স্বাধীন খসরুর গদ্য ‘নীল রাত্রি ও নুহাশ পল্লী’

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জুলাই ১৯, ২০২৫

১৯ জুলাই হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণ দিবস। আমি ১৮ জুলাই রাত ১২টায় নুহাশ পল্লীতে পা রাখলাম। শুধু শ্রদ্ধা জানাতে আসিনি, এসেছি একটা অদ্ভুত টান থেকে। নাম ধরে সেই চিরচেনা ডাক শুনতে।

নুহাশ পল্লীর আকাশটা অদ্ভুত ছিল। মেঘ ছিল না, কিন্তু চারদিকে ভেজা। যেন অদৃশ্য কোনো বৃষ্টি এই জমিনে প্রতিদিন নামে। আর এদিকে শুধু গাছ নয়, বাতাসও যেন কথা বলছে তাঁর লেখা দিয়ে।

মনে হচ্ছিল, গেট পেরোনোর পর অন্য একটা জগতে পা রেখেছি। পাখির ডাক, হলুদ পাতার শব্দ আর দূরে কোথাও এক ধরনের ভাসা-ভাসা বাঁশির সুর ভেসে আসছে।

আমি হাঁটছিলাম লিচু বাগানের দিকে। হঠাৎ পেছন থেকে কার যেন গলার আওয়াজ পেলাম...ভীষন চেনা, ভীষণ প্রিয়। আমার নাম ধরে ডাকটা! শুনতেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম।

পেছনে ফিরে দেখলাম, সুইমিংপুলের পাশে একটা স্টিলের চেয়ার। আর তাতে বসা একজন মানুষ। হলুদ পাঞ্জাবি, নরম হাসি আর চোখে এক আশ্চর্য চাহনি।

আমি থমকে গেলাম, আপনি... এখানে! আমি নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছি।
তিনি হাসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এসেছো স্বাধীন?

ইশারায় বসতে বললেন, তুমি তো সেই, তোমাকে আমি উৎসর্গ করেছিলাম ‘সে আসে ধীরে’ একটা অসমাপ্ত অনুভব।

আমি কথা হারিয়ে ফেলেছি। কিছু বলতে পারছিলাম না। শুধু অনুভব করছিলাম, এ যেন স্বপ্ন নয়, গল্প নয়, এ আমার সত্যি।

এটা কি? স্বপ্ন? বিভ্রম?
তিনি বললেন, ভয় পেয়ো না। মাঝে মাঝে লেখকেরা ফিরে আসে, যাদের অসমাপ্ত গল্প থাকে।

জিগ্যেস করলাম, আপনার কি অসমাপ্ত কোনো গল্প ছিল?
তিনি বললেন, একটা চরিত্র, যে নিজের চোখেই আমাকে দেখতে পাবে। আমার একটা অসমাপ্ত গল্প আছে। শেষ করতে পারিনি! আমরা একটা গল্প লিখবো একসাথে। শুরুটা আমি করব, শেষটা তুমি দেবে। গল্পটা শুরু হচ্ছে এমন, একজন লেখক, মৃত্যুর পরও ফিরে আসে। কারণ তার প্রিয় পল্লী তাকে ভুলতে চায় না। অসমাপ্ত গল্প তাকে বারবার ডাকে।

চারপাশের গাছেরা নড়ছিল না। বাতাস থেমে গিয়েছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সব চরিত্র লেখকের তৈরি হয় না। কিছু চরিত্র লেখককে খুঁজে নেয়। এখানেই শুরু হয়েছিল আমার শেষ লেখা।

বাইরে হালকা বৃষ্টি নেমেছে, হালকা টুকটাক শব্দ। মাথায় হুমায়ূন আহমেদের অসমাপ্ত সেই গল্প, কিন্তু আমার ভেতরে এক নতুন গল্প জন্ম নিচ্ছে। যে গল্পে আমি আছি, হুমায়ূন আহমেদ আছেন, আর আছে সেই অসমাপ্ত জাদু, যা কেবল অনুভব করা যায়, লেখা যায় না।

নিজের অজান্তে আমার দু`চোখ বন্ধ। কতক্ষণ খেয়াল নেই। হঠাৎ আবার সেই ভীষণ চেনা ডাক, স্বাধীন?
চোখ খুলে দেখি, তিনি নেই! চেয়ার খালি। চেয়ারে ছোট একটা চিঠি।

হিমু,
এই নুহাশ পল্লীতে যত রাত নীল ততবার আমি তোমাকে ফিরে আসতে বলব। আমার অসমাপ্ত গল্পটা এখন তোমার।
                                                                                                                         —হুমায়ূন আহমেদ

বাইরে বৃষ্টির গন্ধ, আর হলুদ পাতার টুপটাপ শব্দ। উঠে লিচুতলার দিকে রওয়ানা দিলাম।

নুহাশ পল্লী নীরব, নিঃশব্দ।
কিন্তু কিছু কিছু রাত, কিছু কিছু চরিত্র, শুধু গল্প হয়ে মরে না। সব গল্পের শেষ হয় না। কিছু গল্প শুধু কাউকে দিয়ে এগিয়ে যায়।

লেখক: অভিনেতা