
আবু তাহের সরফরাজের গল্প ‘চাঁদের নৌকা’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৬, ২০২৫
চাঁদে যাবি বুড়ি?
চাঁদে? চোখ গোলগোল হয়ে যায় আমার। জিগেশ করি, ভাইয়া, তুমি বুঝি চাঁদে যাবে?
আম্মুর মতো গম্ভীর মুখে ভাইয়া জবাব দেয়, হুঁ। তুই যাবি বুড়ি আমার সাথে?
মাথার দু’দিকের বেনি দুলিয়ে আমি খিলখিল হেসে উঠি। এরপর জিগেশ করি, চাঁদ তো ওই অনেক দূরে। অত দূরে যাবে কী করে?
এইবার যেন ভাবনায় পড়ল ভাইয়া। তাকালো ওপরের দিকে। মাথার ওপর ঝকঝক করছে রাতের আকাশ। আর কোটি কোটি তারা। জ্বলজ্বল জ্বলছে। আর এসবের মাঝখানে নৌকার মতো একফালি চাঁদ ঝুলছে আকাশের গায়ে।
দ্যাখ বুড়ি, চাঁদটাকে কীরকম নৌকার মতো দেখাচ্ছে।
আমি দেখলাম। আমারও তাই মনে হলো। আমি আর ভাইয়া বিকেলের দিকে বেড়াতে যাই নদীর পারে। চিকন দেহের এক নদী। কুমার নদ। নদের ওপর মাছধরা ভেসাল আছে। আর আছে মাছধরা নৌকা। কোনও কোনও বিকেলে নৌকায় চড়ে আমি আর ভাইয়া একটু ঘুরে আসি। ভাইয়া তো আমারচে বড়। সেভেনে পড়ে। তাই সে একটু-আধটু বৈঠা টানতে পারে। আমি পারি না। তবে শিখে নেব। আমার ইচ্ছে, আরো একটু বড় হয়ে অনেক কিছু শিখে নেব।
রান্নাঘরে মাঝে মাঝে পাশের বাড়ির হুলো বেড়ালটা ঢুকে পড়ে। মাছ চুরি করে খায়। আর মিঁউমিঁউ ডাকে। এই ডাকের মানে শিখে নেব। মাছ চুরির বিষয়ে সে কী বলতে চায়, এরপর তার কাছ থেকে সেটাও জেনে নেব।
জানিস বুড়ি, ওই তারাগুলো নাকি প্রতিটা সূর্য।
ধ্যাৎ, তাই হয় নাকি! ওগুলো তো তারা।
ভাইয়া ঘাড় নাড়ে, সবাই তাই জানে। কিন্তু ওগুলো আসলে সূর্য। আমাদের পৃথিবীতে যেরকম সূর্য আছে, সেরকম সূর্য ওগুলো। আমি বইতে পড়েছি।
তাই! আমার বিস্ময় লাগে।
উঠোনে বাঁশের মাঁচার ওপর পড়তে বসেছি আমি আর ভাইয়া। আম্মু ঘরে, শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছেন। ঝিরঝির হাওয়া দিচ্ছে। আমাদের বাড়িটা বেশ খোলামেলা। আর গাছপালায় ছাওয়া। আমাদের বাড়িতে খুব ধীরে ধীরে সন্ধে নামে। গোধূলির রঙে বাড়িটাকে ছবির মতো মনে হয়।
জানিস, আমাদের এই পৃথিবীকে বলে গ্রহ। সূর্য ঘিরে পৃথিবীর মতো এরকম নয়টা গ্রহ আছে।
তার মানে নয়টা পৃথিবী?
হ্যাঁ। তা বলতে পারিস।
ওসব পৃথিবীতে কি মানুষ আছে?
তা জানি না, তবে প্রাণ যে আছে, বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই বলেছেন।
প্রাণ কি ভাইয়া?
ভাবনায় পড়ল ভাইয়া। মাথা চুলকে বলল, এই ধর একটা শক্তি। যা দ্যাখা যায় না, কিন্তু তুই অনুভব করতে পারবি।
কী রকম? আমি জিগেশ করলাম।
এই যে দ্যাখ, মানুষের ভেতর প্রাণ আছে বলেই মানুষ চলাফেরা করতে পারে। এরকম সব প্রাণীই করে। পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে, সবার ভেতর ওই প্রাণশক্তিটা আছে। বুজেছিস এবার?
আমি ঘাড় নাড়ি। তবে ঠিকঠাক যে বুজেছি তা নয়, কিছু কিছু তো বুঝেছি।
ভাইয়া বলল, এরপর ধর, রাতের গাঢ় অন্ধকারে আকাশে তারার মতো জ্বলে যেসব সূর্য, তার প্রতিটির এরকম গ্রহ মানে পৃথিবী আছে।
হঠাৎ বাঁশবাগানের ওদিক থেকে ছুটে এলো ঝিরঝির হাওয়া। এলোমেলো হয়ে গেল বইয়ের পৃষ্ঠা। ভাইয়া আমার দু’দিকের বেনি উঁচু করে ধরে বলল, আমি চাঁদে চলে যাব রে বুড়ি। তোরেও সাথে নেব। কিন্তু কাউরে বলবি না। খুবই গোপন, মনে থাকবে?
গোপন কেন?
এটা একটা খেলা। গোপন গোপন খেলা।
কিন্তু কিসে চড়ে আমরা চাঁদে যাব?
ভাইয়া কথা বলে না। বাঁশবাগানের মাথার ওপর চেয়ে থাকে। একটা বাদুড় ফরফর শব্দে উড়ে যায় আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। আর তখন ঘরের ভেতর থেকে ভেসে এলো আম্মুর স্বর: তন্ময়, তনিমা, কী করো তোমরা? পড়ার শব্দ তো পাইতেছি না।
চেঁচিয়ে আমি বললাম, সূর্য আর চাঁদের গল্প শুনতেছি আম্মু। খাটের মচমচ শব্দ শোনা যাচ্ছে। এর মানে আম্মু উঠে আসছেন। বন্ধ হলো টিভির শব্দ। আম্মু এসে দাঁড়ালেন চৌকাঠে।
কী গল্প করিসরে তোরা?
ভাইয়া বলল, মহাবিশ্বের গল্প। আচ্ছা আম্মু, তোমার চাঁদে যেতে ইচ্ছে করে না?
আম্মু হাসলেন। নেমে এলেন তিনি। বসলেন আমার পাশে। বসতে বসতে বললেন, তোর আব্বু তো এখনো এলো না। দশটা তো বেজেই গেছে।
আমি বললাম, জানো আম্মু, ভাইয়া না চাঁদে চলে যাবে।
আম্মু চোখের চশমা খুলে আঁচলের খুঁটে মুছতে মুছতে বললেন, তাই নাকি? তবে তো ভালোই। কিন্তু কিসে চড়ে যাবি রে তন্ময়?
আড়চোখে দেখলাম, ভাইয়া কড়াচোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
ভাইয়া জিগেশ করল, আচ্ছা আম্মু, চাঁদে যেতে তোমার ইচ্ছে করে না?
আম্মু মাথা নাড়লেন। না, করে না। আমি এই গ্রহে তোদের নিয়ে বেশ সুখে আছি। চাঁদে গিয়ে তো তোদের মতো দস্যুদের পাব না।
আর আব্বুকেও পাবে না, তাই না আম্মু?
আম্মু আমার বেনি টেনে দিলেন। হ্যাঁ, তোদের সবাইকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে। তাই আমার কখনো চাঁদে যেতে ইচ্ছে করে না।
কিম্বা ধরো, ভাইয়া বলে, আমরা সবাই মিলে চাঁদে চলে গেলাম। সেখানে আমাদের খুব সুন্দর একটা পাথরের বাড়ি থাকবে।
আম্মু মাথা হেলালেন, হ্যাঁ, খুব মজা হয়। কিন্তু চন্দ্রতরি কোথায় পাব? আমাদের তো একটা বাহন লাগবে, তাই না?
আমি জিগেশ করলাম, চন্দ্রতরি চড়ে কি চাঁদে যেতে হয় আম্মু?
ভাইয়া বলল, চন্দ্রতরি নয়, চাঁদের নৌকা বলো আম্মু। দেখছ না, চাঁদটা কেমন নৌকার মতো দেখাচ্ছে। আর তরি মানে তো নৌকাই।
ভাইয়ার মাথায় টোকা মেরে আম্মু বলে উঠলেন, ওরে আমার ক্ষুদে পণ্ডিত মশাই, আম্মুকে বেশ তো ঠকিয়ে দিলি...
বুড়ি?
হুঁ?
চাঁদে যাবি?
যাব তো।
কীসে চড়ে যাবি?
চাঁদের নৌকায়।
চাঁদের নৌকা কোথায় পাবি?
ভাবনায় পড়লাম, তাই তো! যাব বললেই তো আর চাঁদে চলে যাওয়া যায় না। এর জন্য দরকার চাঁদের নৌকার। আমাদের তো চাঁদের নৌকা নেই। ভাইয়ার দিকে পাশ ফিরলাম। কাঁথা টেনে নিলাম বুকের ওপর। হালকা নীল আলো জ্বলছে ঘরে। দেয়াল ঘেঁষে ভাইয়া শুয়ে আছে। বেশ রাত এখন। পাশের ঘর থেকে আব্বুর নাকডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আম্মুও এতক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন।
ঘুম নেই আমার। ঘুম নেই ভাইয়ার।
আমি ডাকলাম, ভাইয়া?
হুঁ?
তুই বানাতে পারবি না চাঁদের নৌকা?
ধুর পাগলি, তা কী আমি পারি? টিভিতে দেখিস না, কত্ত বড় বড় রকেট। ওসব বানাতে অনেক বুদ্ধি লাগে। আর অনেক যন্ত্রপাতি লাগে।
মন খারাপ হয়ে গেল আমার। আর তখন ডেকে ওঠল টিকটিকি। বললাম, বেশ হতো রে ভাইয়া, যদি চাঁদের দেশ থেকে একটু ঘুরেটুরে আসা যেত।
মন খারাপ করিস না বুড়ি। আমরা তো মিথ্যেমিথ্যিও চাঁদে যেতে পারি।
কী রকম? কানের ওপর কাঁথাটা একটু টেনে নিলাম। একটা মশা ভনভন করছে।
ভাইয়া বলল, আমরা তো অনেক রকম খেলাই খেলি। ধর, এটাও একটা খেলা। আমরা একটা চাঁদের নৌকা বানাবো। এরপর তাতে চড়ে চলে যাব চাঁদে। এটা একটা খেলা।
বেশ মজা হবে ভাইয়া। খুশিতে চোখ চকচক করে উঠল আমার।
হ্যাঁ, বেশ মজার খেলা।
কিন্তু চাঁদের নৌকা বানাবে কী দিয়ে?
তাই তো ভাবছি রে বুড়ি। একটু সময় কী যেন ভাবল ভাইয়া। এরপর আবার বলল, পাটকাঠি কেটে কেটে আমরা চাঁদের নৌকা বানিয়ে ফেলতে পারি।
হি হি শব্দে হেসে উঠলাম আমি। সেই যে, একবার পাটকাঠি দিয়ে বাড়ি বানিয়ে তুমি স্কুলে নিয়ে গেছিলে, ও রকম?
হ্যাঁ।
বাড়িটা কিন্তু বেশ বানিয়েছিলে।
কিন্তু কীভাবে চাঁদের নৌকা বানাতে হয়, তা তো জানি না রে বুড়ি। ব্যাপারটা আম্মুকে জিগেশ করতে হবে। আর না হলে... পেয়েছি, ইন্টারনেট থেকেই তো আমি নকশা পেতে পারি।
উত্তেজনা টের পেলাম আমি। আর তখন জ্বলে উঠল বাথরুমের আলো। খুট করে শব্দ হলো। একটা ছায়া এসে দাঁড়ালো দরজায়। আম্মুর গলা, কী ব্যাপার, এখনও জেগে আছো তোমরা... সকালে স্কুল আছে, আর...
আর কী, চুপচাপ মটকা মেরে পড়ে রইলাম আমি আর ভাইয়া। টুঁ শব্দটি নেই। আম্মু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাথরুমে ঢুকে গেলেন।
বাইরে রাতের ধু ধু অন্ধকার। কী এক রাতজাগা পাখি ডেকেই যাচ্ছে। কী যে নরম সেই সুর, রাতের নির্জনতার ভেতর আমি তলিয়ে যেতে থাকি। কী যেন গভীর আর্তি ফুটে বেরোচ্ছে পাখিটার স্বরে। আমি বুঝতে পারি না এই ভাষা। তবে এই পাখিটার পালকের মতো ভেসে যেতে যেতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
কী করছ ভাইয়া?
এই দ্যাখ বুড়ি, চাঁদের নৌকা বানাচ্ছি। এইবার তুই চাঁদে যেতে পারবি।
ধ্যাৎ, পাটকাঠির নৌকা দিয়ে কি চাঁদে যাওয়া যায়? এরপর ভাইয়ার পাশে বসলাম। ভাইয়া আমার দিকে চেয়ে হাসছে। বললাম, আমি ছোট বলে তুমি আমাকে বোকা বানাচ্ছ, তাই না ভাইয়া?
ভাইয়া আমার বেনি টেনে দিয়ে বলল, না রে বুড়ি, পাটকাঠির এই নৌকা দিয়েই আমরা চাঁদে চলে যাব। তুই বসে বসে দ্যাখ...
ভাইয়া নিখুঁত হাতে পাটকাঠি কেটে নৌকা বানাচ্ছে। চকচকে চোখে আমি দেখছি। ভাইয়ার মুখ গম্ভীর। এই মুহূর্তে বেশ ভারিক্কি দেখাচ্ছে তাকে।
জিগেশ করলাম, এটা মিথ্যেমিথ্যি চাঁদের নৌকা, তাই না ভাইয়া?
মুখ ফেরালো ভাইয়া। বলল, না রে বুড়ি, এটা সত্যি সত্যি চাঁদের নৌকা। তোর বুঝি বিশ্বাস হচ্ছে না?
ধ্যাৎ, এটা তো পাটকাঠি দিয়ে বানানো। এ দিয়ে কী চাঁদে যাওয়া যায়?
কথা বলল না ভাইয়া। একটু সময় চেয়ে রইল আমার মুখের দিখে। কী রকম যেন গম্ভীর তার মুখ। চোখের দৃষ্টিও একটু যেন কেমন। হঠাৎ আমার মনে হলো, ভাইয়ার এ মুখ এর আগে কখনও আমি দেখিনি। জাদুকরের রহস্যময় ছায়া তার মুখে।
ধর, পাটকাঠির এই নৌকায় চড়ে সত্যি সত্যি তুই চাঁদে গেলি, তখন?
আমি জবাব দেই, তখন তো মজা আর মজা।
ভাইয়া জিগেশ করল, তখন তো বিশ্বাস করবি যে, পাটকাঠির নৌকায় চড়েও চাঁদে যাওয়া যায়। নাকি তাও করবি না।
না না, তখন তো করব। একেবারে চোখের সামনে, বিশ্বাস কেন করব না?
গভীর স্বরে ভাইয়া ডাক দিল, বুড়ি?
কী রকম যে এ ডাক, আমি চমকে তাকালাম ভাইয়ার মুখের দিকে। ভাইয়া বলল, বিশ্বাস-অবিশ্বাস বলে কিছু নেই রে। বিশ্বাসীরা যেমন পৃথিবীকে চিনতে পারে না, তেমনি অবিশ্বাসীরাও। তুই যদি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বাইরে গিয়ে জগতের সবকিছু দেখিস, তবেই তুই জগৎকে আসল রঙে দেখবি।
এসব ভারি ভারি কথা তুমি কোত্থেকে শিখলে ভাইয়া?
বইতে পড়েছি। বইতে অনেক কথা লেখা থাকে। কথা বলতে বলতেই চেঁচিয়ে উঠল ভাইয়া, বুড়ি বুড়ি দ্যাখ, এই দ্যাখ, আমি জানতাম...
আমি তো থ।
পাটকাঠির নৌকা উড়তে শুরু করেছে। আর ভাইয়া চেঁচিয়েই যাচ্ছে, উঠে পড় বুড়ি... উঠে পড় বুড়ি...
আমি উঠে পড়লাম।
আমাকে নিয়ে চাঁদের নৌকা ওপরে উঠতে শুরু করল। ভাইয়া দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। আমিও হাত নাড়লাম। বাড়িঘর গাছাপালা সবুজ মাঠ নদী সবকিছু ছোট হয়ে যেতে লাগল। আর শোঁ শোঁ শব্দে নৌকা ছুটতে লাগল আকাশের ভেতর দিয়ে।
উঠছে তো উঠছেই। বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে এখন পৃথিবীটাকে। আর সবুজ। আজব, পৃথিবী এত্ত ছোট্ট! কত কত গ্রহের গা ঘেঁষে ছুটে চলেছে চাঁদের নৌকা। এইসব গ্রহে কি মানুষের মতো প্রাণ আছে? গাছপালা আছে? ছায়াঘেরা দুপুরের মাঠ আছে? এসব যখন ভাবছি, ওমা... দেখি, গভীর অন্ধকার আমার চারদিকে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। বিরান চারদিক।
ঝাঁ করে ঘুরে গেল চাঁদের নৌকা। একটা গ্রহের দিকে ছুটে যেতে লাগল। আমি ভাবলাম, এই তো এইবার চাঁদে এসে গেছি।
চাঁদের নৌকা নেমে এলো চাঁদে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল একটা বাড়ির সামনে। আমি লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম। আরে, আমি তো আমাদের বাড়িতে চলে এসেছি। ওই তো উঠোন। পেয়ারা গাছে টিয়ে পাখির খাঁচাটা ঝুলছে। ওই তো কলতলা। পাশে মুরগির খোঁপ। দ্যাকো দেখি, আর আমি ভাবলাম বুঝি চাঁদে এসে গেছি। কিন্তু ভাইয়া কই? তাকে তো দেখছি না। একটু যদি তর সয়, আমি তো এই চলেই এলাম।
বাড়িটার কাছাকাছি গিয়েই থমকে গেলাম। বাড়িটা আঁকানো। উঠোনটাও আঁকানো। গাছপালা মাটিঘাস সবকিছু কেউ এঁকে রেখেছে। সুনসান বাড়ি। আমি ভেতরে ঢুকলাম। আবছায়া আলো ঘরের ভেতর। আম্মু-আব্বু ঘুমোচ্ছেন। তাদেরকেও কেউ এঁকে রেখেছে। কী নিখুঁতভাবেই না এঁকেছে। হুবহু ফটোকপি। পা টিপে টিপে আমি গেলাম আমার আর ভাইয়ার ঘরে।
আমি আর ভাইয়া ঘুমিয়ে আছি খাটে।
কী ঘটছে এসব? আমার মাথা হিজিবিজি হয়ে যায়। ওই তো গভীর ঘুমের ভেতর ডুবে আছি আমি। পাশে ভাইয়াও ঘুমোচ্ছে। মৃদু নাক ডাকছে তার। দুজনই আমরা আঁকানো। খাট দেয়াল মেঝে টেবিল চেয়ার সবকিছু আগে থেকেই কেউ যেন এঁকে রেখেছে। শিরশির একটা ঠাণ্ডা স্রোত উঠে এলো আমার নাভির ভেতর থেকে। কী রকম ধাঁধা চারদিকে। এ কোথায় এলাম? আমার ঘর, জানালা, পড়ার টেবিল, ভাইয়াকে, এমনিক নিজেকেও আমার ঝাপসা আর অচেনা মনে হতে লাগল। এই প্রথম টের পেলাম ভয়। মহাশূন্যের অনন্ত শূন্যতা আমার ভেতর হাহাকার হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
ওই তো ঘুমিয়ে আছি আমি। সম্ভবত গভীর কোনো স্বপ্ন দেখছি। মুখখানা কী রকম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। যেন এই মুহূর্তে আমি দাঁড়িয়ে আছি আয়নার সামনে। আয়নার বাইরে যে, সে আমি। আয়নার ভেতরে যে, সেও আমি। বেশ এক গোলোকধাঁধা। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল আমার। আর তখনই মনে হলো, আমিও তবে স্বপ্ন দেখছি। দ্রুত ফিরে যেতে হবে পৃথিবীতে, আমার ঘুম ভেঙে যাবার আগেই। প্রায় ছুটে বেরিয়ে এলাম বাইরে। উঠে পড়লাম চাঁদের নৌকায়। আর অমনি শোঁ শোঁ ছুটতে শুরু করল যানটি।
দুপুরের রোদ নরম হয়ে বিছিয়ে আছে ঘাসবনে। বাড়ির পেছনে আমগাছের নিচে বসে আছি আমি আর ভাইয়া। ঘন হয়ে ছড়িয়ে থাকা আমগাছের ডালে কোথায় যেন ঘুঘু ডাকছে। ডেকেই যাচ্ছে। যেন দুপুরের সুর। যেন সুনসান দুপুরের বুকের ভেতর থেকে উঠে আসছে ঘুঘুর ডাক।
ভাইয়া চাঁদের নৌকা বানাচ্ছে। পাশে বসে চুপচাপ আমি দেখছি। কথা বলছি না। কথা বলতে ভাইয়া নিষেধ করেছে। ভাইয়া আরো বলেছে, আমরা যে চাঁদের নৌকা বানাচ্ছি, খবরটি গোপন। ভাইয়া আর আমি ছাড়া বিষয়টি বিশ্ব জাহানের কাউকে জানানো যাবে না। চাঁদের নৌকা বানানো যেমন একটা খেলা, এই গোপন গোপন ব্যাপারটাও তেমন একটা খেলা। ভাইয়া বলেছে, সত্যি সত্যি যখন আমরা চাঁদের নৌকা বানিয়ে ফেলব, তখন অনেক মজা হবে। আমরা নৌকাটাকে প্রথমে আম্মুকে দেখাবো। আম্মুতো স্কুলের টিচার। গোলগোল চমশা পরেন। চোখের সামনে আস্ত একটা চাঁদের নৌকা দেখে তিনি কি ভিমড়ি খাবেন? এখন বোঝা যাচ্ছে না। যখন চাঁদের নৌকা বানানো শেষ হবে, তখন জানা যাবে।
এরপর কাকে দেখানো যেতে পারে? আমি বলেছি, আব্বুকে। ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছে, আব্বুকে এসব দেখিয়ে লাভ নেই রে বুড়ি। সারাদিন ব্যবসার হিসেব রাখতে রাখতে আব্বু যন্ত্র হয়ে গেছে।
মানুষ কীভাবে যন্ত্র হয়ে যায়, আমি জানি না। আমি তো এখন ছোট। হাঁটি হাঁটি পায়ে হেঁটে আম্মুর সাথে স্কুলে যাই। আম্মুর সাথে বাসায় ফিরি। সে যাই হোক, ভাইয়া যখন চায় না, তখন আর আব্বুকে দেখিয়ে কাজ নেই। কিন্তু কবে শেষ হবে চাঁদের নৌকা বানানো?
শেষ আর হয় না। প্রতিদিন ভাইয়া আমাকে সাথে নিয়ে চাঁদের নৌকা বানায়। এরপর ভেঙে ফ্যালে। মুখখানা গম্ভীর করে চেয়ে থাকে আমার মুখের দিকে। কী যে ঢং ভাইয়ার। আমার মুখ কালো হয়ে যায়। আর তখন ফিক করে হেসে ফ্যালে ভাইয়া। বলে, এইটা ঠিক চাঁদের নৌকা হয়নি রে বুড়ি।
আমার রাগ লাগে। আমার মন খারাপ হয়ে যায়।
হেসে দিয়ে তখন ভাইয়া বলে, বুঝলি বুড়ি, চাঁদের নৌকা জিনিসটা বানানো অত সহজ না। তবে খেলাটা সহজ। না রে?
ভাইয়া হাসতে থাকে। হাসতে থাকি আমিও।