আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

আমার কবিতার ভাষা বিষয়ে

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১০, ২০২২

নব্বইয়ের দশকে আমি উত্তর আধুনিক ভাষা-আক্রান্ত প্রচুর কবিতা লেখা শুরু করি। এইসব কবিতায় যা থাকে তা হইলো, এন্টি ফর্ম, অর্থের পরিবর্তে অর্থহীনতা, কেন্দ্রের বদলে কেন্দ্রহীনতা। কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণের বদলে চেতনার বিচিত্র ভ্রমণ, যুক্তির শাসনের পরিবর্তে অযৌক্তিকতা, দূরত্বের বদলে অংশগ্রহণ, নির্মাণের বদলে বিনির্মাণ, সমন্বয়ের বদলে বিরোধাভাস, উপস্থিতির পরিবর্তে অনুপস্থিতি, প্রকরণ/সীমার বদলে বয়ান/আন্তর্বয়ান ও ব্যাখ্যার বদলে ভাষার ঘনীভূত, পলায়ন।

তখন এইগুলি পাঠকের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হইছিল। কারণ পাঠক তখনো এই অভিজ্ঞতার ভেতর যাওয়ার জন্য পুরাপুরি তৈরি হয় নাই। এখনো যে হইছে তা নিশ্চিত নই। বলা যায়, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এই ধারার লেখা আমি বেশি লিখছি। এইসব লেখা পাঠকের বোধগম্য হওয়ার তাগিদে লেখা হয় না, বরং পাঠকের কবিতা-পাঠ-অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা-স্রোতে ধাবিত করা হয়। পাঠকের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হয়। ফলে পাঠক লেখাটা নিয়া ভাবে, অর্থ বার করার চিন্তা করে কিন্তু অর্থ পায় না, অবশেষে সে বিস্ময় প্রকাশ করে। তবে তার একটা নীরব ভালো লাগা বোধ কাজ করে বলা যায়। কারণ এইসব কবিতা মেধা, মনন এবং সর্বপরি একটা আকর্ষণীয় ভাষায় লেখা।

২০১৫ সালের পরে আমি এই ধারার লেখা থেকে ক্রমশ দূরে আসতে শুরু করি। ক্রমশ আপেলপাতা বেয়ে (২০১৫ ) এ ধারায় লেখা আমার শেষ কাব্যগ্রন্থ। তারপর থেকে আমি ভাষাকে খোলামেলা, স্তরহীন, মূর্ত মোট কথা পাঠকের কাছে বোধগম্য করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। কারণ কবিতার ইতিহাস হইল, কবিতার সাথে পাঠক এবং কবির ভাব ও ভাষার বোঝাপড়ার ইতিহাস। ইউরোপীয় আধুনিকতার নাম করে ত্রিশের কবিদের মাধ্যমে বাংলা কবিতার যে নতুন প্রকরণ এবং আঙ্গিক আমদানি হইছিল তা শুধু বাংলা কবিতার সহজ, সরল ভাব এবং ভাষাটাতেই ছেদ আনে নাই, তা একটা অচেনা, দূরীভূত কাব্য-সভ্যতার উত্থান ঘটাইছে। কিন্তু আমাদের এইটাও মনে রাখতে হবে যে জ্ঞান, বিজ্ঞান আবিষ্কার মানুষের একার কারো সম্পত্তি না। এইগুলি মানুষের মধ্যে অদল বদল হয়েই আমাদের পৃথিবীর এই সভ্যতা।

এর ওপর পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অধিকার আছে। কারণ নানান দেশের মানুষের ভাষা, ধর্ম, দর্শন জ্ঞান, বিজ্ঞানের আদান প্রদান না হইলে আধুনিকতা হইতো না। তাই আধুনিকতা একটা গ্লোবাল অবশ্যম্ভাবী ফেনোমেনা। মধ্যযুগে ইউরোপ ছিল বর্বর, অন্যদিকে প্রাচ্য বিশেষ করে চীন, পারস্য, ভারত ও ইসলামিক সভ্যতা ছিল ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, জ্ঞান, বিজ্ঞান চিকিৎসা প্রাণ প্রাচুর্যে অনন্য। মুসলমান দার্শনিকদের মাধ্যমে গ্রিক দর্শন, বিশেষ করে প্লেটো এবং এরিস্টোটল অনূদিত হয়ে ইউরোপে যায়। ফলে তার হাত ধরেই হিউম, হব, লক, কান্ট, হেগেল, হাইডেগার ইত্যাদির ভাব, চিন্তা দর্শনের মাধ্যমে আধুনিকতার গোড়া পত্তন হয়। আধুনিকতা মানুষের বিইং হিসাবে ইতিহাসের অভিজ্ঞতার একটা পর্যায়ের অন্যতম অংশ, তাকে এড়িয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব না।

পশ্চিমা আধুনিকতার সব কিছুই খারাপ না। বিশেষ করে এর সুপার টেকনোলজিকাল এডমান্সমেন্ট মানুষের কাছে অনেক দূরহ কাজ সহজ করে তুলেছে। যদি কিছু সংখ্যক লোভী, বর্ণবাদি লোক তাদের আগ্রাসী ইচ্ছাকে দমন করতে পারত তাহলে হয়ত আমাদের কাছে পথিবী আরো সুন্দর, সহনীয় এবং বাসযোগ্য হইত। যদিও যে লিবারেলিজম ইডিওলজি থেকে এইটা গ্রো করছ, তার অধিকাংশ প্রস্তাবনাই মানবকুলের ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট- যেমন এলজিবিটি আন্দোলন এবং এক্সট্রিম ফেমিনিজম।

যাই হোক, এখন আমার কবিতার পথ, কবিতার ভাষা, জন মানুষের তথা লোকজীবনের প্রাত্যহিক ভাষা, তাদের জীবন যাপনের সাথে একটা নান্দনিক মেলবন্ধন তৈরি করতে প্রস্তুত। কিছু পাঠক ইদানীং কালে আমার কবিতার প্রকরণগত এবং শিল্পগত পরিবর্তন আঁচ করে কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে থাকবেন। তাদেরকে আমি এইটুকুই বলবো যে, একজন কবির কবিতার মৌল চরিত্র কখনোই বদলায় না, বদলায় তার ভাষা এবং প্রকরণ, শৈলী। কবিতার ছাপ হইলো জন্ম দাগের মতো, এইটা সারা জীবন প্রায় এক রকম থাকে। কিন্তু কালের প্রবাহে এইটার রূপ, এইটার প্রকাশ ভঙ্গিমা পরিবর্তিত হয়। আমার ও তাই হইছে। কবিচেতনার দায়ভার সময় ও সভ্যতার কাছে, যার সাক্ষী থাকেন কবি। তার কবিতার ভাষাটাও এই পথ ধরে নির্মিত হয়।

নব্বই দশকে লেখা উত্তর আধুনিক ভাষা সংক্রান্ত আমার একটি কবিতা ‘স্টেশন’

দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ঘাড়ে শীতের ইকেবানা।
ঠাণ্ডা বাতাসখনি, টান টান মুখের গ্রাফ- বালিরেখা,
আয়ুবাক্সে লুকিয়ে পড়ছে বরফ ডাকাতেরা।
সামনে হলুদ দাগের কিনারা
সাবধানে পা রাখছে তাঁবুহারানো যাত্রী
তার বোগলজুড়ে নিদ্রাবহনের লম্বা ক্যারাভান।
থোকা থোকা বিদ্যুৎ-রাক্ষস নিয়ে শুয়ে আছে
রেলস্লিপারের কয়েদি।
এক একটি মহাদেশ, ছায়াবিন্দু
মিষ্টি দোকানের পাশ দিয়ে, ব্রিজটার মাথায়।
চায়ের কাপে শেষ চুমুকে
আস্তে আস্তে লাফিয়ে উঠছে ট্রেনীভুত সন্ধ্যা,
হাজারিবাগ হাজারিবাগ ডাকা
স্টেশনের বারান্দা!
(ক্রমশ আপেলপাতা বেয়ে, ২০১৫)