
শিক্ষা ও শিক্ষকরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুলাই ১৯, ২০২৫
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানসিকতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে একটু বলা দরকার। শিক্ষার্থীকে শিক্ষকরা বলে দিচ্ছে, মৌখিক পরীক্ষার দিন প্যান্ট-শার্ট-টাই পরে আসতে হবে। সেটা নাকি স্মার্টনেসের লক্ষণ। ছাত্রীদের বলে দেয় অমুক দিন অমুক রঙের শাড়ি পরে আসতে হবে। এক ছাত্রী হঠাৎ আমাকে জানালো, সেই রঙের শাড়ি তার নিজের না থাকায় বান্ধবীর শাড়ি ধার করে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় গিয়েছিল। গতকালকে বৃষ্টিতে সে শাড়ি কাদা লেগে একাকার। খুব স্বাভাবিক যে, এখন বান্ধবী চটে বসে আছে। কথাটা হলো, এইরকম হীনমন্যতা নিয়ে শিক্ষকরা কোথা থেকে আসে টাই শাড়ি ছাড়া স্মার্ট হওয়া যায় না।
নিজে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে অনেকবার দেখেছি ছাত্রীরা সবাই সেদিন শাড়ি আর ছাত্ররা সবাই টাই পরে এসেছে। বাংলাদেশের কজনের ঘরে টাই আছে, কজন প্রতিদিন টাই পরিধান করে? খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, বহু শিক্ষার্থী ধার করে হঠাৎ টাই পরে মৌখিক পরীক্ষা দিতে এসে আরো বেশি স্নায়ুচাপে পড়েছে। যখন জিজ্ঞেস করলাম, ছাত্ররা বলল শিক্ষকদের নির্দেশ। শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করলাম, বলল স্যার স্মার্ট হওয়ার জন্য বলেছি।
বললাম, শিক্ষার্থীরা ঠিকমতন পড়াশুনা না করলে আর মানসিকভাবে সাহসী না হলে কি শাড়ি টাই পরে স্মার্ট হতে পারে? তারা বলল, স্যার এটা নিয়ম। জানতে চাইলাম কার নিয়ম, কোথায় লেখা আছে? তারা আবার জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ স্যার এটা নিয়ম। বললাম, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশুনা করেছি, আমাদেরকে তো কখনো এরকম বলা হয়নি। শিক্ষকরা সবাই একজোট হয়ে জোরালো ভাষায় বলল, আমরা এইভাবে ছাত্রদের স্মার্ট বানাতে চাই। দেখছেন না ওরা প্রতিদিন কীসব পোষাক পরে আাসে।
খুব বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, টাই পড়লেই স্মার্ট হওয়া যায়? সামান্য সংশয় ছাড়া তারা বলল, `হ্যাঁ স্যার যায়`। তখন আমি বললাম, সৌদি আরবের রাজা বাদশারা টাই পরে না বলে কি কম স্মার্ট? বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী টাই পরেন না, সস্তা জামা প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ান, তিনি কি আপনাদের চেয়ে কম স্মার্ট? কিছু এরকম উদাহরণ দিলাম, তবে তাদের কারো কানে পানি গেল না। টাইয়ের প্রতি তাদের ঝোঁক দেখে আমি বিস্মিত হলাম।
ভিতরে ভিতরে আমার সম্পর্কে তাদের ভাবখানা, `স্যার, সহজ ব্যাপারটা না বুঝেই আপনি শিক্ষকতা করতে এসেছেন`। যারা বলছে তারা কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বাংলাদেশের প্রথম চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি, তাদের পরিবার খুব স্বচ্ছল তা নয়। সত্যি বলতে একজনের বাবা ছিলেন গ্রামের কাঠমিস্ত্রি। শ্বশুরের কাছ থেকে যৌতুক নিয়ে বিয়ে করেছে এবং শ্বশুরের দেয়া কমপ্লিট স্যুট পরে মাঝে মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর কাঁপিয়ে হাঁটতে থাকে।
সবার পরীক্ষা নেয়ার পর দেখা গেল, পঁচাশি শতাংশর কেউ কোনো প্রশ্নের জবার দিতে পারছে না। বাংলা সাহিত্যের সপ্তম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী এরা। টাই পরা স্মার্ট শিক্ষার্থীরা পঁচাশি শতাংশ একটা প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারল না। যখন প্রশ্নের জবাব দিতে পারছে না, তখন তাদের পরীক্ষা সহজ করে দিলাম। বললাম, গত সাতটা সেমিস্টারে কী কী বই পড়েছেন তার কিছু নাম বলেন। এই প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া গেল না। শিক্ষকদের বললাম, টাই পরে স্মার্ট হওয়া যায় না। শিক্ষার্থীদের প্রধান স্মার্টনেস হচ্ছে পড়াশোনায় ধারালো হওয়া।
সত্যিকারভাবে দেখা গেল, পঁচাশি শতাংশ একটা বইয়ের নাম পর্যন্ত বলতে পারলো না। মানে তারা বইপত্র পড়ে না। গত দিন ষষ্ট সেমিস্টারে একই ঘটনা দেখেছি। বাকি পনেরো শতাংশ যারা কিছুটা ভালো, তারাও দুটা বা তিনটার বেশি বইয়ের নাম বলতে পারলো না। যারা কদিন পর স্নাতক সম্মানের সনদপত্র পাবে গত সাড়ে তিন বছরে তাদের একটা বই পাঠ করার দরকার পড়েনি। কিন্তু কৃতকার্য হয়ে পরের সেমিস্টারে ঠিকই উঠে গেছে। সাহিত্য পাঠ না করেই সব সাহিত্যের স্নাতক।
সেদিন মৌখিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের পঁচাশি শতাংশের কিছুতেই কৃতকার্য হতে পারার কথা নয়। অন্তত আমার উপস্থিতিতে। শিক্ষকরা নিজেরাই সেটা বুঝতে পারলো। তিন শিক্ষক এবার কিছুটা নত হলো আমার কাছে। কারণ তাদের ছাত্রছাত্রীরা পাশ করতে পারছে না। শিক্ষকরা এবার তাদের ছাত্রছাত্রীদের পাশ করিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ আর অনুনয় বিনয় আরম্ভ করলো। শিক্ষকদের চরিত্র দেখে আমি বিস্মিত হলাম। পুরো ঘটনাটা আর না বলি।
শিক্ষার্থীদের কি দোষ দেওয়া যাবে এই ঘটনার জন্য? শিক্ষার্থীরা বই না পড়ে যখন পাশ করতে পারছে, পড়ার দরকার কী। যদি শিক্ষকরা নিজেরা পড়াশোনা করতেন এবং যথাযথভাবে ছাত্রদের পাশ করাতেন তাহলে এমন হবার কথা ছিল না। পরে দেখলাম, এরা নিজেরাই কিছু পড়ে না, জানে না। জানার আগ্রহ নেই, শিক্ষকতা মানে মাস গেলে বেতন নেয়া। ভিন্ন দিকে যা জানে, টাই পরলেই স্মার্ট দেখায়। কারণ টাই পরাটা এদের স্বপ্ন।
দুঃখজনক কয়েকটা কথা বলে আপাতত শেষ করছি। বাংলা সাহিত্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক সম্মান, স্নাতকোত্তর সনদপত্র লাভ করে শিক্ষকতা করতে এসেছে। তিন জন এমন শিক্ষকের সঙ্গে একবার একত্রে বসে গল্প করতে গিয়ে দেখলাম, এরা রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার গল্পের নামটাই শোনেনি। কিছুদিন আগে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বললাম, বঙ্কিমের `বঙ্গদেশের কৃষক` পড়তেই হবে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছে গিয়ে বলল, বঙ্কিমের বঙ্গদেশের কৃষক লেখাটা কোথায় পাওয়া যাবে।
সম্মানিত শিক্ষরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের বলল, `বঙ্কিমচন্দ্রের এমন শিরোনামে কোনো লেখাই নেই। শিক্ষার্থীরা সেইমত আমাকে এসে জানালো, বঙ্কিমের এমন কোনো লেখা নেই। কারণ মহামান্য শিক্ষকরা এটা তাদের জানিয়ে দিয়েছে। আমি গ্রন্থাগার থেকে বঙ্কিমের রচনাবলী আনালাম। শিক্ষার্থীরা তখন দেখতে পেল, এই নামে লেখা আছে। জাহাঙ্গীরনগর থেকে পাশ করা একজন শিক্ষক বাকিদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেছিল, এরকম লেখা থাকতেই পারে না। কখন এরকম লেখার কথা শুনিনি।
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ