কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

পর্ব ২১

প্রকাশিত : জুলাই ২০, ২০২৫

জসীম উদদীন পরিষদে গিয়ে পরিচয় হয় আলাউদ্দিনের সঙ্গে, যদিও শিশুশিল্পী আলাউদ্দিনের গান বাড্ডা আলাতুন নেসা স্কুলের মাঠে আগেই শুনে মুগ্ধ হয়েছি। আলাউদ্দিনের সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে। তখন বিষয়টা এমন ছিল, বন্ধুত্ব মানে সারাদিন একসঙ্গে কাটানো। আমি আর আলাউদ্দিন প্রায় সারাদিন একসঙ্গে কাটাই। আলাউদ্দিনদের বাসায় গেলে ওর বড় ভাই সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। সালাহ উদ্দীন আমার চেয়ে এক ক্লাস নিচে পড়ত, কিন্তু আমার সব বন্ধুই ওর বন্ধু, কাজেই সেও আমার বন্ধু হয়ে গেল।

সালাহ উদ্দিন ছিল বাড্ডার ত্রাস। ওর বন্ধু-বান্ধব সকলেই প্রায় সন্ত্রাসী ধরনের। মারামারি, খুন-খারাবী এইসব ওদের নিত্যদিনের ঘটনা। সালাহ উদ্দিনের সঙ্গ আমাকেও সেই পঙ্কিল পথে টেনে নেয় কিন্তু ধরে রাখতে পারে না। আমরা দুজন দুই বিপরীত মেরুর মানুষ। সালাহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগও আছে। স্কুলে পড়ার সময়েই সে এইসব অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়। ওর সঙ্গে সবসময় একটা সেভেন গিয়ার ছুরি থাকত। পরে সালাহ উদ্দিন তিতুমীর কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে ও জিএস নির্বাচিত হয়। ওরা আওয়ামী পরিবার, সবসময় আওয়ামী লীগ করত। ছাত্রলীগ থেকেই সে জিএস নির্বাচিত হয়।

সালাহ উদ্দিন যেমন আমাকে টানত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দিকে, আমি ওকে টানতাম শিল্প-সাহিত্যের দিকে। ওর বন্ধুদের আড্ডায়, যেখানে বাড্ডার সেরা সন্ত্রাসীরা বসত, ও আমার শিল্প-সাহিত্য নিয়ে হাসি-তামাশা করত। মাঝে মাঝে মাইগ্যা বলেও খেপাত। ওদের কাছে শিল্প-সাহিত্য হচ্ছে অনেকটা মেয়েলি কাজ। শান্তিনিকেতন নিয়ে একটা জোক আছে। ওখানকার ছেলেরা নাকি পথের ওপর গরু দেখলে ফুল ছুঁড়ে দিয়ে বলে, `এই গরু যাহ`। এই জোক বলেও ওরা আমাকে খেপাত।

ওদের যে জিনিসটি আমার সবচেয়ে খারাপ লাগত তা হচ্ছে ওরা কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলত না। দেখা গেল আমাদেরই কোনো এক বন্ধুর আব্বাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, ওরা তার নাম ধরে তুই-তোকারি করে কথা বলছে। কোনো বন্ধুর মা`কে নোংরা ভাষায় গালি দিয়ে কথা বলছে। ওদের কাছে কোনো মানুষই সম্মানিত না, সকলেই তুই তোকারি। আরো একটা খারাপ কাজ ওরা করত, কোনো একটি রিক্সা কিংবা বেবিট্যাক্সি নিয়ে সারাদিন ঘুরত, বিকালে পয়সা না দিয়ে নেমে যেত। পয়সা চাইলে চড়-থাপ্পড় মারত। ওরা সারারাত বাড্ডার অলি-গলিতে হাঁটত আর নানান অপকর্ম করত।

খিদে পেলে কোনো বাড়ি থেকে অনেকগুলো হাঁস-মুরগি ধরে নিয়ে আসত। সেগুলো এনে মাঝরাতে কোনো এক রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের ডেকে তুলত। বলত, রান্না কর। তারপর সবাই মিলে খেত, ফেলত, ছোড়াছুড়ি করত।

আমি ওদের দল থেকে ছুটে যেতে চাইলে সালাহ উদ্দিন কিছুতেই আমাকে ছুটতে দিত না। আমার সাহচর্য ওকে আনন্দ দিত এই কারণে, আমার সহযোগিতায় ও সন্ত্রাসে শিল্পের সমন্বয় ঘটাতে পারছে। যেমন কাউকে টাকার জন্য থ্রেট দিবে, আগে যা গালিগালাজ দিয়ে করত, এখন সে সুন্দর ভাষায় চিঠি দিয়ে করে এবং সেই চিঠি ড্রাফট করে দিতে হয় আমাকে। ওদের নানান সাংকেতিক বিষয়ের জন্য আমার কাছে শব্দ চায়, আমি শিল্পসম্মত বাংলা শব্দ দেই, ওরা দারুণ খুশি হয়। সালাহ উদ্দিন টেরই পায়নি ওর সন্ত্রাসী চরিত্রের ওপর আমি ওর অজান্তেই একটি শিল্পের কোট লাগিয়ে দিচ্ছি।

কেন্দ্রীয় ভূমি বরাদ্দ কমিটি ১৯৬১ সালের ২১ অক্টোবর এক সভায় বৃহত্তর ঢাকায় আবাসনের জন্য ভোলা, মহাখালী, করাইল, লালা সরাইল, উলুন, ভাটারা, বাড্ডা, সামাইর, জোয়ার সাহারা ও সুতিভোলা মৌজায় ২৭৬০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব অনুমোদন করে। বাড্ডার, বিশ্বরোডের দুই পাশের, প্রায় সকল জমিই অধিগ্রহণ করে রাখে সরকার। ব্যক্তিগত জমির মালিকেরা সব সময় একটা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাত। কবে না জানি উচ্ছেদ নোটিশ চলে আসে। টাকা থাকলেও কেউ পাকা দালান করতে পারছে না, ডিআইটি অনুমোদন দেয় না। জমির দাম বাড়ছে না। সবাই খুব অস্বস্তিতে আছে।

আমি ওদের দুই ভাইকে বলি, চলো আমরা একটি পত্রিকা বের করি, যে পত্রিকাটি হবে বাড্ডা অবমুক্তির হাতিয়ার। সালাহউদ্দিন হাসে।
আমি পত্রিকার কী বুঝি। কারে পিটাইতে হবে হেইডা কও।
আলাউদ্দিন বলে, ভাই, তোর কিছু করা লাগবে না। জহির ভাই আছে না। উনিই সব করবো, তুই খালি আমগো লগে থাকবি, আর বিজ্ঞাপন জোগাড়ের জন্য আমরা যখন এলাকার দোকানগুলিতে যামু, তুই আমগো লগে যাবি। তোরে দেখলে সবাই বিজ্ঞাপন দিব।

সালাহউদ্দিন খুশি হয়। ও বুঝতে পারে পত্রিকার ফান্ড জোগাড়ের জন্য ও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
পত্রিকার নাম কী হবে?
আমি বলি, সতর্ক।
ব্যাস, শুরু হয়ে গেল সতর্ক পত্রিকার কাজ।

এলাকার সাংসদ তখন জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী একেএম রহমতুল্লাহ। পরে যিনি হাসিনার আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আমরা টেলিফোনে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করে তার গুলশানের বাড়িতে যাই। সতর্ক পত্রিকার জন্য তার সাক্ষাৎকার নেই। বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সাঁতারকুল ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান, মোজাম্মেল হকের সাক্ষাতকার নেই। মোজাম্মেল হক গভর্নর মোনায়েম খানকে ১৯৭১ সালে দুধওয়ালা সেজে গুলি করে হত্যা করেন। এটিই তার বীরত্ব হিসেবে এলাকায় প্রচলিত ছিল।

আব্দুল আলী ছিলেন বাড্ডার পৌর ওয়ার্ডের চেয়ারম্যান, তখনও সিটি কর্পোরেশন হয় নাই। একদিন আব্দুল আলীরও ইন্টারভিউ নেই। এই তিনজনের মধ্যে মোজাম্মেল হকের সাক্ষাৎকার নিয়ে সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছি। অন্য দুজনকে গণ্ডমূর্খ মনে হয়েছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে অযথাই হয়ত সময় নষ্ট করেছি। আমি খুব কড়া কড়া প্রশ্ন করতাম। আব্দুল আলীকে বলি, আপনি এত ডিগবাজি খান কেন? শেখ মুজিবের দলে ছিলেন, জিয়ার দলে ছিলেন, এখন আবার এরশাদের দলে যোগ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ভুল। তোমরা কিছুই বোঝো না,আমার দল একটাই, সরকারি দল। ছাগলের ৩টা বাচ্চা দেখছো? দুইটা দুধ খায় আর তিন নাম্বারটা না খায়া লাফায়। আমি হইলাম এক নাম্বার বাচ্চা। সব সময় দুধ খাই। ওরা হইলো তিন নাম্বার বাচ্চা, না খায়া লাফায়।

তিনি আসলে গুলশান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওসমান গণিকে, যিনি তার সারা জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বী, তাকে ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা বলেছেন। পত্রিকায় তার এই সাক্ষাতকার ছাপা হওয়ার পরে আওয়ামী লীগের লোকেরা আব্দুল আলীর ওপর চড়াও হয়। অন্যদিকে তার ছেলে বন্দুক নিয়ে আমাদের তিনজনকে খুঁজতে বের হন।

আমি ছিলাম পত্রিকাটির সম্পাদক, সালাহ উদ্দিন ছিল সহকারী সম্পাদক আর আলাউদ্দিনকে বানিয়েছিলাম বোর্ডের সভাপতি, যদিও বোর্ডে আর কোনো সদস্য ছিল না।

আমরা বাড্ডার ঘরে ঘরে গিয়ে পত্রিকা দিয়ে আসতাম। এক টাকা করে বিক্রি করতাম। দরোজায় টোকা দিলেই সবাই এক টাকা দিয়ে কাগজটা কিনে নিত। অনেক মুরুব্বি, অনেক খালাম্মা আমাদের জড়িয়ে ধরে আদর করতেন। বলতেন, এই বয়সে তোমরা এমন একটা সাহসী কাজ করছ, অনেক অনেক দোয়া করি তোমরা যেন সফল হও।

মোজাম্মেল হক খুব সাহসী মানুষ। শুনেছি, এরশাদ বাড্ডায় আসবেন। সেই অনুষ্ঠানে মোজাম্মেলও ভাষণ দেবেন। আমরা মোজাম্মেলের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করি তিনি অধিগ্রহণ তুলে নেবার জন্য এরশাদকে চাপ দেবেন। তিনি তা করেছিলেন। তিনি এরশাদকে মঞ্চে রেখেই, দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, মাননীয় রাষ্ট্রপতি আপনি যদি অধিগ্রহণ তুলে নেবার ঘোষণা দেন তাহলে এই যে বিশাল জনসমুদ্র দেখছেন আমরা সবাই আপনার পাশে দাঁড়াবো, সবাই জাতীয় পার্টিতে যোগ দেব আর যদি না তুলে নেন তাহলে কেউ আপনার পাশে থাকবো না, সবাই আপনাকে প্রত্যাখ্যান করব।

একজন স্বৈরশাসককে মঞ্চে বসিয়ে রেখে এরকম চাছাছোলা বক্তব্য দেওয়া সহজ কাজ ছিল না। এরশাদ সেদিন বাড্ডাকে অবমুক্ত করার ঘোষণা দেন, এবং পরবর্তী বেশ কিছু বছরে তা কার্যকর হয়।

এমন না যে শুধু আমাদের কারণেই এটা হয়েছে, সকল বাড্ডাবাসীর এটা প্রাণের দাবি ছিল, তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন ছিল এবং নানানভাবে সবাই অধিগ্রহণের গ্রাস থেকে অবমুক্ত হবার চেষ্টা করছিল। তবে এটা আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি আমার সম্পাদিত সতর্ক পত্রিকা সেই বিশাল কর্মযজ্ঞের ক্যানভাসে একটা ছোট্ট আঁচড় হলেও দিতে পেরেছিল।

সব তো ভালো ভালো কথা বললাম। এবার কম বয়সের কিছু চারিত্রিক দুর্বলতার কথা বলি। সতর্ক পত্রিকা বের করে আমাদের হাতে যে টাকা-পয়সা আসত তা দিয়ে আমরা ভালো ভালো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতাম। প্রায় প্রতিদিনই রেস্টুরেন্টে বসে খাসির মাংস দিয়ে ভাত খেতাম। অবশ্য পত্রিকার জন্য এত ছোটাছুটি করতাম যে বাসায় গিয়ে খাওয়ার সময় পেতাম না। একদিকে ভালো খাওয়ার লোভ আবার অন্যদিকে নৈতিক বোধ, এই দুইয়ের একটা টানাপোড়েন তখনই আমি অনুভব করতাম। মনে হতে পত্রিকার টাকায় এইভাবে খাওয়া-দাওয়া করাটা বুঝি অন্যায় হচ্ছে। চলবে