
অমিতাভ পালের গদ্য ‘পৃথিবীর জাতীয়সঙ্গীত’
প্রকাশিত : এপ্রিল ২৭, ২০২১
দেবতা বন্দনা দিয়েই শুরু হয়েছিল কবিতার যাত্রা। মানুষ তখনো অসহায় প্রকৃতির কাছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি তাকে দিশাহারা করে, বাঁচায়। যেসব শক্তি তাকে থামিয়ে দেয়, ধ্বংস করে— তাদেরকে সে অসুর বলে ভাবে। আর যেসব শক্তি তাকে সাহস দেয়, বাঁচার পথ সুগম করে তোলে— তাদের ভাবে দেবতা। সেই দেবতাদের তুষ্ট করতে সে মনের ভিতরে জমে ওঠা ভয় আর ভালোবাসা দিয়ে মাখা তার গভীরতম কথাগুলি নিবেদন করে, গান গায়, নাচে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সেই কথাগুলি সংহত হয়, সহজে মনে রাখা আর উচ্চারণের স্বার্থে তারা পরিণত হয় মন্ত্রে, সংক্ষিপ্ততম চেহারায় তারা হয়ে ওঠে বৃহত্তম ব্যঞ্জনা। এই মন্ত্রগুলিই আদি কবিতা।
তারপর একসময় মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়তে শুরু করেছে এবং সে বুঝেছে প্রাকৃতিক শক্তিগুলির কার্যকারণ। তখন সে সামাজিক হয়েছে আর সমাজের ভালোমন্দের ভার তুলে দিয়েছে তাকে পথ দেখানোর জন্য অগ্রগামী চিন্তা ও সাহসে দীপ্ত কারো হাতে— যে নিয়েছে নেতার দায়িত্ব। নেতাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, ভূমিকা ও যুদ্ধজয়ে যখন সে পেয়েছে জীবনকে সুগম করার পথ, তখন নেতাদের তুষ্ট করতেও সে তৈরি করেছে মন্ত্র, গান, সঙ্গীত। আর কবিতা পেয়েছে বিকাশের নতুন পথ। এদিকে সময়ের বিবর্তনে নেতারা হয়েছে রাজা, সম্রাট, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং কবিতাও গেছে তাদের প্রশংসার পথে। আর যেতে যেতে একসময় সে আটকে গেছে একঘেঁয়ে ও একমুখী মন্ত্রের বিষণ্ন স্থবিরতায়।
এই স্থবিরতা থেকে কবিতাকে মুক্তি দিয়েছিল প্রেম। নারী-পুরুষের সম্পর্কের যৌন উপস্থাপন যখন আরো বিচিত্র পথে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো, যখন যৌন আকর্ষণ মানসিক টানে বিবর্তিত হলো— মানুষের মনের আবেগ তার অকথিত কথাগুলিকে সমর্পণের এক নতুন ভাষা দিল। এই ভাষা কবিতাকেও দিল এক নতুন গতি, যা এতদিন ধরে জমে ওঠা গণ্ডির গ্লানিকে চুরমার করে দিয়ে তাকে মিশিয়ে দিল নদীর যৌবনে। ফলে পাহাড় থেকে তিরতির করে নামতে থাকা এক প্রাচীন ঝর্না পেল মুক্তির এমন এক স্বাদ, যা তাকে চেনালো বিস্তীর্ণতা, স্রোত আর বহুত্বকে।
আসলে প্রেম কবিতাকে পবিত্র মন্ত্র থেকে সরিয়ে পৌঁছে দিয়েছিল সাধারণ মানুষের কাছে। আর এতেই কবিতার জিহ্বায় লেগেছিল এক নতুন স্বাদ, যা তাকে আরো আরো নতুন রান্নার লোভে লোভী করে তুলেছিল। এই লোভ তাকে নিয়ে গেছে জনতার অভ্যন্তরে এবং সে টের পেয়েছে রাজা, সম্রাট, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর ঘেরাটোপ বড় নির্জীব। বরং জনতা অনেক ঝলমলে। এখানে সমস্ত আকাশভরা আলো আর অন্ধকার, বাতাসে সুমিষ্ট অক্সিজেন আর কার্বন ডাই অক্সাইডের বিষ, এখানে আনন্দ-বিষাদ-রাগ আর মিলনের এক অদ্ভূত ঐক্যতান, এখানে জীবন। কবিতা এই জীবনের কাছে এসে আর পিছিয়ে যেতে চায় না।
এখনকার কবিতা তাই জনতাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়। তৈরি হয় বাস্তবতার ইটপাথরে আর আবেগের সিমেন্টে। এখানে দলবদ্ধ হয়ে বাস করে মানুষ, প্রাণ ও প্রকৃতি। মহাশূন্যের নির্মম শীতলতার ভিতরে ঢুকে এখানে তৈরি হয় এমন এক অগ্নিকুণ্ড, যা নক্ষত্রগুলির কথা মনে করিয়ে দেয়। জন্ম দেয় প্রাণধারণ করবার মতো গ্রহের, মায়ের মতো গাছপালার, ভাইয়ের মতো নদীর, আত্মীয়ের মতো গ্রামের।
এখনকার কবিতা স্টেডিয়ামভরা জনতার গুঞ্জরনের মতো বহুস্বর। এতে সবাই কথা বলে, সব প্রাণ, সব জীবন, সব বস্তু। আর এদের ঐক্যতানের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে পৃথিবীর জয়গান। এখনকার কবিতা পৃথিবীর জাতীয়সঙ্গীত।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক