সোনাগাছির মেয়েরা

সোনাগাছির মেয়েরা

বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ

পর্ব ১৮

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৮, ২০১৯

১৩.
বিনয় মজুমদারের অসুস্থতাকে তরুণ কবি-লেখকরা অনেকেই রোমান্টিসাইজ করার প্রয়াস করেছেন— তা একজন মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে ছেলেখেলা। কলকাতায় বসবাস করে দূরত্ব বজায় রেখে বিনয়ের অসুস্থতার নান্দনিকতা গড়ে তুলতে চেয়েছেন তারা, যেন তারা বিনয়ের কবিতার উদ্ধারকারী। কবি কিন্তু তার পারক্যবোধকে সযত্নে আগলে রাখতেন, এবং অতিথি গুণমুগ্ধদের ভাবপ্রবণ আচরণকে প্রকৃতি-পৃথিবীর অত্যন্ত জটিল ব্যাখ্যার মাধ্যমে সীমায়িত করে দিতেন। বিনয়ের চরিত্রে ছিল অদম্য বলিষ্ঠতা। তাই তিনি নিজে যে ধরনের কবিতা ও গদ্য লিখবেন বলে মনস্থ করতেন, তাই লিখতেন। তাঁর ‘ধূসর জীবনানন্দ’ পড়লে বোঝা যায় তিনি ভাবনাকে কোন পথে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন। কবিতায় দিনপঞ্জির অনুপ্রবেশ ঘটনোর মাধ্যমে তিনি নিজের জীবনচর্যা রেকর্ড করেছেন এবং এগিয়ে গেছেন। যেমনটা দিনপঞ্জি লেখকেরা করে থাকেন, আগের দিনের ঘটনাকে পেছনে ফেলে আসেন। কবিতা লেখা হয় ভাষার মাধ্যমে, এবং ভাষা চিরকাল সময়বন্দি। পরবর্তীকালে গিয়ে তা আটকে যায়, যেমন চর্যপদের ক্ষেত্রে ঘটেছে, সময়ের দ্বারা তা সীমায়িত। প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা করেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন কাল্ট ফিগার, আর নিজের দুরাবস্থাকে উপস্থাপন করে সেই প্রতিষ্ঠানকে হাস্যকর ও অপ্রয়োজনীয় প্রতিপন্ন করে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত ব্যথা তিনি তাঁর কবিতাকেই অবিরাম জানিয়ে গেছেন, ‘ফিরে এসো, চাকা’ বইয়ের কবিতাগুলোর সময় থেকে। তাঁর একটি কবিতার শিরোনাম ‘আমরা সর্বাঙ্গ দিয়ে ভাবি’— তাঁকে যারা পাগল তকমা দিয়েছিল তাদের এটা সরাসরি আক্রমণ, কেননা তিনি কেবল মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবছেন না, সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে ভাবছেন।

আমরা সর্বাঙ্গ দিয়ে ভাবি

ক.
আই গ্রাফটিং করা হয়
তার মানে একজনের চোখ
কেটে তুলে নিয়ে অন্য একজনের
চোখের জায়গায় জোড়া লাগিয়ে
দেওয়া হয়।
প্রথম ব্যক্তির চোখ উপড়ে
নেওয়া হলো। জোড়া লাগিয়ে
দ্বিতীয় ব্যক্তির শরীরে।
এই উপড়ে নেওয়া এবং জোড়া
লাগানো, এই করতে সময় লাগল
ধরা যাক পাঁচ মিনিট। এই পাঁচ মিনিট যাবৎ
চোখ জীবিত ছিল।

খ.
একজনের শরীরের রক্ত বার করে নিয়ে
বোতলে পুরে রাখা হয় এবং কয়েক
দিন পরে এই বোতলের থেকে অন্য
একজনের শরীরে ঢুকিয়ে
দেওয়া হয় এর থেকে বোঝা যায়
বোতলে পোরা অবস্থায় রক্ত জীবিত
ছিল, রক্তের প্রাণ ছিল, রক্ত ভাবছিল।
কারণ দ্বিতীয় ব্যক্তির শরীরে ঢুকে
রক্ত স্বাভাবিক হয়ে গেল।

গ.
‘খ’-এ যা লিখেছি (বোতলে যখন রক্ত ছিল তখন রক্তের প্রাণ
ছিল) তাহলে মুরগি যখন কাটা অবস্থায় পড়েছিল (‘ক’ দেখো)
তখন মুরগির মাংসের প্রাণ ছিল, ভাবছিল সুতরাং একজন মানুষ
মুরগির মাংস খেলে পাকস্থলির ভিতরের মুরগির মাংস জীবিত,
ভাবছিল পরে এই মুরগির মাংস মানুষের শরীরে মাংস হয়ে
গেল। এই নতুন দ্বিতীয় অবস্থায় মুরগির উপকার হলো।

অদ্রীশ বিশ্বাস তার স্মৃতিচরণে লিখেছেন, “আমি যখন প্রেসিডেন্সির ছাত্র, তখন বিনয় মজুমদারকে ঠাকুরনগর থেকে মেডিকাল কলেজে এজরা ওয়ার্ডে ভর্তি করে নিয়মিত কলেজ থেকে এসে দেখাশোনা আর গল্প করার ভার দেন তৎকালীন দুই উচ্চপদস্থ আমলা তারাপদ রায় ও কালিকৃষ্ণ গুহ। সেই সময় থেকে বিনয় মজুমদার ওনার বিখ্যাত খবরের কাগজের সংবাদই কবিতায় ঢোকান। আর ছিল ডায়েরি বা দৈনন্দিনকে কবিতায় ঢোকানোর পর্ব। এই পদ্ধতির ব্যবহার নিজের চোখে দেখা। অনেক কবিতা আজও সংগ্রহে আছে। কিন্তু বিনয় মজুমদার যে মহাপয়ারের জন্য বিখ্যাত, সেই কবিতাগুলো, ‘ফিরে এসো, চাকা’ নিয়ে শৈবাল মিত্র একটা চমৎকার টেলিফিল্ম বানান যা অনালোচিত থেকে গেছে বাঙালি জীবনে। এই সেই একমাত্র টেলিফিল্ম যেখানে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাককে সেরিব্রাল ডিরেক্টারের মতো করে তুলে এনেছেন। কিন্তু বিনয় মজুমদারের সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে আমি ওঁর লেখা দুষ্প্রাপ্য কাব্যগ্রন্থ ‘বাল্মীকির কবিতা’ বিষয়ে আলোচনা তুলি। দেখি, উনি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, এড়িয়ে যাচ্ছেন। বললেন, কোথায় শুনলাম এই নাম। আসলে ‘বাল্মিকীর কবিতা’র কথা বলেন সন্দীপ দত্ত। তখন আমি কপি সংগ্রহ করি বইটার প্রকাশকের ঘর থেকে। কিন্তু দেখি সন্দীপ দত্ত কথিত সেটা একটা খণ্ডিত সংস্করণ; মানে, সব কবিতা নেই। ব্রজগোপাল মণ্ডল ছিলেন প্রকাশক। তারপর বিনয় মজুমদার বলেন ‘এটা হলো বিনয় মজুমদারের একমাত্র ইরোটিক কবিতার বই বা বাংলা ভাষায় একমাত্র ইরোটিক কবিতা। ভারতীয় কামসূত্র বা দেশীয় আকাঙ্ক্ষাকে তত্ত্ব হিসাবে ব্যবহার করা ও ব্যক্তিজীবনকে মিশিয়ে কবিতার ইরোটিকা তৈরি করা। কেউ জানতো না। প্রকাশক ছাপতে রাজি হয়নি। খণ্ড ছেপেছে। আমি সন্দীপ দত্তের কাছে কিছু পূর্ণসংস্করণের খোঁজ পাই। কপি মেলে না। তখন বিনয় মজুমদার ঠাকুরনগর থেকে কপি এনে দেন। পড়ে আমি অবাক হই যে কেন এমন একটা কবিতার ইরোটিকা বাঙালি পড়তে পারবে না। এটা নিয়ে লিখি ও পুনর্মুদ্রণের দাবি করি। এই দাবি বিনয় মজুমদার সমর্থন করে ইনটারভিউ দেন সুবীর ঘোষকে। তারপর দে’জ থেকে ‘বাল্মীকির কবিতা’র পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ বের হয়। ওই ‘বাল্মিকীর কবিতা’র সূত্রেই আমি ওঁর বউ ও ছেলের খোঁজ পাই। তাদের নাম রাধা ও কেলো। একদিন সোনাগাছিতে গিয়ে তাদের আবিষ্কার করি আর সেলুলয়েডে ইনটারভিউ তুলে আনি।

অদ্রীশ বিশ্বাস যদি সংবাদপত্র থেকে গড়া বিনয়ের কবিতাগুলো প্রকাশ করেন তাহলে আমরা বিনয়-চরিত্রের আরেকটা ডাইমেনশনের সঙ্গে পরিচিত হবো। বিনয়ের কবিতার আরেকটি সাব-জনারের কথা জানতে পারবো। এই সূত্রে সন্দীপ দত্ত জানিয়েছেন যে, “১৯৭৫ সালে এক সাহিত্য সম্মেলনে বিনয় মজুমদার ‘বাল্মীকির কবিতা’ বই থেকে কবিতা পড়া শুরু করা মাত্র ভদ্রলোকদের উঠে যেতে দেখেছিলাম।” পরে বিনয় মজুমদারকে নিয়ে একটি টেলিফিল্ম হয়ছিল যাতে বিনয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জয় গোস্বামী। বিনয় ফিল্মটা প্রতিবেশীর টিভিতে দেখেছিলেন। এই বিষয়ে চন্দন ভট্টাচার্য তাঁকে প্রশ্ন করলে প্রথমে তিনি নিরুত্তর থাকেন, পরে বলেন, “এক-দু ঘণ্টার সিনেমায় কি গোটা জীবন ধরা যায়!” বিনয় মজুমদারের বউ রাধা আর ছেলে কেলোকে নিয়ে লেখা কবিতাটি একটি গাণিতিক প্রতর্কে মোড়া:

ভারতীয় গণিত

ক্যালকুলাসের এক সত্য আমি লিপিবদ্ধ করি।
যে কোনো ফাংকশানের এনেথ ডেরিভেটিভে এন
সমান বিয়োগ এক বসিয়ে দিলেই
সেই ফাংকশানটির ফার্স্ট ইন্টিগ্রেশনের ফল পাওয়া যায়–
এনেথ ডেরিভেটিভে এন
সমান বিয়োগ দুই বসিয়ে দিলেই
সেই ফাংকশানটির থার্ড ইন্টিগ্রেশনের ফল পাওয়া যায়–
এই ভাবে সহজেই যে কোনো অর্থাৎ
দশম বা শততম অথবা সহস্রতম ইন্টিগ্রেশনের
ফল অতি সহজেই পাই।
এই কবিতায় লেখা পদ্ধতির আবিষ্কর্তা আমি
বিনয় মজুমদার। আমার পত্নীর নাম রাধা
আর
আমার পুত্রের নাম কেলো।

বিনয়েরর স্মৃতিশক্তি বার্ধক্যেও প্রখর ছিল, সাক্ষাৎকারগুলোয় তিনি অনায়াসে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে উঠতেন। ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হের প্রকাশক উৎপল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন যে এই গ্রন্থের জীবনানন্দ বিষয়ক নিবন্ধগুলো জীবনানন্দের বই ছাড়াই, কেবল স্মৃতি থেকে লিখেছিলেন বিনয় মজুমদার। বইটিতে ‘ধূসর জীবনানন্দ’ শিরোনামে তাঁর এই কবিতাটি আছে:

ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে
কতিপয় ছিল শুধু বলেছিল, ‘এই জন্মদিন’।
এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
দর্শনে বিফল ব’লে, ভেবেছিলো, অক্ষমের গান।
সংশয়ে সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে
দেখে-দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে
একদিন সচেতন হরীতকী ফলের মতন
ঝরে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেল।
এখন সকলে বোঝে, মেঘমালা ভিতরে জটিল
পূঞ্জীভূত বাষ্পময়, তবুও দৃশ্যত শান্ত, শ্বেত;
বৃষ্টির নিমিত্ত ছিলো, এখনো রয়েছে, চিরকাল
রয়ে যাবে; সঙ্গোপন লিপ্সাময়ী, কল্পিত প্রেমিকা–
তোমার কবিতা, কাব্য, সংশয়ে-সন্দেহে দুলে-দুলে
তুমি নিজে ঝরে গেছো, হরীতকী ফলের মতোন।

নিজেকে বিনয় মজুমদার কখনও কবিতার শহিদ বলে মনে করেননি। কেননা সাহিত্যকে জীবিকা বা ধনোপার্জনের সঙ্গে একাসনে বসাননি তিনি, তাঁর সমসাময়িক কবিদের মতন। ‘কবিতার শহিদ’ তকমাটা শক্তি চট্টোপাধ্যায় চাপিয়েছিলেন বিনয়ের ওপর। প্রাপ্তির জন্য লালসা ছিল না তাঁর, কিংবা জাগতিক ধনদৌলতের জন্য দুঃখ। অনুষ্টুপ পত্রিকায় ২০১৩ সালে সুমন গুণ ঠিকই লিখেছিলেন যে, “জীবনানন্দের সময় থেকে এখনও পর্যন্ত এই রকম সয়ম্ভর কবি আর কেউ নেই।” এক সময়ে বিনয় ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লণ্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। সেই বিনয়ই শিমুলপুরে বসবাসের সময় থেকে পাণ্ডুলিপি এবং লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কবিতা সংরক্ষণ করা আর জরুরি মনে করতেন না।

বিনয় এক স্বতন্ত্র সত্তার কবি। তাঁর সময়ের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় কবি তিনি, বিচিত্রপথগামী তাঁর ভাবনা। আঙ্গিকগত বিন্যাস, শব্দ, ছন্দ, চিত্রকল্পের মিশ্রণে তাঁর কাব্যচেতনা অভিনব। ‘আধুনিক কবিতার হালচাল’ প্রবন্ধে বিনয় বলেছেন, “কালোত্তীর্ণ নয়, কালোপযোগী লেখাই অমর।” সহিদুল হক ২০১৭-এর বাংলা কবিতা পোর্টালে লিখেছেন, “বিনয় মজুমদার তাঁর বহু কবিতায় তথাকথিত অশ্লীলতাকে এক আশ্চর্য সুন্দর শৈল্পিকরূপ দান করেছেন।” বিনয় মজুমদার অত্যন্ত সচেতন মানুষ ছিলেন, নয়তো তাঁর কথা শোনার জন্য তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তরুণ কবিরা জড়ো হতেন না, এবং তা প্রায় প্রতিদিন। কেবল তাঁর লেখার ব্যাপারেই নয়, তাঁর পার্সোনা নিয়ে সাহিত্যিকরা যে ছবি গড়ে তুলতে চাইছেন তা সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন তিনি তা এই কবিতাটি থেকে পরিষ্কার হবে, তাঁর জীবনের শেষ পর্বে লেখা:

মনস্তত্ত্ববিদদের কীর্তি

ভাস্কর চক্রবর্তী পাগলা গারদে ছিল
কিন্তু পাগলা গারদ বলে না, বলে এটা মানসিক হাসপাতাল।
ভাস্কর চক্রবর্তীর বাবাকে মনস্তত্ত্ববিদগণ বলেছে আপনার
ছেলে আপনার চাইতে বেশি খ্যাতিমান
এই কথা বলাবলি করছে অন্যান্য কবি ও কবিবন্ধুগণ
ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেও একথা বলেছে।
এটা ভাস্কর চক্রবর্তীর মনোরোগ
এই মনোরোগ আমরা সারিয়ে দিতে পারি
কিভাবে সারাতে পারি?
ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেই লিখবে যে আমার বাবা
আমার চাইতে বেশী বিখ্যাত লোক
আমাকে পশ্চিমবঙ্গে কেউ চিনল না বাবাকে চেনে
এই কথা ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেই লিখবে
এই রকম মনোরোগীর চিকিৎসা আমরা বহু
করেছি। সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক এদের
আমরা চিকিৎসা করেছি।
হে জনসাধারণ এই যে ভাস্কর চক্রবর্তী
ভাবে যে ভাস্কর চক্রবর্তী জনসাধারণের চাইতে
উঁচু দরের বাঙালি একজন।
আমরা এই ভাস্কর চক্রবর্তীর মনোরোগ চিকিৎসা
করতে পারি। চিকিৎসা করতে পারলে ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেই
বলবে যে আমি জনসাধারণের সমান মানে
কেরানির সমান, স্কুল মাস্টারের সমান। চাষার
সমান।
তোমরা শুধু অনুমতি দাও ভাস্কর চক্রবর্তীর
চিকিৎসার জন্য তাহলে আমরা ভাস্কর চক্রবর্তীকে
তোমাদের সমান অর্থাৎ কেরানি, চাষী, স্কুল মাস্টার
রিকশাওয়ালার সমান। একথা ভাস্কর চক্রবর্তী
নিজেই বলবে আমাদের এখানে চিকিৎসা করার
পর।
বাঃ ভাস্কর চক্রবর্তীর বাবা অনুমতি দিয়েছেন
জনসাধারণ অনুমতি দিয়েছেন। এইবার তাহলে
হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করি।
এই রকমের পাগলাগারদে ডাক্তাররাও আছে
যেমন রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস এম. বি. বি. এস. পাশ
করা ডাক্তার সে আছে মেডিকাল কলেজের পাগলা
গারদে। এইরকম ভাবে পুলিশও আছে পাগলা গারদে।
                   (তার মানে মানসিক হাসপাতালে)

মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করা হচ্ছে
পুলিশ অনন্ত দেবরায়কে অর্থাৎ এরা হচ্ছে বিশেষ
বিশেষ উদাহরণ।
পুলিশ, এম.বি.বি.এস. পাশ করা ডাক্তার রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বাস। এর পরে কবি বাদ দিলাম। অন্যান্য
যারা পাগলা গারদে ছিল এবং আছে ডাক্তার রবীন্দ্র
নাথ বিশ্বাস, পুলিশ অনন্ত দেবরায়
কিন্তু এই রকমের দু’একজন ডাক্তার পুলিশ
এদের সঙ্গে পাগলা গারদে আছে শত শত জনসাধারণ
হাজার হাজার জনসাধারণ এবং
ডাক্তার রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস নিজেই বলল যে
তার নিজের হয়েছে ক্রনিক শিজোফ্রেনিয়া
এই অসুখের কোনো চিকিৎসা নেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস
কে সারাজীবন ঔষধ খেতে হবে এবং আনুসঙ্গিক
চিকিৎসা করাতে হবে।
এ তো হল একজন ডাক্তার, একজন কবি, একজন পুলিশ
এদের ভাগ্য আর অন্যান্য যাদের এই ভাগ্য হয়েছে
তারা হলেন হাজার হাজার জনসাধারণ।

ডি. জ্যাবলো হার্শম্যান এবং জুলিয়েন লিয়েব (১৯৯৮) তাঁদের  ‘ম্যানিক ডিপ্রেশান অ্যাণ্ড ক্রিয়েটিভিটি’ গবেষণাপত্রে বলেছেন যে সৃজনশীল শিল্পীরা ম্যানিক ডিপ্রেশানকে নিজের জীবনে ও কাজে সদর্থক উদ্দেশে ব্যবহার করতে পারেন। পল গঁগা যখন দেখলেন তিনি ফ্রান্সে বসে আঁকতে পারছেন না তখন ইউরোপের সমাজকে পরিত্যাগ করার জন্য তাহিতি দ্বীপে বসবাস করতে চলে গিয়েছিলেন। ম্যানিক ডিপ্রেশানে আক্রান্ত হয়েছিলেন নিউটন, বিটোফেন এবং চার্লস ডিকেন্সও। মনোভঙ্গের বাঁধন কেটে বেরোবার জন্য ডিকেন্স লিখেছিলেন ‘ক্রিসমাস ক্যারল’।

লুডউইগ এম অ্যারনল্ড ‘দি প্রাইস অফ গ্রেটনেস: রিজলভিং দি ক্রিয়েটিভিটি অ্যাণ্ড ম্যাডনেস কনট্রোভার্সি’ (১৯৯৫) গ্রন্থটি ১০০০ বিখ্যাত মানুষের জীবনকাহিনি বিশ্লেষণ করে লিখেছেন। তিনি তর্ক দিয়েছেন যে যাঁদের চেতনার স্তর সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা, স্কিৎসিফ্রেনিয়া, হিস্টিরিয়া, সংবেদনের অতিরেক, যৌন অক্ষমতা, যাঁরা নিঃসঙ্গতা পছন্দ করেন, তাঁদের মুক্তির পথ হলো সৃজনশীল শিল্প, তাঁদের ক্ষেত্রে তা নিরাময়ের কাজ করে। বিনয় মজুমদারকে কেউ কেউ বলেছেন পাগল; কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে তিনি রুশভাষা শিখে ছয়টি বই অনুবাদ করলেন, একুশটি কাব্যগ্রন্থ লিখলেন, ছয়টি গদ্যের বই, গণিতের বই লিখলেন কেমন করে? এখনও তাঁর বহু রচনা অগ্রন্থিত রয়েছে।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রশান্ত চক্রবর্তী, সম্প্রতি বিজেপির ছাত্র সংগঠন যাঁকে আক্রমণ করে পাঁজরের হাড় ভেঙে দিয়েছে, তাঁর ‘দি অপুলেন্স অফ এক্সিসটেন্স: এসেজ অন ইসথেটিক্স অ্যাণ্ড পলিটিক্স’ (জানুয়ারি ২০১৭) বক্তৃতামালায় বিনয় মজুমদার সম্পর্কে এই কথাই বলেছেন যে, “বিনয়ের কবিতা আলোচনাকালে চিরকাল তাঁর একাকিত্বপ্রিয়তা এবং নিউরটিক প্রলক্ষণকে তাঁর কবিতার মূল্যায়নের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে; এর চেয়ে বেশি নাটুকে ও বিরক্তিকর ভাবপ্রবণতা আর হতে পারে না। বিনয়ের কবিতার বিশুদ্ধ প্রাণচাঞ্চল্য মূল্যায়নের পথে এটি পরিত্যাজ্য বাধা। বিনয় ছিলেন পরমোৎকর্ষ-সন্ধানী এবং সতর্ক কবিতাশিল্পী।”

প্রশান্ত চক্রবর্তী আরও বলেছেন, এবং এই প্রসঙ্গে ওপরে আলোচিত সংজ্ঞার অবলোকনের প্রসঙ্গ এসে পড়ে, কবিজীবনের শেষ পর্বে বিনয় মজুমদার কবিতাকে জার্নাল লেখার মতো করে তোলেন। তিনি নিজের চারিপাশের বস্তুগুলো এবং ঘটনাগুলোর দিকে গভীর ভাবে তাকাতেন এবং সেগুলি রেকর্ড করতেন। তার ফলে একদিকে আমরা যেমন একজন ঘটনাপঞ্জীর দ্রষ্টাকে পাই, তেমনিই আরেকদিকে পাই কলকাতার বাইরে চলতে থাকা সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো। পংক্তিগুলো জার্নাল রচনার অসাধারণ অভিব্যক্তি, তাতে কোনোরকম কৃত্রিম কবিত্ব করা হয়নি, তার চেয়েও বেশি কিছু উপস্থাপন করা হয়েছে যা বুনিয়াদি: স্রেফ বেঁচে থাকা। রেকর্ড করার অর্থ হল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বস্তুদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুসন্ধান।

বিনয়ের লেখার প্রথম কালখণ্ড ছিল মূলত ১৯৫৮ থেকে  ১৯৬৬। এই সময়টাতেই পঞ্চাশের কবিদের অনেকে সোনাগাছি-হাড়কাটা-খিদিরপুর যাওয়া আরম্ভ করেন, প্রধানত বুদ্ধদেব বসুর বদল্যার সম্পর্কিত বইটি প্রকাশিত হবার পর। বিনয় মজুমদার একা সোনাগাছি এলাকায় যেতেন বলে অনুমান করি, তাঁর ‘বাল্মীকির কবিতা’ থেকে সেরকমই মনে হয়; যৌনকর্মীর ঘরের যে বর্ণনা তাঁর কবিতায় পাই তা কেউ যৌনকর্মীর ঘরে না গেলে বলতে পারবেন না। অদ্রীশ বিশ্বাসের স্মৃতিচারণা থেকেও তেমনটাই আঁচ করা যায়। নিয়মিত গ্রাহক সোনাগাছিতে ‘বাবু’ অভিধা পান; বিনয় হয়তো কিছুকালের জন্য রাধার ‘বাবু’ প্রেমিক ছিলেন। রাধা নামে এক যৌনকর্মী আর তার ছেলের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা বলে গেছেন বিনয়। অদ্রীশ বিশ্বাস জানিয়েছেন যে, তিনি যৌনপল্লীতে গিয়ে রাধা আর কেলোর ফিল্ম তুলে এনেছিলেন। সেগুলো প্রকাশিত হলে পাঠকের অনুসন্ধিৎসা মেটে। ভুট্টা সিরিজের কবিতাগুলো পড়লে বিশ্বাস করা যায় যে তিনি নিয়মিত নারীসঙ্গ করতেন কোনো এক সময়ে। হয়তো লেখালিখি তাঁকে এই সময়টায় ছেড়ে গিয়েছিল বলে তিনি রাধায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। হাংরি আন্দোলনের গল্পলেখক বাসুদেব দাশগুপ্ত যখন আর লিখতে পারছিলেন না তখন তিনি ‘বেবি’ নামে এক যৌনকর্মীর ‘বাবু’ হয়ে ওঠেন। হাংরি আন্দোলনের কবি প্রদীপ চৌধুরী জানিয়েছেন যে বাসুদেব দাশগুপ্ত সে-সময়ে ভায়াগ্রার সন্ধান করতেন।

“অঘ্রাণের অনুভূতিমালা” কাব্যগ্রন্হে ‘বিশাল দুপুরবেলা’ শিরোনামে একটি কবিতা আছে। যাঁরা দুপুরবেলায় সোনাগাছি নিয়মিত যান তাঁরা জানেন যে এই সময়টাতেই অনেকক্ষণের জন্য নিজের কাছে পাওয়া যায় প্রেমিকা-যৌনকর্মীকে। সময়টা বিশাল, দুজনে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে সন্ধ্যার খদ্দের না আসা পর্যন্ত অঢেল সময়। যিনি ‘বাবু’ তিনিও নিজের জীবনের দুপুরবেলাতেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন, অমন সম্পর্কে, বাসুদেব দাশগুপ্তের মতন। বাসুদেব দাশগুপ্ত অমন দুপুরবেলা কাটিয়ে সন্ধ্যার সময়ে আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর বাড়িতে এসে চিৎপটাঙ হয়ে শুয়ে পড়তেন, নেশা কেটে গেলে অশোকনগরে বাড়ি ফিরতেন।

আশি ও নব্বুই দশকে বিনয় মজুমদার অসুস্হ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে দেখাশোনা করতো কলকাতা শহরতলীর ঠাকুরনগরের শিমুলপুরের একটি পরিবার। অনেকে এই আশ্রয়কে তুলনা করেছেন মানসিক রোগাক্রান্ত পরিবার-পরিত্যক্ত কবি ফ্রেডরিক হ্বেলডার্লিনের সঙ্গে, যাঁকে অমনই একটি গরিব মুচি পরিবার আশ্রয় দিয়েছিল। কেমন ছিল বিনয় মজুমদারের সে সময়ের জীবন? এই কয়েকটা লাইন পড়লে কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে, কেবল কার্বোহাইড্রেট খেয়ে দিনের পর দিন চালিয়েছেন বিনয় মজুমদার, জীবনানন্দের পর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি। সে সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ম্যাণ্ডেভিলা গার্ডেন্সে বসে খাচ্ছেন মুর্গির ললিপপ দিয়ে স্কচ এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় খাচ্ছেন স্ত্রীর রান্না করা উপাদেয় স্বাস্থকর খাদ্য। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বক্তৃতা দেবার জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিজের ক্যাম্পাসে আহ্বান করে নিয়ে গিয়েছিলেন, প্রধানত শক্তি-সুনীল ব্র্যাণ্ডটাকে ব্যবহার করার জন্য, বিনয়কে নিমন্ত্রণ জানাতে তাঁরা হয়তো ভয় পেয়েছিলেন। শিমুলপুরে পাকাপাকি থাকতে গিয়ে বিনয়ের দৈনিক জীবন কেমন কাটছিল তা উনি বিয়াল্লিশ মাত্রার মহাপয়ারে লিখে রেখে গেছেন:

এইমাত্র পান্তাভাত

এইমাত্র পান্তাভাত খেলাম অর্থাৎ আমি হাত ধুতে গেছলাম
         অবশ্য খাবার পরে এঁটোথালা ধুই আমি নিজে
ভোরে ধুই দুপুরেও ধুই শুধু রাত্রিবেলা ধুই সে এঁটো থালা
        ভোরবেলা রাত্তিরের এঁটোথালা হাতে নিয়ে যাই
বুচির বাড়ির কাছে, এঁটো থালা দিয়ে আসি তার হাতে, বুচি নিজে
        ধুয়ে দেয় রাত্তিরের এঁটো থালাখানি।
সেই ধোয়া থালাটিতে বুচি নিজে খাদ্য দেয় আমার ভোরের খাদ্য
         গতকাল দিয়েছিল বেগুনসিদ্ধ ও ভাত আর
আজ দিল তো পান্তাভাত; ভোরে বেশিদিন দ্যায় আলুসিদ্ধ আর ভাত
         মনে হয় আগামীকাল দেবে আলুসিদ্ধ ভাত।
আজ আমি এঁটো থালা কলঘরে ধুয়ে এনে রেখেছি তো টেবিলের
        উপরেই, এই ধোয়া থালাটিতে ভাত দেবে বুচি।
                                         (‘পৃথিবীর মানচিত্র’ কাব্যগ্রন্হ— ২০০৬)

অসুস্থতার পরে তাঁর কবিতা রচনার আরেকটি পর্ব শুরু হয়, প্রধানত লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের চাহিদা মেটাতে, যে কবিতাগুলিতে বিনয় তাঁর সামনেকার বস্তুজগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এবং বস্তুগুলোর পারস্পারিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে চলেছেন। ‘মনে থাকা’ শিরোনামে একটি কবিতায় বিনয় জানিয়েছেন যে, যে-কবিতার মানে বোঝা যায় না তাও ওনার মনে থাকে। তাঁর স্মৃতিশক্তি শেষ বয়সেও ছিল প্রখর। বিনয়ের মনে থাকলেও দুর্বোধ্য কবিতা আমার মনে থাকে না। বিনয় তিনটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন:

অমিয় চক্রবর্তী:
“খড়মাঠ কথা কয়, অজানা খোটানি
ঘনমেঘ চলে ছায়াটানি
নয় নীল শূন্য ত্রিশূল
টুকরো পাহাড়”

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়:
“সাদা বা কালো ক্ষণপাথর
এ কোন আলো হৃদয়ে বা
অথবা নীচে নীল সাগর
পাহাড়ে নাচে হৃদয়ে বা
বুড়োর এ মন কবরে যায়
যখের ধন গভীরে চায়
হৃদয়ে তবু প্রেম নাচায়
পাহাড়ে বা হৃদয়ে”

মৃদুল দাশগুপ্ত:
“কয়েক মুহূর্তকাল থামো—
আমি তাকে বলি
থেমে অশ্ম মন্ত্র ও মেশিন। চলবে