অলঙ্করণ: লেখক

অলঙ্করণ: লেখক

​সৈয়দ প্রমিত সালাম নিসর্গর গল্প ‘জীনের রেস্তরাঁ’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২৫

ধু-ধু মরুভূমি। শীতের কনকনে বাতাস বইছে। হাড়ে কামড় দেওয়ার মতো ঠাণ্ডা। বাসে করে দূরের একটি শহরে চলেছে পাঁচ বন্ধু। ঘুটঘুটে রাত। নীরব চারদিক। হঠাৎ উমর দেখল, বাসের মধ্যে অপরিচিত তিনজন মানুষ। তারা কোত্থেকে বাসে উঠে পড়েছে, সে বুঝতে পারল না। একজন উমরের মাথায় একটি হাত রাখল। স্পর্শ এতই বরফশীতল যে, হাতের স্পর্শ বিদ্যুতের ঝটকার মতো অনুভব করল উমর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উমর আয়াত আল কুরসি আবৃত্তি করা শুরু করল। অপরিচিত মানুষটি বিকট শব্দে চিৎকার করে অদৃশ্য হয়ে গেল। উমর চোখ ডলল। চারপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখল না। ভাবল, নিশ্চয়ই সে স্বপ্ন দেখছিল।

​নির্জন রাস্তা ধরে বাস চলছে। উমর বুঝতে পারল, আয়াত আল কুরসির আধ্যাত্মিক শক্তিতে জীনটি বাস থেকে পালিয়ে গেছে। বাসের জানলা দিয়ে উমর দেখল একটি রেস্তোরাঁ। ড্রাইভারকে সে বাস থামাতে বলল। বন্ধুদের বলল, চল, এখান থেকে আমরা কফি খেয়ে নিই। যা ঠাণ্ডা, শরীরটা একটু চাঙা হবে।

রেস্তরাঁর ওপরে সাইনবোর্ডে লেখা, জীন রেস্তোরাঁ। সেটার সামনে দাঁড়িয়ে আবদুল্লাহ বলল, এহ ব্বাস, কী বিদঘুটে নাম রে বাবা! আমার তো গা ছমছম করছে।

আহমদ বলল, আরে ধুর! ওসব কিছু না। মানুষকে আকর্ষণ করতেই এমন নাম রেখে দিয়েছে। চল ভেতরে ঢুকি। একটু জিরিয়ে নেয়া দরকার।

পাঁচ বন্ধু রেস্তোরাঁয় ঢুকল। ভেতরে উষ্ণতা সত্ত্বেও বাতাসে ঠাণ্ডা অনুভূতি ছিল। তাদের দেখে কাউন্টারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটি জীন বেরিয়ে এলো। চকচকে একটা ছুরি হাতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাঁচ বন্ধু যে যেদিকে পারল, ছুটল। জীনটি ছুটল উমরের পেছনে। একটা সময়ে উমরকে ধরেও ফেলল। চার বন্ধু উমরকে বাঁচাতে এগিয়ে এলো। জীনের সঙ্গে তারা ধস্তাধস্তি শুরু করল। কিন্তু জীনটির গায়ে বেজায় শক্তি। তারা পারবে কেন! শেষমেষ হাল ছেড়ে তারা নিজের জীবন নিয়ে পালালো। কেউ ঠায় নিল টেবিলের নিচে, কেউ চেয়ারের আড়ালে। নীরব আতঙ্কে তারা দেখল, জীনটি উমরকে রান্নাঘরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

রান্নাঘরের ভিতরে জীনটি উমরের হাত রান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এই দেখে আব্দুল্লাহ ও আহমদ রাগে কাঁপতে লাগল। তারা একটিন কেরোসিন ও একটি দেশলাই বাকসো খুঁজে পেল। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তারা রেস্তোরাঁ ও রান্নাঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিল।

জীনটি তার নিষ্ঠুর কাজে ব্যস্ত ছিল। তাই সে এসব কিছুই খেয়াল করেনি। দেখতে দেখতে গোটা রেস্তোরাঁ জ্বলে উঠল দাউদাউ আগুনে। জীনটি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। এই সুযোগে তারা উমরকে উদ্ধার করে পালিয়ে গেল। পেছনে পড়ে রইল জ্বলন্ত রেস্তরাঁ ও আগুনে জ্বলতে থাকা জীন।

এরপর কেটে গেল কয়েক মাস। বেশ গরম পড়েছে। দিনের তাপমাত্রা প্রায় ৩৫° সেলসিয়াস। পাঁচ বন্ধু এখন রিয়াদে। প্রতি সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার সাথে সাথে তারা ভিন্ন একটি পৃথিবী দেখতে পায়। রাতে বাতাস বেজায় ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তাপমাত্রা নেমে আসে ১৭.৫০° সেলসিয়াসে।

এক রাতে তারা দেখতে পায়, কালো আকৃতির এক ধরনের জীবন গলির ছায়া-ছায়া অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে। এটি দেখতে তাদের আগের দেখা ইথারিয়াল রূপের মতো নয়। এটি শক্তিশালী ও ভয়ংকর। লম্বা ও কৃশ। হাতে চকচকে ছুরি। জীবটি উমরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তার হাত কেটে দিল। জীনটি তাকে ধরল এবং টেনে নিয়ে গেল। এরপর অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

একটি অদ্ভুত জীর্ণ বাস রাস্তার শেষ থেকে বেরিয়ে এলো। আব্দুল্লাহ ও আহমদের ভেতর মরিয়া হয়ে উঠল বন্ধুকে বাঁচাতে। চুপচাপ তারা বাসের ভিতরে ঢুকল। বাসের দরজা পিছনে নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

বাসটি নতুন ভয়ংকর বাস্তবতায় তাদেরকে নিয়ে গেল। তারা এখন জীনের জগতে। তারা এখন গুহার মতো একটি জায়গায়, যেখানে ছায়াময় আকৃতিরা নিঃশব্দে ঘোরাফেরা করছিল। তারা উমরকে একটি স্ফটিক সিংহাসনের সামনে নতজানু অবস্থায় দেখল, একটি অন্ধকার শক্তির সুতো তাকে সিংহাসনের সাথে আটকে রেখেছে। শক্তিশালী একটি জীন সিংহাসনে বসেছিল। তাদের বন্ধুর অস্তিত্ব শুষে নিচ্ছিল।

​তিনটি জীন ঘূর্ণায়মা, মসৃণ ও রূপালি স্পেস স্যুট পরে নিল। এক ঝটকায় জীন বাসটি উধাও হয়ে গেল। চার বন্ধু নিজেদেরকে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় দেখতে পেল। তাদের মাথার ওপর একটি বিশাল চাঁদ। তিনটি জীন চাঁদের পৃষ্ঠের দিকে এগিয়ে গেল। যেখানে তারা একটি উজ্জ্বল আলোকিত রেস্তোরাঁ তৈরি করেছিল, কসমিক কুক হাউস।

​রেস্তোরাঁর ভিতরে তারা উমরকে একটি কাউন্টারে বাঁধা অবস্থায় পেল। তাকে রান্নার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল। আব্দুল্লাহ ও আহমদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আয়াত আল কুরসি পাঠ করা শুরু করল। মরুভূমিতে যে পবিত্র আয়াতগুলো এত শক্তিশালী ছিল তা এই অসম্ভব অন্ধকারে আলোর মশাল হয়ে উঠল। জীনগুলো পালিয়ে গেল। এরপর একটি ভারী ইস্পাতের দরজা দিয়ে ল্যাবরেটরিতে লুকিয়ে পড়ল।

​জীনগুলো তাদেরকে একটি ঠাণ্ডা ধাতব সেলে আটকে রাখল। একজন শেফ জীন এলিয়েন রাজা ও রানির জন্য খাবার পরিবেশন করল। আব্দুল্লাহ একটি লেজার ছুরি বের করল। এরপর জেলের গেট কেটে বন্ধুদের মুক্ত করল। তারা এলিয়েনদের আক্রমণ করল। এলিয়েনরা চিৎকার করে একটি মহাকাশযানে পালিয়ে গেল। হঠাৎ শেফ জীন চার বন্ধুর ওপর আক্রমণ করল। উমর তখন আয়াত আল কুরসি পাঠ করা শুরু করল। সাথে সাথে জীনটি পালিয়ে গেল।

​​জীন বাসটি আবার চাঁদে ফিরে এলো। এখন দিনের আলোয় তাপমাত্রা ১৫০° সেলসিয়াস। টাইটানিয়াম-গ্লাসের স্যুটগুলো তাদের ঠাণ্ডা রাখল। সুযোগ বুঝে আব্দুল্লাহ রেস্তোরাঁর এসি কেটে দিল। গরমে এলিয়েনরা রেগে গের এবং জীনদের টাকা দিতে অস্বীকার করল। জীন ও এলিয়েনদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গেল, যা বন্ধুদের পালানোর সুযোগ করে দিল।

​তাপমাত্রা কিছুটা কমে ১৩০° সেলসিয়াসে পৌঁছাল। এসি ঠিক করা হলো। একজন সেলস জীন নতুন দুই মানব বন্দি আব্দুল কাদের ও আব্দুল মুহাইমিনকে নিয়ে এলো। শেফ জীন যখন তাদের হাত পরিবেশন করতে যাচ্ছিল তখন আব্দুল্লাহ রেস্তোরাঁর আলো কেটে দিল। এলিয়েনরা চিৎকার করে তাদের মহাকাশযানে পালিয়ে গেল। পাঁচ বন্ধু চাঁদে একটি ঘর তৈরি করে সেখানে আশ্রয় নিল। তখন মাগরিবের সময়। তারা চাঁদের ঘরে নামাজ পড়ল।

​সেই রাতে তাপমাত্রা নেমে -১২৫° সেলসিয়াসে পৌঁছাল। এশার নামাজ পড়ার পর উমর বোমা আনার জন্য পৃথিবীতে নামল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সে ফিরে গেল। -১৩০° সেলসিয়াসে পাঁচ বন্ধু ফজর নামাজ পড়ল। বুঝতে পারল, তাদের এই দুঃস্বপ্ন এখনও শেষ হয়নি। ​সূর্য ওঠার পর তাপমাত্রা ১১৫° সেলসিয়াসে উঠল। তারা ঘর থেকে বেরিয়ে তাদের শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হলো।

​লেজার ছুরি দিয়ে সশস্ত্র হয়ে পাঁচ বন্ধু ম্যানেজার জীনকে আক্রমণ করল। আব্দুল্লাহ তার হাত কেটে দিল। এরপর সবাই মিলে আয়াত আল কুরসি পাঠ করল। জীনগুলো বাসে করে পালিয়ে গেল। বন্ধুরা জীনের সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহার করে দেখল যে, জীনগুলো একটি পোশাকে রাখার ঘরে লুকিয়ে আছে।

​এলিয়েনরা ফিরে এলো। শেফ জীন তাদের জন্য রক্তরস তৈরি করল। কিন্তু বন্ধুরা বোমা নিয়ে ফিরে এল। তারা রেস্তোরাঁয় বোমা মারল, যা রেস্তোরাঁকে ধ্বংস করে দিল। সেলসজীন উমরকে ছুরি দিয়ে আক্রমণ করল, কিন্তু উমর আয়াত আল কুরসি পাঠ করল। ফলে, শেফ জীন স্থির হয়ে গেল। আব্দুল্লাহ তার হাত কেটে দিল। এরপর সেটা বাসে করে পালিয়ে গেল।

​বন্ধুরা ল্যাবরেটরিতে গেল। কিন্তু গেট বন্ধ ছিল। তারা একটি মিলানোর ধাঁধা দেখল এবং সেটি সমাধান করল। এরপর গেট খুলে গেল। ​ভিতরে আরও তিনজন জীন তাদের আক্রমণ করল। কিন্তু আহমদ আয়াত আল কুরসি পাঠ করল। উমর লেজার ছুরি দিয়ে তাদের হাত কেটে দিল। এরপর তারা বোমা দিয়ে পুরো ল্যাবরেটরি ধ্বংস করে দিল। তিনজন জীন বাসে করে পালিয়ে গেল।

রাত নেমে -১২০° সেলসিয়াসে পৌঁছাল। তারা এশা নামাজ পড়ল। আহমদ ল্যাব থেকে একটি চুম্বক ব্যবহার করে জীন বাসটিকে থামিয়ে দিল। আব্দুল কাদের ও আব্দুল মুহাইমিন বাসে ঢুকে তিনজন জীনের সাথে লড়াই শুরু করল। তারা আয়াত আল কুরসি পাঠ করল। এর শক্তিতে তিনজন জীন অজ্ঞান হয়ে গেল। আব্দুল্লাহ রেস্তোরাঁয় বোমা মারল। যা বাকি অংশও ধ্বংস করে দিল।

বাকি জীনগুলো লুকিয়ে থাকার জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে বাসে ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু দুই বন্ধুর পাঠ করা আয়াত আল কুরসি শুনে তারাও অজ্ঞান হয়ে গেল। বন্ধুরা অবশেষে জিতল। ​তারা পৃথিবীতে ফিরে এলো। এখন গ্রীষ্মকাল। তাপমাত্রা ৫১° সেলসিয়াস। তাদের কাছে এটা স্বস্তি মনে হলো। জীনরা তাদের আর কখনও বিরক্ত করেনি। তাদের ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন অবশেষে শেষ হলো।

 

লেখকের বয়স ১১ বছর।