আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মদিনে ফারুক সুমনের চিলতে গদ্য
প্রকাশিত : জুলাই ২৫, ২০২০
সবেমাত্র এমএ পরীক্ষা দিয়েছি। ফল প্রকাশের অপেক্ষা। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে দিই। একটা প্রকাশনীতে মাসদেড়েক খণ্ডকালীন চাকরি করার পর হঠাৎ একদিন সিও স্যার আমাকে ডেকে বললেন, কাল থেকে আপনাকে আর অফিসে আসতে হবে না।
জীবনের প্রথম চাকরি এভাবে আচমকা চলে যাওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছি। যে অপরাধে আমার চাকরি চলে যায় তাহলো, লাঞ্চ করার পর অফিসের ডেস্কে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া। এটা নাকি সিসি ক্যামেরায় সিও স্যার দেখেছেন। আসলে এই তথ্য এইচআর সেকশনের দায়িত্বে থাকা ম্যাডাম গোপনে আমাকে বলেছেন। সত্য-মিথ্যা জানি না। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা তরুণের দুপুরে খাওয়ার পর একটু ভাতঘুম দেয়া লাগে, এটা অফিস বুঝবে কেন? ফলে চাকরিটা আর রক্ষা করা গেল না।
চাকরি হারিয়ে যখন আমি নিজেকে নিঃস্ব ভাবছিলাম, তখন মেসে থাকা সাঈদ ভাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে চাকরির আবেদন করতে বললেন। আবেদন করলাম। ডাকযোগে ইন্টারভিউ কার্ড হাতে এলো। জীবনে প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ কার্ড হাতে পেয়ে খুব রোমাঞ্চিত হলাম। বলা যায়, এটাই প্রথম চাকরি। কারণ চলে যাওয়া চাকরিটা শ্যামল ভাইয়ের রেফারেন্সে হয়েছিল। সেখানে চাকরি পাওয়ার গতানুগতিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি আমাকে হতে হয়নি।
যাই হোক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইন্টার্ভিউ কার্ড সাথে নিয়ে ভাইবা পরীক্ষা দিতে গেলাম। নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে হাজির হলাম বাংলামোটরে কেন্দ্রের অফিসে। ভেতরে ভেতরে রাজ্যের ভয় জমা। ভাইবা কক্ষে ঢুকে দেখি স্বয়ং আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বসে আছেন। মনের মধ্যে যে ভয় এবং উৎকণ্ঠা ছিল সেটা চেয়ারে বসার খানিক সময় পরেই উধাও হয়ে গেল। কারণ স্যার যখন বললেন, বসো ফারুক, চাকরি হোক বা না হোক। তুমি আমি মুখোমুখি বসে কথা বলছি এটাই বা কম কীসে। তুমি কেমন আছো?
স্যারের কথায় বরাবরের মতোই তখনও আপ্লুত হলাম। রুমে স্যার ছাড়াও সম্ভবত প্রজেক্টের সমন্বয়কারী কামাল ভাইও ছিলেন। স্যারের স্বভাবসুলভ জাদুকরি বাকচাতুর্যে আমি ভীষণ প্রণোদিত হলাম। সবশেষে সায়ীদ স্যার বললেন, লেখালেখি যেহেতু করো বেশি করে বই পড়বে। বই, বই এবং বই। আচ্ছা বলো তো ফারুক, এই যে চাকরির সাক্ষাৎকার পরীক্ষা দিয়ে গেলে। ধরো তোমার চাকরিটা হলো না। তবুও মনকে তুমি কী বলে সান্ত্বনা দেবে?
আমি বললাম, স্যার আপনার সাথে মুখোমুখি বসে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এটাই বা কম কীসে। এই সময়টুকু আমার জীবনে স্মরণীয় স্মৃতিসঞ্চয়।
স্যার মুচকি হেসে বললেন, আচ্ছা তুমি এবার বাইরে অপেক্ষা করো।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মোবাইল লাইব্রেরি প্রজেক্টে চাকরি পেলাম। ২০০৮ সালের ২৯ মে কাজে যোগদান করলাম। পোস্টিং ময়মনসিংহ। প্রথমেই মন দমে গেল। যাব? শেষমেশ স্থির করলাম, যাব। সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা; কিছুই চেনাজানা নেই। নতুন অফিসের নতুন সহকর্মী সাঈদ ফরাজি ভাই ভীষণ ভালো মনের মানুষ। তার বাড়ি আবার ময়মনসিংহে। আশ্বস্ত হলাম। বাসা জোগাড়, টাউন হল মোড় থেকে ১২০০ টাকা দামের কদম কাঠের চৌকি, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি কাজগুলো ঢাকায় বসে করে দিলেন তার বন্ধু রবিনকে দিয়ে। ব্যাগ বোচকা নিয়ে রওনা দিলাম।
মহাখালী-টাংগাইল বাস টার্মিনালে গিয়ে ময়মনসিংহগামী সৌখিন পরিবহনে আরামসে সিট নিলাম। চলতি পথে টঙ্গী, গাজীপুর, ভালুকা এবং কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত ত্রিশাল দেখলাম। খুব ছোটবেলায় স্কুলের বাংলা বইয়ে দুখু মিয়া নামের কবি নজরুলকে নিয়ে যে গল্প পড়েছিলাম, সেখানে ত্রিশালের দরিরামপুর হাই স্কুলের কথা পড়েছিলাম। তাই ত্রিশাল পেরিয়ে যাবার সময় কিছুটা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম।
মাসকান্দা বাসস্ট্যাণ্ডে নেমে রিকশা নিলাম। পথিকের উৎসুক চোখে দেখছি মফস্বল শহরের বাড়িঘর, জমিজমা। নয়াপাড়া, চরপাড়া, ময়মনসিংহ সরকারি মেডিকেল পার হয়ে ঢুকে যাচ্ছি ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছি শহরের পেটে। এদিকে বাড়ি থেকে মায়ের আতঙ্কিত বার্তা, তুই মমিনসিং গেলি ক্যা? হিয়ানো মাইনসে নাকি জোর করি বিয়া হড়াই দেয়। আমি মনে মনে হাসি। রিকশা গাঙিনাপাড় পার হলো। মায়ের ফোন রেখে রিকশার চালককে জিজ্ঞেস করলাম, মামা, কথা কী সত্য?
কী মামা? সে জানতে চায়।
বললাম, ময়মনসিংহে নাকি জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়?
সেও হাসে, কে কইছে? আমারে জিগায়।
আমি বললাম, আমার মা বলেছে।
মামা, সাবধানে থাউন যে!
সত্য মিথ্যা জানি না। সেই মুহূর্তে ভেতরে ভেতরে সাবধান হয়ে শার্টের বোতাম লাগিয়ে নিলাম।
নির্দেশনা অনুযায়ী রিকশা যাচ্ছে। সানকিপাড়া শেষমোড় এসে থামলো।
এভাবেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আলোর ফেরিঅলার দায়িত্বে আমিও নিয়োজিত হয়ে গেলাম। টানা দুই বছর কেন্দ্রের নানা কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থেকেছি। বইপড়ার পাশাপাশি ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা ইউনিটের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান করেছি। শিখেছি অনেক কিছু। সায়ীদ স্যারের সান্নিধ্য পেতাম মূলত ষান্মাসিক কর্মী সম্মেলনে। স্যারের স্বভাবসুলভ বৈদগ্ধ্যপূর্ণ অথচ হাস্যরস সমৃদ্ধ কথাগুলো জীবন ও শিল্পপথের পাথেয় হয়ে রইলো। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রর সংস্পর্শে থেকে শিল্প-সাহিত্যের সৌরভ পেয়েছি। জন্মদিনে অশেষ শুভকামনা স্যার। আপনি দীর্ঘায়ু হোন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য ভালোবাসা।
লেখক: কবি
























