রওশন আরা মুক্তার গল্প ‘খুনগুলো সব’

প্রকাশিত : জুন ২১, ২০২০

হঠাৎ এমন একটা ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল হয়ে যাবে, এটা কস্মিনকালেও কেউ কল্পনা করেনি। দেশে তখন যা চলছিল, শিউলি ফুলের ঝড়ে না পড়ার স্টুপিড ভিডিও; এক কমবয়স্ক মেয়ে পাথুরে শীতের ভোরে রাস্তার পাশের একটা শিউলি গাছকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল; এমন ভিডিও বা সাদা সাদা ব্রয়লার মুরগীর জবাইয়ের দৃশ্য, এক শিশুর ফার্স্ট শেভিং— এসব স্টুপিডলিই ভাইরাল হয়ে যায়, মানে যেতে পারে। এবার যা ঘটল তা নিয়ে সন্দেহও আছে কিছু। পিচ ঢালাই রাস্তার পাশের চা ঘরগুলোতেও এ নিয়ে সন্দেহ দেখা গেছে। বিড়াল কখনই গাছে উঠতে পারে না। এটি শুধু অবিশ্বাস্যই না, অবৈজ্ঞানিকও বটে; চা বিক্রি করতে করতে হাত অবশ করে ফেলা দিদার আলী এসব শোনে, এবং বলার চেষ্টা করে বিড়াল বিপদে পড়লে গাছে ওঠেই, এটা কাল্পনিক কিছু না। তবুও লোকের কথা থেমে থাকে না, নির্ঘাত ফটোশপ! কী নিখুঁত মেকিং! একটা বিড়াল তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে নারকেল গাছের দিকে, হুট করে থেমে গেল সেই ক্ষিপ্রতা, অসাধারণ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল পাড়ার ছাল ওঠা কুকুরটার সামনে। চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ; এরপর ঠিক যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকে আগের গতিতেই ছুটে গেল এবং একলাফে উঠে গেল নারকেল গাছের আগায়। অনলাইনে কেউ কেউ এই বিড়ালকে আদর করে লায়ন ডাকা শুরু করেছে—  নারকেল গাছের ওপর উঠে বিড়ালটি নাকি অবিকল সিংহের মতো ভাবভঙ্গি করেছিল। তবে কিছু লোক একে বানানো ভিডিও বলতেই থাকল।

দিদার আলীকে ধমক দিয়ে থামালো কেউ কেউ। যে জিনিসটা দেখেই নাই, এবং যার ভিডিও নিয়ে কোনো জ্ঞান নাই সে কেন মন্তব্য করে, বলে বিরক্তি প্রকাশ করলো চা খেতে আসা লোকেরা। দিদার আলীর গায়ে লেগে গেল কথাগুলো, এত আর কিছু না, জ্ঞান নিয়ে খোটা। কতবার কত রকম পরামর্শে কত ধরনের বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে এই শফিক্যা-রফিক্যাকে। আর আজ হুট করে সবার সাথে সুর মিলিয়ে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে চা খেতে খেতে দিদার আলীকেই অপমান করে দিল? নাইবা দেখলো সে ভিডিও, তাই বলে কি বয়সের অভিজ্ঞতা একেবারেই ফেলনা করে ফেলা যায়?

একবেলা চায়ের দোকান বন্ধ রাখলো দিদার আলী। বনানী রেল লাইনের পাশের দিদার চা ঘর বন্ধ পেয়ে লোকেদের মন-মেজাজ একবেলা খারাপ থাকল। স্টেশনের কমন বালক হবিকে দিয়ে খবর পাঠানো হলো। দিদার আলী জানতো, দোকান বন্ধ করে দিলেই খবর হয়ে যাবে। তবে শফিকুল নাকি রফিকুল কে খবরটা পাঠাল, জানার দরকার। হবি স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললো, শফিকুল রফিকুল সব এক লগে বয়া আছে, চালায়া চলেন। আপনারে ভিডু দেহাইব।

রাগে গজগজ করতে করতে হাতে একটা ছোট চাকু নিয়ে ছাপড়া ঘরটা থেকে বের হয় দিদার আলী। হবির দিকে তেড়ে এসে বলে, ভিডুর গুষ্টি কিলাই আমি! আমারে কয় আমার জ্ঞান নাই!
ঘরের চাল থেকে একটা পাথর নামায়, এরপর চাকুটা সেই পাথরে ঘষতে থাকে। ঢাকা শহরের অভিজাত দুই আবাসিক এলাকা এই ‘ডি ক্লাস’ রেল স্টেশনের পাশেই। তবুও এখানে ভাঙা টিনের কিছু ছাপড়া ঘর গজিয়েছে, মাঝে মাঝে ভেঙে ফেলা হয় আবার গজিয়ে যায়। দিদার আলীর চা ঘরটা ঠিক স্টেশনে না, একটু দূরে। আন্তঃনগর ট্রেন এখানে থামে না, ভির-ভাট্টা নাই তেমন, প্ল্যাটফর্ম বিহীন ঝলঝলা একটা স্টেশন। দিদার আলীর ছাপড়া ঘরের একটু দূরেই মোটামুটি সভ্য একটা টিনের ঘর, দু’বছর ধরে সেখানে রহম শেখ বসবাস করছে। নামেই রহম শেখ, এই তো সপ্তাহখানেক আগের কথা, এক ছাত্রীর লাশ পাওয়া গেল রেল লাইনে, আত্মহত্যাই হবে, বনানীর এই রেল লাইন কত প্রাণ নিয়েছে তার হিসাব কি এই রহম শেখ রাখে? সবাই দৌড়ে গেল, রফিকুল ভিডিও করে অনলাইনেও ছেড়েছিল, সারা দুনিয়া জেনে গেলেও— জানেনি রহম শেখ। যেন তার ঘরের পাশে কেউ আত্মহত্যা করেনি কোনোদিন। কী জানি, কোনো তন্ত্রমন্ত্র সাধনা করে কিনা! ফুটফুটে সব প্রাণ তার ঘরের পাশে এসে আত্মাহুতি দিচ্ছে আর বাল ফালাইন্যা তাঁতি* রহম শেখ? প্রতিদিন সকালে বের হয়ে টিনের দরজায় তালা লাগাচ্ছে আর সন্ধ্যায় এসে তালা খুলে ঘরে ঢুকছে। সে নাকি আবার সিটি করপোরেশনে চাকরি করে!

দিদার আলীর মাথায় রক্ত চড়ে যায় রহম শেখের তালাবন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে, চাকুটা পাথরে বেদম ঘষতে থাকে। ঐতো রেল লাইনের পাশেই ঘরটা, কোনোদিন কোনো ট্রেন ওর ঘরে ঢুকে যেতে পারে না? বেকুবটার বউ-টউ নাই, চারটা বিড়াল নিয়ে থাকে। সিটি করপোরেশনে কী চাকরি করে কে জানে, মেথর টেথর হবে হয়তো! আজ পর্যন্ত দিদার আলীর দোকানে বসে এক কাপ চা খায়নি! শালায় করেটা কী? না খাইলেও চলে নাকি? পাথরে চাকু ঘষে আগুন ধরে যাবে যেন— এত দ্রুততার সাথে হাত চালাচ্ছে দিদার আলী, চোখ কটমট করে তাকিয়ে আছে ঘরটার দিকে। হবিও বুঝতে পারে, রহম শেখকে নিয়ে দিদার আলীর মেজাজ খারাপ; দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলে, স্যারের আওনের টাইম হইয়া গেছে! অহনি আয়া পড়ব।

দিদার আলী খেঁকিয়ে ওঠে, স্যার কেডা? ওই হারামজাদা, মেথররে স্যার ডাহস ক্যারে?
হবি খ্যাকখ্যাক করে হাসতে হাসতে দৌড় লাগায় একটা। দিদার আলীর মেজাজ চরমে ওঠানো গেছে! সিটি করপোরেশনের মেথর হোক আর মুচি হোক, রহম শেখকে কেউ ঘাটাতে পারবে না, তাহলে দিদার আলীর চায়ের দোকানের ভাগ্যে বুলডোজার নেমে আসতে পারে; আর এ জন্যেই দিদার আলীর মেজাজ প্রায়ই একে নিয়ে খারাপ হয়, এটা হবিও জানে।

শফিকুল বা রফিকুলকে অধিকাংশ সময় স্টেশনেই বসে থাকতে দেখা যায়, বড়জোর ওভার ব্রিজের নিচ পর্যন্ত যাবে। মাঝে মাঝে চেয়ার পেতে বসা লোকেদের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেজাবে এবং আবার ফিরবে সেই স্টেশনেই। দিদার আলীকে আসতে দেখে ওরা বানানো একটা গম্ভীরতায় ঢুকে যায়, এবং তাদের দুইজনের জমানো টাকায় কেনা একমাত্র স্মার্টফোনটিতে সেই ভাইরাল ভিডিওটা বের করে ফেলে, দিদার আলীকে এটা দেখাতেই হবে, তাহলেই ভুল বোঝাবুঝির অবসান হতে পারে।

বিড়ালের সিংহভঙ্গি সহজ কথা নয়, এটা অবশ্যই বানানো ভিডিও। রেললাইনের কাটা লাশের ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দিয়ে ফেসবুকে অনেক ফলোয়ার বানিয়েছে রফিকুল-শফিকুল, তারা একটা আইডি থেকে অনলাইনের কাজকর্ম চালায়; দুনিয়ার কত খোঁজ খবর রাখে! মাঝে মাঝে অবাক হয়, এই যেমন গত আত্মহত্যাটার কথাই ধরা যাক; না, কোনো কারণ ছিল না মেয়েটার এভাবে রেলে এসে জান দেয়ার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, বাবা-মা প্রতিষ্ঠিত, ধানমণ্ডিতে নিজেদের বাড়িতে থাকে, একটা মাত্র বড় বোন, সেও নাকি ডাক্তার; যে ছেলেটার সাথে ভালোবাসা ছিল সেই ছেলে সাতদিন ধরে রেল লাইনের পাশেই বসে আছে, রফিক-শফিক দেখেই চিনেছে, এই সে ছেলে, অনলাইনে থাকলে সবাইকে চেনা যায়। ছেলেটাও ওদের বলে, সেও বুঝতে পারে না, কেন চলে গেল সুকন্যা? রফিক-শফিক ছেলেটাকে এনে চা খাওয়ায়, বোঝায়, এই রেল লাইনটাই এমন; এই রেল লাইনটা যে কাউকে ঘর থেকে বের করে এখানে এনে জান নিয়ে নিতে পারে। ছেলেটা ইংরেজিতে একটা শব্দ বলে, রফিক-শফিক অনলাইনে তার অর্থ খুঁজে দেখে, হিপনোটাইজ-এর অর্থ সম্মোহন; বাংলা বা ইংরেজি কোনোটার অর্থই বুঝতে পারে না রফিকুল-শফিকুল, একুটুকু বুঝতে পারে, ছেলেটা বলতে চাইছে, রেল লাইনটা একটা কিছু করতে পারে। রফিক-শফিকও তাই বলতে চেয়েছে। কি জানি এর সাথে রহম শেখের কোনো যোগসাজস আছে কিনা! দুই বছর ধরে এখানে থাকে, চা ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, রফিক-শফিকের দিকে তাকায়ও কিন্তু কোনোদিন কথা বলে না, নাকউঁচা মানুষ আছে দুনিয়ায়, কিন্তু এটা যেন অন্যকিছু; যেভাবে তাকায় মনে হয় যেন আসলে অন্যদিকে তাকাচ্ছে, বা তাদের দিকেই তাকাচ্ছে কিন্তু আসলে দেখছে না, নীরবে, আস্তে ধীরে হেঁটে চলে যাচ্ছে।

দিদার আলীও বেজায় নাখোশ হারামিটার ওপর। খায় তো ঘুষ, সরকারি চাকরি নিশ্চিত ঘুষ দিয়ে নিয়েছে, নাহলে মাগনা মাগনা এই উজবুককে চাকরি কে দেবে? এখন যত ঘুষ দিয়েছে তার তিন ডাবল খাচ্ছে। সব বোঝা যায়! ‘টাকার গরমে বিলাই লইয়া হুইত্যা থাহে’ রফিক যেন বাতাস থেকে পেড়ে বলে কথাটা, শফিক ধরে ফেলে, রহম শেখের কথাই হচ্ছে। সকালে যখন দিদার আলীর বন্ধ চা-ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা রহম শেখ ওদের সামনে দিয়ে গেল। অন্যদিনের মতো ধীরে না, যেন ছুটে যাচ্ছে, রফিক-শফিককে প্রায় ধাক্কা দিয়ে গেল, তবুও হুঁশ নাই। ‘ডলা ফরজ হয়ে গ্যাছে রে’ শফিক বলে।

দিদার আলী রাগ প্রকাশে অহেতুক শব্দ করে দোকান খুলতে থাকে— দোকান বলতে দুইটা বেঞ্চ, একটা টেবিল, আর একটা চেয়ার; কেটলিতে পানি বসিয়ে দেয়। রফিক শফিক বেঞ্চে বসে কথা পাড়ে, আচ্ছা তোমার এই চাক্কুটা দিয়া ভুড়ি গলানি যাইব না? আদা কাটতে থাকা দিদার আলী বলে, জবাই কইরা ফালানি যাইব, কের লাইগ্যা? রফিক-শফিক দেখায়, রহম শেখ আসছে। সকালের মতোই ছুটে আসছে, আজকে হলো কি লোকটার? এমন ছুটছে কেন? দিদার আলীর মন ভালো হয়ে যায়, মজমার সুরে বলে, মেথর কাইট্টা আমার চাক্কু নাশ করন লাগতো না। মেথরের গরের মেথর, বিলাই লইয়া থাহে!

রহম শেখ একটু কাছে আসতেই শফিক হাতের স্মার্টফোনটা উঁচিয়ে ধরে বলে, মেয়র সাব, আইয়ুন এজুর! আইজকাইল বিলাইও গাছে উডে, দেইক্কা যাইন রঙ্গডা! রহম শেখ যেন চমকে ওঠে, তবে দাঁড়ায় না, আরও দ্রুত পা চালিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। রফিক-শফিক হেসে ওঠে, দেকছোনি কারবারটা? হালার মনে অয় গাট্টিত আগুন লাগছে, দৌড়ের উপরে আছে! রফিককে থামায় শফিক, মরজ্বালা, বাদ দে ছে, ভিডুডা বাইর কর এলা, লাক লাক মানুষ দেইক্কালচে, আমরার দিদার আলী খালি বাহি।
দিদার আলীও স্বীকার করে, এটা আসলে সম্ভব না। বিড়াল বিপদে পড়লে গাছে ওঠে তাই বলে নারকেল গাছের আগায় না, আর ওই সিংহভঙ্গি তো কোনোদিনও সম্ভব না। রফিক-শফিক বিজয়ীর হাসি হাসে। অনলাইনে যে কত কী ঘটে! এগুলা এডিট করা যায়— অনলাইনে ভাইরাল হওয়া ভণ্ড মাওলানার ডায়লগ ছাড়ে শফিক। আল্লাহ তুমার কাছে বিছার দিলাম, বলে আরেক ভণ্ড নেতার ভাইরাল ভিডিওর ডায়লগ নকল করে রফিক। তুমুল হাসাহাসি করতে থাকে ওরা। দুনিয়াটা মজার জায়গা আসলে, মজা নিলেই মজা।

দিদার আলীর বিখ্যাত আদা চা তৈরি হয়ে যায়। লোকজন এসে ভির করে। এখন আর দিদার আলীর অবসর নাই, রাত নয়টা পর্যন্ত চলবে। নামাজের সময়গুলোতে হবি এসে বসে দোকানে, চা তৈরিই থাকে, হবির কাজ পরিবেশন করা আর বাকির খাতায় লিখে রাখা কার কত কাপ। দিদার আলী এশার নামাজের পর দোকান গুটিয়ে ঘরে চলে যায়, তসবি জপে, পুরাতন দিনের কাগজপত্র ঘাটে। কী একটা জীবন ছিল তার! ঘর পালিয়ে মিছিলে মিছিলে চলে গেছে তরুণ বয়সের পুরোটা; হাস্যকর হলেও সত্য, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকতো তার বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন হলেই, দিদার আলী সেই মিছিলে শামিল হয়ে যেত। প্রতি মিছিলেই কিছু নতুন মুখ, কিছু নতুন কথা, কিছু নতুন ব্যথা; তবে তাদের সকলের প্রাণের দাবি একই, কত সময় গেল, দিদার আলীর চুলে পাক ধরলো, সে মিছিলে যাওয়া বাদ দিল, তবুও মানুষ রাস্তায় নামে একই দাবি নিয়ে; তারা মানুষ হিসাবে বাঁচতে চায়, আর কিছু না; জাস্ট মানবকুলে জন্ম নিয়েছে তাই তারা মানুষের সম্মানটুকু চায়। একজন মানুষ মারা গেলে অন্য একজন মানুষ যেন না হেসে ওঠে, যেন তার মনটাও ভিজে উঠে, আর্দ্র হয়ে ওঠে— এমনই সিলি মানুষের চাওয়া। তবে এখন আর মানুষ তেমন মিছিল করে না, দিদার আলী ঠিক বোঝে না, একটা দেশে দিনের পর দিন কীভাবে শুধু আনন্দ মিছিল হতে পারে?

তার সময়ে সে একেকবার একেক দলের হয়ে মিছিলে গেলেও, মিছিলে গিয়ে একবেলা নেতাদের খাবার খেলেও একথা সে গর্বভরে বলতে পারে, কোনোদিন সে কারও পোষা কুত্তা হয়ে যায় নাই। এমন কোনো দল নাই যাদের হয়ে মিছিল করেনি দিদার আলী, যখন যে তার দাবি নিয়ে দাঁড়ালো দিদার আলী সেখানে হাজির। লোকে দিদার আলীকে সেজন্য চরিত্রহীনও বলেছে, এতে তার কিছুই আসে যায় নাই, দুই পয়সার চরিত্র ধুয়ে তার পানি সকাল-বিকাল খাওয়ার লোক দিদার আলী না। চা খেতে আসা লোকেরা দিদার আলীর অভিজ্ঞতার জন্য তাকে সাধুবাদ জানায়, দোয়া দেয়। ভিডিওটা নকল হলেও, বিড়াল কম কষ্টে গাছে ওঠে না— দিদার আলীর এই কথাও যে ঠিক তা সবাই স্বীকার করে।

দুই.
দোকানভর্তি লোকের ভিতরে এমন একটা অবাক কাণ্ড ঘটে যাবে, কেউ কল্পনা করেনি। দিদার আলীর চা ঘরে রহম শেখ এসে উপস্থিত! রফিক-শফিক যেন ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে, আদা কাটার চাকুটার দিকে তাকায়, ওরা যে রহম শেখকে ডলা দিতে চেয়েছিল এটা বুঝে ফেলেছে নাকি তান্ত্রিকটা? কিন্তু না, রহম শেখ নিজেই ভূতগ্রস্ত হয়ে আছে, হাত-পা যেন কাঁপছে, নাকমুখ সাদা। দিদার আলী হইহই করে শশব্যস্ত হয়ে ওঠে, দিদার আলী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে রহম শেখের ছয় ফুটি বপু একদিকে কাত হয়ে পড়ে যেতে থাকে; রফিক-শফিক, দিদার আলী তিনজনে মিলে ধরেও কুলাতে পারে না, আরও লোক এগিয়ে আসে, কতগুলো মানুষের কোলে জ্ঞান হারায় রহম শেখ। ধরাধরি করে দিদার আলীর ঘরে নেয়া হয় তাকে। হবি গিয়ে দেখে রহম শেখের ঘরে তালা দেয়া, চাবি কই কে জানে! মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করা হয় কিছুক্ষণ, দাঁত কপাটি লেগে গেছে, ভাগ্য ভালো জিভ কাটা পড়েনি। শফিক একটা চামচ এনে দাঁত কপাটি খোলার চেষ্টা করে। রহম শেখ যেমন বৃষ্টিবীনা শিলার মতো ধপাস করে পড়েছিল, তেমনি কটকটে রোদের মধ্যে বজ্রপাতের মতো ধড়াস করে উঠে বসলো। এবং বললো, জানের টুকরাগুলারে আমার নিজহাতে মারতে হইব, ভাইজান, আমার এই দুইটা হাত আমি রাখতে চাই না, ভাইজান, আমার হাতগুলা কাইট্টা ফালাও গো! দিদার আলীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে রহম শেখ। ঘরটায় কী যেন একটা হয়, রফিক-শফিক, হবি সবার চোখে পানি এসে যায়, সবাই চোখ মুছতে থাকে, হবি ডুকরে কেঁদে ওঠে। আহারে রহম শেখ! সেও কাঁদে!সিটি করপোরেশনের চাকরিওয়ালা রহম শেখ কেন কাঁদে? দিদার আলী রহম শেখকে শক্ত করে ধরে রাখে। আবার জ্ঞান হারায় রহম শেখ।

দুধে পাউরুটি ভিজিয়ে খাওয়ানোর পর, রহম শেখ উঠে বসে। উস্কুখুস্কু চেহারা, চোখগুলো যেন রক্তে নেয়ে উঠেছে, বিড়ালের মতো জ্বলছে ক্লান্ত চোখজোড়া। স্থির বসে থাকে সে একদিকে তাকিয়ে। হবি আস্তে করে বলে, সারাদিন কিছু খান নাই আপনে? কী অইছে? রহম শেখ নিচু গলায় কঠিনভাবে বলে, তুই বাড়ি যা, আমার কিছু অয় নাই। শইল ভালা না। শফিক ধমকে ওঠে হবির দিকে, ওই ছ্যাড়া বাইত যা, দেখতাছস না কিরম গ্যাঞ্জাম? হবি ঘাড়ত্যাড়া কম না, সেও তেড়ে আসে, বাইত যামু ক্যারে? স্যারের কী অইছে না জাইনা আমি যামু না। হবির দিকে তাকিয়ে রহম শেখ মনে করতে পারে না শেষ কবে দেখা হয়েছিল এর সাথে। মাঝেমাঝে তার বিড়ালদের মাছের কাটা দিয়ে যেত হবি, এতটুকুই, রহম শেখ বলেনি কখনও সে নিজের ইচ্ছাতেই দিত। আহারে বেচারা, বিড়ালগুলোকে ভালোবাসে!

রহম শেখের মনে পড়ে, এই ঘরটায় উঠেছিল সময়, আসবাবপত্র কিছুই ছিল না, দু’টো বিড়াল, বিছানা-বালিশ আর একটা কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে একদিন এখানে চলে এসেছিল থাকতে। অফিসের এক স্যারই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, ওভার ব্রিজটা পার হলেই অফিস; যাওয়া-আসায় কোনো সময় নষ্ট হয় না, সংসারে বউ-বাচ্চা নাই, কোনো নেশা নাই, রহম শেখের অফুরন্ত সময়। তাই তার ওপর সবাই অনেক বেশি আস্থা রাখে, আর কেউ করুক বা না করুক, যেকোনো কাজের কথা রহম শেখকে বললেই হয়ে যায়, ম্যাজিকের মতো। এখানে এসে খোলামেলা জায়গা পাওয়া গেছে, বিড়াল দুটো থেকে চারটা হয়েছে। কেটে যাচ্ছে রহম শেখের দিন, শা শা গতির বাস, ঘোড়ার গাড়ি, ঝা চকচকে প্রাইভেট কার, ওভার ব্রিজের নিচে হোটেলের দালাল সব পেরিয়ে রহম শেখ প্রতিদিন ঘরে ফিরে এসেছে। আজকে বিড়ালগুলোকে দেখে চমকে গেছে রহম শেখ। গতকালই অফিসে শুনে এসেছিল, শহরের বিড়ালগুলোর কোনো সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা অস্বস্তিজনক, মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে পারছে না, বিড়াল ধরিয়ে দিতে গেলে, নিজেদের ধরা পড়তে হবে। শহরের অন্তত সাতটি স্পট থেকে নির্ভরযোগ্য খবর পাওয়া গেছে, গত তিন দিনে বিড়াল দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় তেইশ জন। যার ভিতরে মন্ত্রী, পরমাণু বিজ্ঞানী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাবেক বিচারক, টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক এবং একজন ওষুধ কারখানার মালিক রয়েছেন; বাকীরাও চুনোপুটি কেউ নন, সবাই একেকটা রাঘব বোয়াল। ব্যাপারটা এমন না যে, যে যার ঘরে আক্রান্ত হয়েছে; ঘটনাগুলো ঘটেছে হয় কোনো অফিসে অথবা হোটেলে, এবং বিড়ালগুলো কার, সেটাও বের করা যাচ্ছে না। যেমন ধরা যাক, যে পার্শিয়ান বিড়ালের খামচিতে উঠতি এক মডেলের চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো, সেই বিড়ালটা কার? সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে বিড়ালটি ফাইভ স্টার হোটেলের সদর দরজা দিয়েই প্রবেশ করেছিল। মন্ত্রীর ব্যক্তিগত অফিসেও বিড়ালের উপস্থিতি সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে, মন্ত্রীর গালে বিড়ালের নখের দাগ নাকি স্পষ্ট, তিনি ফেসবুকেও কোনো ছবি পোস্ট করেননি গত তিনদিন। কোনো কোনো জায়গায় বিড়াল চা-কফি-মদ ইত্যাদি ফেলে জরুরী কাগজপত্র নষ্ট করেছে বলেও খবর পাওয়া যায়।

রহম শেখ আবার শুয়ে পড়ে। তার দিকে তাকিয়ে থাকে চার জোড়া চোখ। মিনিট খানিক বাদে উঠে বসে; হবি, রফিক-শফিক তার পায়ের কাছে জড়ো হয়ে বসে পড়ে। ‘বিড়ালের সিংহভঙ্গির’ ভিডিওটা বানাইন্না না, এইটা আসল ভিডিও। কিছু কিছু বিলাই সিংহের মতো নামছে এইবার। আমি আজকে ঘরে গিয়া দেখলাম, আমার একটা বিলাই… রহম শেখ থেমে যায়। দিদার আলী জিজ্ঞেস করে, তুমার একটা বিলাই কি? রহম শেখ আস্তে করে বলে, পেপার পড়তাছে। দিদার আলী আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দেয় রহম শেখকে, হবি আর রফিক-শফিক মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে রহম শেখের দিকে; কী চমৎকার ব্যাপার! এইবার সকলেই বুঝবে ঠ্যালা, বিলাই নামছে রাস্তায়! দিদার আলী বুঝতে পারে, একা একা থেকে রহম শেখের মাথায় কিঞ্চিৎ গোলমাল হয়েছে এর বেশি কিছু না। উদাসী ভাবেই বলে ফেলে, বউ-পুলাপান কই তুমার? রহম শেখের একটা বউ তো ছিল, বাচ্চা হয় না বলে ছেড়ে চলে গেছে, নতুন সংসার করেছে, তিনটা বাচ্চাও আছে এখন তার, টঙ্গী থাকে ওরা। মাঝেমাঝে তার বউয়ের বাচ্চাদের স্কুলের সামনে যায় রহম শেখ, যদিও বাচ্চাদের বাবা এটা জানে না। বাচ্চা তিনটা মামা ডাকে রহম শেখকে। রহম শেখ আস্তে করে বলে, নাই। বউ পুলাপান নাই। হবি স্থির থাকতে পারে না; স্যার বিলাইরে পড়া শিহাইলো কেডা? আপনে? রহম শেখ নিচু স্বরে ধমক দিয়ে উঠে, আমি শিখাইতাম ক্যারে? বিলাই কি খালি একটা সিংহ হইছে নাকি? কয়েক জায়গা থেইকা খবর আইছে, অফিসে হুনছি মন্ত্রী মিনিস্টারের গালে খামচাইতাছে বিলাই; কাইল আমার ট্রাক নিয়া বাইর অওন লাগবো বিলাই মারতে! ভাতের লগে বিষ খাওয়াইয়া মারতে হইব এরারে!

ঘরটায় শুনশান নীরবতা নেমে আসে। দিদার আলী কিছুটা টলমল হয়ে যায়। হতেও তো পারে এমন। যেকোনো মিছিলে যোগ দেয়া দিদার আলীর মনে পড়ে তার দোস্ত কামরুলের কথা, কামরুল বলেছিল, বিড়ালও যদি মিছিল নিয়ে বের হয় দিদার আলীকে নাকি সেই মিছিলেও খুঁজে পাওয়া যাবে। দিদার আলীর মন চায় আবার মিছিলে যেতে, বিড়ালদের মিছিলে যেতেও তার আপত্তি নাই, যে বিড়াল রক্তচোষার গালে খামচি দিতে পারে, সেই বিড়ালদের মিছিলে দিদার আলী অবশ্যই যাবে। দেও মিয়া দেও তুমার গরের চাবিডা দেও, আমি দেইক্কা আই বিলাইডি কিতা করে। দিদার আলী রহম শেখের ঘরের দিকে এগিয়ে যায় দ্রুত, আশা করে দেখবে, বিড়ালগুলো অস্বাভাবিক কিছু করছে। পেপার পড়া বা দু’পায়ে দাঁড়ানোর মতো কিছু; কিন্তু না, ঘর খুলে দেখা গেল খাটের নিচে একটা বড় চারকোণা বক্সে আরামসে ঘুমাচ্ছে চারটা বিড়ালই, দিদার আলীকে দেখে একটা বিড়াল মিউ করে ওঠে একটু, এতটুকুই। দিদার আলী নিজের ঘরে ফেরত যায় এবং হবিসহ রহম শেখকে তার ঘরে পাঠিয়ে দেয়। রফিক-শফিককে চলে যেতে বলে দিদার আলী তার ট্রাঙ্ক খুলে কিছু কাগজপত্র বের করে। একটা পেপার কাটিং-এ দেখা যাচ্ছে তরুণ দিদার আলী, মিছিলের সামনের সাড়িতে ডান হাতটা মুঠো করা, আসমান পানে তাক করা; চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছে। আহারে কই গেল সেইসব দিন! বিড়ালটার ‘মিউ’- এর কি কোনো অর্থ আছে? দিদার আলীর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। হয়তো মিউ-এর অর্থ, আমাদের সাথে এসো, অথবা আমাদের বাঁচাও; প্রাণিগুলো কি টের পেয়ে গেছে কাল যে তাদের মেরে ফেলা হতে পারে? রহম শেখ কী করবে কাল? দিদার আলী টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিছু বিড়াল মাথায় কাফন বেঁধে, হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ছে; দিদার আলী অস্ত্র, গোলা-বারুদ সাপ্লাই দিচ্ছে— এমন স্বপ্ন দেখে সে ঘুমের মধ্যে।

অনলাইনে আরও কিছু ছবি-ভিডিও ভাইরাল হয় রাতারাতি। ট্রাফিক সার্জেন্টের হাতে খামচি দিয়ে ঝুলে থাকা বিড়ালের ছবিতে তিরিশ হাজারের ওপর ‘হা হা রিঅ্যাক্ট’ পড়ে। একটা ভিডিওতে দেখা যায় বিড়াল দেখেই দৌড়ে পালাচ্ছে এক ব্যক্তি বিড়ালও সিংহের মতো ছুটছে তার পিছু পিছু; ব্যক্তিটির পরিচয় পাওয়া যায়নি, তবে এতেও লোকে মজা পায়, প্রচুর লাইক পড়তে থাকে। একটা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের পা কামড়ে ধরে বিড়াল, আর শিক্ষক তাকে এক পা দিয়ে চেপে ধরে আরেক পায়ে লাথি দিতে দিতে প্রায় আধমরা করে ফেলেন বিড়ালটিকে— এই ভিডিওতে প্রচুর স্যাড রিঅ্যাক্ট দেয় লোকে, কান্নার স্টিকার কমেন্ট করে তারা। এর ভিতরে একটা গ্রেপ্তারের খবর বেশ জটিল করে তুলেছে পরিস্থিতি, গত রাতে বিড়াল কোলে নিয়ে আদুরে একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করায় লন্ডন থেকে ছুটি কাটাতে আসা এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে সকালে তুলে নিয়ে যায় কে বা কারা, এরপর রাতে র‌্যাব তাকে গ্রেপ্তার দেখায়, বলা হয় সে তার বারান্দায় গাঁজা চাষ করছিল; যদিও অনলাইনের লোকদের বুঝতে অসুবিধা হয় না— ব্যাপারটা ওই ছাত্রী আর বিড়ালের ছবিতে পড়া অস্বাভাবিক পরিমাণ লাভ রিঅ্যাক্ট, আর কিছুই না! বিড়ালের পক্ষে প্রচুর পেজে লাখ লাখ লাইক পড়তে থাকে, অন্যদিকে, মানুষ যে কত গাধা, এডিটেড ইমেজ আর ভিডিওতে কেন বিশ্বাস করছে, করা উচিত না— এমন শিক্ষা ও জন সচেতনামূলক কিছু পেজও দেখা যায়, তাতেও লাইক কম পড়ে না। অফলাইনে হয়তো আরও অনেক কিছুই হয়, হয়তো তা কারও ক্যামেরাই নাগাল পেয়ে ওঠে না।

দিদার আলী সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই মাছের বাজারে যায়, আধা কেজি টেংরা মাছ কিনে আনে। মাছগুলো হলুদ আর লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে রহম শেখের ঘরের দিকে এগোয়, মনের মধ্যে একটা অসম্ভব আশা। দরজাটায় তালা দেয়া, আজকে রহম শেখ তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেছে। জানালার ধারে গিয়ে ঘরের ভিতরে উঁকি দিয়ে, মুখ দিয়ে অনভ্যস্ত ‘মিউ মিউ’ শব্দ করে বিড়ালগুলোকে খুঁজতে থাকে দিদার আলী আর হয়তো সেটাই তার কাল হয়; রহম শেখের বিড়ালগুলো পাওয়া যায় না তবে কোথা থেকে তিন চারজন গাট্টাগোট্টা লোক এসে দিদার আলীকে ঘিরে ধরে, জিজ্ঞেস করে, হাতে কী? দিদার আলীর কপাল ঘেমে যায়, আস্তে করে বলে, মাছ। আরও কর্কশ হয় ওদের গলা, কী মাছ? দিদার আলী কোথা থেকে যেন শক্তি পেয়ে যায়, সেও জোরে গলা ছাড়ে, টেংরা মাছ সিদ্ধ, কী মাছ হেইডাও কওন লাগবো? দেকতাছুইন না?

মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় দিদার আলীকে। রফিক-শফিক তখনও স্টেশনে আসেনি। হবি ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে কারবারটা দেখে, ছুটে গিয়ে জানায় রফিক-শফিককে। ‘বিড়ালকে মাছ খাওয়াতে গিয়ে আটক চা বিক্রেতা দিদার আলী’ এমন একটা খবর অনলাইনে ভাইরাল করার চেষ্টা করে দুজনে সারা দিন ধরে। ওভার ব্রিজের নিচে চেয়ার পেতে বসা লোকদের ভিতরে কেউ কেউ এসে শাসিয়ে যায় ওদের, অনলাইনে কাবজাব করতে না করে দেয়। বিকালবেলা চা ঘরটায় গিয়ে বসে রফিক-শফিক, দিদার আলী নেই। বালক হবি মুখ শুকনা করে বসে থাকে। রহম শেখের ফিরে আসার অপেক্ষা করে ওরা।

রহম শেখ ফেরে প্রতিদিনের মতোই, আস্তে আস্তে স্টেশন পেরিয়ে চা ঘরটার দিকে আসতে থাকে, তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ায় ওরা। রহম শেখের চোখজোড়া শুন্যতায় ঠাসা, ধীরে এগিয়ে এসে চা ঘরের বেঞ্চটায় বসে পড়ে; ওরা তিনজন তার পায়ের কাছে জড়ো হয়ে আসে, রহম শেখের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া নাকমুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। রহম শেখ বলে, একা একাই বলে, কোনো উত্তর চায় না এমনভাবে কম্পিত কণ্ঠে বলে, সারাদিনে এক ট্রাক মারছি আমরা যারা ছিলাম, সারা শহরে এরম তেরো ট্রাক মারা হইছে। আইজকা খবরে দেখবি, জলাতংক রোগের হাত থেইকা বাঁচতে বিলাই মারা হইছে, দ্যাশবাসি খুশি, তোরাও খুশি থাক। হবি কাচুমাচু মুখে বলে, দিদার দাদায় কই কিছু জানেন? রহম শেখ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, এরপর তার বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলতে থাকে, আর দিদার আলী… বাকিটুকু শুনতে পাওয়া যায় না। যে রহম শেখ প্রতিদিন স্টেশন পেরিয়ে, চা দোকান পেরিয়ে, হেঁটে হেঁটে চলে যায় কাউকে না দেখে, কারও সাথে বাক্য বিনিময় না করে; ঠিক সেই রহম শেখ উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে গিয়ে নিজের ঘরের তালা খুলে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আর কখনও মাছের কাটা দিতে হবি সেই ঘরের দিকে যায় না। রফিক-শফিক তাদের অলক্ষ্মী স্মার্টফোনটি বিক্রি করে দিয়ে কিছুদিন ইয়াবা ব্যবসা করে; নিজেরাও খায়, খেয়ে পড়ে থাকে।

*গালিটার ঋণ শামীম ওসমানের কথিত কল রেকর্ডিং