির মধ্যে যখনই সরকারি মালের খেয়ানত হতে থাকে, অবশ্যই তাদের অন্তরে শত্রুর ভয় ঢুকে যায়। যখনই কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ে, অবশ্যই তাদের মধ্যে মৃত্যুসংখ্যা বেড়ে যায়। যখনই কোনো জাতি মাপ ও ওজন কম দিতে থাকে, তাদের জীবিকা কম হয়ে যায়। যখনই কোনো জাতি অন্যায়ভাবে বিচার করে থাকে, তাদরে মধ্যে হতাকাণ্ড বেড়ে যায়। যখনই কোনো জাতি অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে থাকে, তাদের ওপর শত্রু প্রবল হয়।” (হযরত ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত ইমাম মালিকের মুআত্তা)

কমিউনিস্টদের ন্যায় নাস্তিক ও পাপাচারী জাতিদের সাময়িক উন্নতি দেখিয়া কেহ কেহ হয়তো মনে করে যে, ধর্মের আবার প্রয়োজন কি? যদি আল্লাহ থাকেন তবে ইহাদের শাস্তি হয় না কেন? ইহার জবাবে সূরা আরাফের ৯৪-৯৬ আয়াতে আল্লাহ বলেন, “কোনো জনপদে যখন আমি নবি পাঠাই তখন তার অধিবাসীদেরকে দুঃখ ও কষ্ট দ্বারা আক্রান্ত করি, যেন তারা বিনত হয়। এরপর (তাদের অবাধ্যতা সত্ত্বেও) আমি অকল্যাণের পরিবর্তে কল্যাণ দান করি, এমনকি তারা সমৃদ্ধি লাভ করে। তখন তারা বলে, আমাদের বাপ-দাদাদেরকেও তো কষ্ট ও সুখ স্পর্শ করেছিল। তখন আমি হঠাৎ তাদেরকে এমনভাবে পাকড়াও করি যে, তারা জানতেও পারে না। আহা, যদি জনপদের অধিবাসীরা ধর্মবিশ্বাসী হতো এবং ধর্মভীরু হতো, তবে নিশ্চয়ই আমি তাদের জন্য আসমান-জমিনের সমস্ত মঙ্গল উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা (ধর্মকে) মিথ্যা বলেছিল। ফলে তাদের অর্জিত কর্মের জন্য আমি তাদেরকে আক্রমণ করেছিলাম।”

এই সমস্ত সভ্যতাগর্বিত উদ্ধত পাপাচারী জাতিকে খবরদার করিয়া সূরা আরাফের ৯৭-৯৯ আয়াতে আল্লাহ বলিতেছেন—

“কী! জনপদবাসীরা নির্ভয় হয়েছে যে, আমার শাস্তি রাত্রিকালে, যখন তারা নিদ্রিত, তাদের কাছে পৌঁছাবে না? কী! জনপদবাসীরা নির্ভয় হয়েছে যে, আমার শাস্তি প্রাতঃকালে যখন তারা খেলাধূলায় রত, তাদের কাছে পৌঁছাবে না? কী! তারা আল্লাহর চক্রান্ত হতে নির্ভয় হয়েছে? এরপর যে জাতি বিনাশ পাবে তারা ছাড়া কেউই আল্লাহর চক্রান্ত হতে নির্ভয় হয় না।”

গত মহাযুদ্ধে জার্মানি, ইতালি ও জাপানের আকস্মিক পতন মহাকোরআনের বাণীর সত্যতা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপন্ন করিয়াছে। নূতন পাকিস্তানি জাতির ইহাতে শিখিবার ও ভাবিবার অনেক কথা আছে। আল্লাহ মুসলমান জাতিকে সূরা ইউনূসের ১৩-১৪ নম্বর আয়াতে বলিতেছেন—

“নিশ্চয়ই তোমাদের আগে বহু যুগের লোককে আমি ধ্বংস করেছি, যখন তারা অত্যাচারী হয়েছিল এবং তাদের প্রেরিতপুরুষ (রাসূল) স্পষ্ট প্রমাণসহ তাদের কাছে এসেছিল, কিন্তু তারা বিশ্বাসী হওয়ার পাত্র ছিল না। এরপর তাদের শেষে আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছি, যেন আমি দেখি তোমরা কেমন আচরণ করো।”

লেখকের ‘ইসলাম প্রসঙ্গ’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো