আল মাহমুদ

আল মাহমুদ

আল মাহমুদের কবিতার শৈল্পিক সৌন্দর্য

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : জুলাই ১১, ২০২৫

চোখ খুলে দেখা আমাদের এই জগৎ আর শিল্পের জগতের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আকাশে ঝকঝকে চাঁদ উঠেছে। এই চাঁদ আমরা দেখছি। বুকের ভেতর ভালো লাগার ঝিরঝির আনন্দ বয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে আর কোনো উপলব্ধি আমাদের ভেতর তৈরি হবে না। কিন্তু যখন পড়ি, ‘নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল/ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠাণ্ডা ও গোলগাল’— তখন বাস্তবে দেখা চাঁদের চেয়েও অনেক বেশি বাস্তব চাঁদ আমরা আমাদের অন্তর্জগতে দেখতে পাই। কেন এরকম ঘটে? ঘটে কারণ, কল্পনার রঙ বাস্তবের রঙের চেয়ে আমাদের বেশি ঘনিষ্ঠ। আমাদের বোধের জগৎকে রাঙিয়ে যা কল্পনা হিসেবে ফুটে ওঠে, সেখানে আমাদের নিজের মতো করে দেখার চোখ তৈরি হয়। যে কোনো শিল্প ঠিক এই কাজটিই করে। শিল্পকর্মকে আমাদের বোধের রঙে রাঙিয়ে তোলে। যে কবিতার সৌন্দর্য যত বেশি সেই কবিতা তত বেশি আমাদের বোধের রঙে রাঙিয়ে রূপকাঠামো নির্মাণ করে। কবিতা সুন্দর হয়ে ওঠে কী কী উপাদানে? ছন্দ, উপমা, চিত্রকল্প  ও ভাষাশৈলী কবিতার শরীরকে পরিপাটি করে গুছিয়ে তোলে। তাই এসব উপাদানকে বলে কবিতার অলঙ্কার। অলঙ্কারের সংমিশ্রণ যথাযথ হলেই কবিতা সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। কবিতার অলঙ্কার আসলে ইট-কাঠ ও রড-সিমেন্টের মতো উপাদান। একটি ভবন নির্মাণে উপাদানের পাশাপাশি জরুরি রাজমিস্তিরির শিল্পনৈপুণ্য। যদি তা না-থাকে তাহলে সেই ভবন কয়েকদিন পরই ভেঙে পড়ে। একইভাবে, অলঙ্কার ঠিকঠাক বিন্যাস্ত না-হলে কবিতা আমাদের কল্পনার রঙ রাঙাতে পারে না।

সৌন্দর্য-মণ্ডিত কবিতা আসলে লেখা যায় না। এই কবিতা নিজেই প্রকাশ ঘটে কবির মাধ্যমে। কবির বোধের গহীন অন্ধকারে আলোর মতো হঠাৎ জ¦লে ওঠে কোনো বিশেষ একটি বোধ। এরপর সেই বোধ নানা ব্যঞ্জনায় স্ফুরিত হতে থাকে। কবি শুনতে পান, অচেনা গ্রহ থেকে ভেসে আসা অস্ফুট স্বর। তারা প্রকাশ চায়। আর তখন বেগ তৈরি হয় কবির ভেতর। কবির অবস্থা তখন ঘোরগ্রস্থ। বোধকে ভাষায় নির্মাণ করতে হবে। ব্যাপারটা অনেকটা ফুলের সুবাসকে ভাষায় শরীর দেয়ার মতো। খুবই মুশকিলের কাজ। প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। কিন্তু প্রকৃত কবির বেলায় কাজটি প্রাকৃতিকভাবেই সহজে ঘটে যায়। কবিতা খুবই স্বাভাবিক গতিতেই কবির ভেতর থেকে ভাষায় রূপ নিতে থাকে। কবি কেবল নিমিত্ত হয়ে লিখে যেতে থাকেন বোধের অনুরণন। প্রকৃত কবি আসলে বোধের জগতের রঙছবি ভাষায় প্রকাশ করতে বাধ্য হন। বোধের প্রকাশ প্রকাশ ঘটে গেলে কবি আরাম পান। নিজেকে তখন তার নির্ভার লাগে। বলতে কী, এ জাতীয় কবির সংখ্যা অগণন নয়। এদের সংখ্যা হাতেগোণা। বস্তুত, এরাই বাংলা কবিতার যাত্রাপথে মাইলফলক। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জসীম, ফররুখ, শক্তি, বিনয়, আল মাহমুদ প্রত্যেকেই বাংলা কবিতার এক একজন পথ-নির্দেশক। কারণ, তারা কখনোই কবিতা লেখেননি। বরং, কবিতাই তাদের মাধ্যমে লিখিত হয়েছে। প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট সেসব কবিতার সৌন্দর্যও প্রকৃতির মতো নিখুঁত, অনন্য কারুকার্য খোচিত।

নারকেল গাছের মাথায় গোলগাল ভরাট চাঁদ আমরা অনেকেই দেখেছি। সেই সৌন্দর্য তাৎক্ষণিক আমাদের অনুভূতিকে রাঙিয়ে গেছে। কিন্তু আল মাহমুদ যে চিত্রকল্পের মাধ্যমে দৃশ্যটি আমাদের সামনে ঝুলিয়ে দিলেন, সেই দৃশ্য তাৎক্ষণিক নয়। বরং, আমাদের অন্তর্আয়নায় চাঁদের সৌন্দর্যের স্থায়ী প্রতিবিম্ব রেখে গেছেন। আবার, উপমার যে ব্যবহার তিনি করেছেন তাও অনন্য শিল্পের কারুকাজ। চাঁদকে তিনি ডাবের মতো ঠাণ্ডা ও গোলগাল বলছেন। ডাবের মতো গোলগাল চাঁদ, এই সাদৃশ্য আমরা মেনে নিলাম। কিন্তু চাঁদ ঠাণ্ডা কীভাবে হলো? এখানেই আল মাহমুদের প্রকৃত কবিসত্তার নান্দকিক শাব্দিক-প্রকাশ। প্রচণ্ড তৃষ্ণার মুহূর্তে ডাবের পানি পান করলে আমাদের ভেতর তৃষ্ণা নিবারণের প্রশান্তি নেমে আসে। এই তৃষ্ণা জৈবিক। মানুষ কিন্তু কেবল শরীর নয়, আত্মা নামে তার আরেকটি অংশ রয়েছে। আত্মারও তৃষ্ণা পায়। সেই তৃষ্ণা নিবারণ হয় সৌন্দর্যের মাধ্যমে। এই তৃষ্ণাকে সৌন্দর্য-তৃষ্ণা বলা চলে। সুতরাং, ডাবের মতো ঠাণ্ডা চাঁদের সৌন্দর্য আমাদের আত্মার শিল্প-তৃষ্ণাকে তৃপ্ত করে। এই তৃপ্তি না-পেলে পাঠক কবিতা কেন পড়বে? জানি যে, গণমাধ্যমের প্রচারণায় প্ররোচিত হয়েই বেশির ভাগ পাঠক কবিতা পড়ে। কিছু না-বুঝেই বলে ওঠে, বেশ তো কবিতা!

কিন্তু এসব বালখিল্য কবিতা আসলে মহাসমুদ্রের বুকে মুহূর্তের একটি ঢেউ। যেসব কবিতা কালোত্তীর্ণ সেসব কবিতার ব্যপ্তি মহাকালজুড়ে। আর তাই, মহাজাগতিক বোধ যে কোনো কবির বড় সম্পদ। জীবন ও জগৎকে পর্যবেক্ষণ খুব সূ²ভাবে করতে না পারলে কবির কবিতা হয়ে ওঠে মোমবাতির আলোর মতো। পাঠকের অন্তর্জগতের খুবই অল্প একটু জায়গাই ওই কবিতা দ্বারা আলোকিত হয়। কিন্তু আমরা জানি, মানুষের বোধের জগতের বিস্তৃতি মহাবিশ্বের মতো। বোধের বিস্তৃত জগৎ প্রাকৃতিক উপায়েই প্রকৃত কবির কবিতায় জায়গা করে নেয়। আল মাহমুদের কবিতা পড়তে পড়তে পাঠক এই সত্য আত্মার ভেতর থেকেই উপলব্ধি করবে। তার কবিতাগুলো যেন শব্দের এক-একটি মায়াবী জাদু। দুর্নিবার এক আকর্ষণে পাঠককে টেনে ধরে। কল্পনাকে বর্ণিল রঙে রাঙিয়ে মনকে প্রজাপতি বানিয়ে তোলে। ছন্দের দোলায় আনন্দ ছড়িয়ে দিতে-দিতে কবিতাগুলো পাঠক-মনে যেসব চিত্রকল্প এঁকে দ্যায় তা অনাস্বাদিত। মাহমুদের আগে যেন আর কোনো কবি সেসসব চিত্রকল্পের স্বাদ দিয়ে পাঠকের সৌন্দর্য তৃষ্ণাকে নিবারণ করতে পারেননি। মাহমুদের কবিতা পাঠে পাঠক উপলব্ধি করতে পারে প্রকৃতির ও জীবনের রূপরসগন্ধ। প্রকৃতির অন্তর্জগতের সঙ্গে ঘটে পাঠকের সখ্য।

মাহমুদের কবিতার বিশেষ সৌন্দর্য হচ্ছে, প্রতিটি কবিতার প্রতিটি শব্দই যেন প্রকৃতির এক-একটি ছবি। টুকরো টুকরো এইসব ছবি একটির সাথে আরেকটির যে সেতুবন্ধন তা যেন প্রকৃতির অন্তর্তম সুর। পাঠকের স্বপ্ন-কল্পনার জগতে যে সুর ধ্বনিত হয়, সেই সুরেরই প্রতিধ্বনি অনুরণিত হয় এইসব শব্দে। শব্দের কারুকাজ এমন যে, তা পাঠকের মনের খাতায় নানা রঙছবি এঁকে দ্যায়। ছন্দের গতি এতই কোমল যে, একটি শব্দ থেকে আরেকটি শব্দে যেতে যে গতি তৈরি হয় তা আনন্দময়। আশ্চর্য শিল্প-কুশলতায় তিনি কবিতার ভেতর দিয়ে এক-একটি ছবি ও কথা পৌঁছে দিয়েছেন পাঠকের কল্পনার জগতে। সেসব দৃশ্যকথার ছন্দের কারুকাজ এমনই যে, পাঠকের সৌন্দর্য-তৃষ্ণা শৈল্পিক সুধায় তৃপ্ত হয়। ‘রাত্রির গান’ কবিতা থেকে কয়েক পঙক্তি পড়া যাক:

রাত্রির গান/গেয়েছিল এক/নারী
আমার সাথেও/ছিল কিছু পরি/চয়,
এক হাতে রেখে/আগুনের মতো/শাড়ি
বলেছিল, ভীতু/তোমারও কি আছে/ভয়?

ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তের এই পঙক্তিগুচ্ছে শব্দগুলো অনুভূতিকে ভাষারূপ দিতে গার্ড অব অনার দিতে-দিতে নিজের থেকেই এগিয়ে এসেছে। মাহমুদকে শব্দ খুঁজে আনতে হয়নি। বলার যে বিষয় সেই বিষয়কে এইভাবে ছন্দের শৃঙ্খলায় গেঁথে না-তুললে কথার সৌন্দর্য হারাতো। আর, সৌন্দর্য হারালে পঙক্তিগুলো পাঠে পাঠকের মন তৃপ্ত হতো না। মানে, ছন্দের দোলাচালে শব্দগুলো যদি ছন্দিত না হতো তাহলে কবিতার অন্তর্নিহিত বোধের শৈল্পিক প্রকাশ সম্ভব হতো না। একটি শব্দের শব্দের সাথে পরের শব্দের চৌম্বকীয় যে আকর্ষণ সেই আকর্ষণও মূলত ছন্দের স্পন্দনেই তৈরি হয়েছে।

ছন্দে শৃঙ্খলিত কবিতার অন্তমিল কবিতারূপ প্রাসাদ নির্মাণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপকরণ। কারণ, অনেক কবির কবিতা পড়তে গেলে পাঠক বুঝে যান কল্পনা শব্দের সাথে অন্তমিল দিতে কবি এরপর জল্পনা শব্দটি বসাবেন। ফলে, পাঠক ছন্দোবদ্ধ শব্দপাঠের আনন্দ তেমন একটা পান না। শব্দের এই ধরনের ব্যবহার আসলে আরোপিত। কিন্তু মাহমুদ যেহেতু কবিতা লেখেন না, তার ওপর ভর করে কবিতা নিজেই প্রকাশিত হয়, ফলে পাঠক চমৎকৃত হয়ে লক্ষ্য করেন তিনি যে শব্দটি আশা করেছিলেন সে শব্দটির বদলে আরেকটি শব্দে অন্তমিল দেয়া হয়েছে। মাহমুদের এই কৃৎকৌশল পাঠকের কাছে শব্দের আরেক অনাস্বাদিত সৌন্দর্য।

আল মাহমুদের কবিতার থেকে ছন্দের সৌন্দর্যমণ্ডিত কারুকাজের অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরা সম্ভব। ছন্দ আসলে মাহমুদের মজ্জাগত। নানা মাত্রার ছন্দের জাদুকরি কারুকাজ মাহমুদের কবিতায় সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে কোরে তুলেছে হিরন্ময়। তবে পয়ারনির্ভর কবিতাগুলো পাঠককে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা করেছে। কারণ, সেসব কবিতায় রয়েছে ছন্দের সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ। ফলে, তার কবিতার ভেতর শৈল্পিক পর্যটনে পাঠকেরও আনন্দ হয়। কবিতার এই শিল্প-সুষমাই আল মাহমুদকে করে তুলেছে কালোত্তীর্ণ।

মাত্রাভিত্তিক ছন্দ ছাড়াও মাহমুদের গদ্যরীতির কবিতাতেও ছন্দের নেপথ্য উপস্থিতি রয়েছে। ছন্দ মূলত বিশ্ব-প্রকৃতির মরমী সুর। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদনের ভেতরই প্রতিমুহূর্তে ধ্বনিত হয়ে চলেছে ছন্দের ঐকতান। মাহমুদকে মাধ্যম কোরে কবিতা যেহেতু প্রাকৃতিক উপায়েই লিখিত হয়ে যায়, সেহেতু তার গদ্যরীতির কবিতাতেও শব্দের ভাঁজে-ভাঁজে স্পন্দিত হতে থাকে ছন্দ। এই ছন্দের ব্যাকরণিক বোঝাপড়া না-থাকলেও পাঠক উপলব্ধি করতে পারে। ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতা থেকে কয়েক পঙক্তি পড়া যাক:

শেষ ট্রেন ধরব বলে একরকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি
নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ
দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
যাদের শহরে যাবার কথা ছিল, তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ
জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

ওপরের পঙক্তিগুচ্ছ পাঠ করতে করতে আমরা টের পাচ্ছি, একরকম গতি আমাদেরকে টেনে নিয়ে চলেছে। ট্রেন ধরার জন্য কবি যেমনভাবে ছুটছেন, কবিতাটি পুরোটাই পাঠ করাতে কবিও আমাদেরকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। পাঠের এই গতি পাঠক পাচ্ছে একটি শব্দ থেকে আরেকটি শব্দের যোগসূত্র হিসেবে যে সাঁকো মাহমুদ তৈরি করে দিচ্ছেন সেই সাঁকোর স্পন্দিত দোলাচলে। খটোমটো শব্দের কর্কশ ঝনঝন আওয়াজ নেই। প্রাঞ্জল ও সাবলীল শব্দের সাঁকো ধরে পাঠক স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দেই কবিতা পড়ে যেতে পারছে। যারা বলেন, কবিতা লিখতে কোনো ছন্দেরই দরকার পড়ে না, আল মাহমুদ তাদের জন্য শিক্ষক। কেবল মাহমুদই কেন? বাংলা ভাষার যে-কোনো মহৎ কবির কবিতা পাঠেই ছন্দের স্পন্দিত গতি আমরা টের পাবো।

রবীন্দ্রনাথের গদ্যরীতির কবিতা ‘ক্যামিলিয়া’র পাঠ এক্ষেত্রে আমরা স্মরণ করতে পারি। মহৎ কবিদের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাদের কবিতার ভেতর গল্পের ইঙ্গিত থাকে। সেই গল্প হতে পারে একটি কিংবা একের বেশি। অহেতুক শব্দের আবর্জনা দিয়ে তারা কেই-ই শাদা পাতা ভরিয়ে তোলেন না। আমরা দেখেছি, আল মাহমুদের প্রায় সকল কবিতাতেই এরকম গল্পের আভাস পাওয়া যায়। বাংলা কবিতার পাঠক আসলে গল্পপ্রিয়। যে কবিতার ভেতর গল্পের ইঙ্গিত থাকে সেই কবিতা পাঠক বেশ আগ্রহ নিয়েই পাঠ করে। বলা যায়, গল্পময়তার কারণেও আগামী দিনের বাংলা কবিতার পাঠক আল মাহমুদের কবিতা বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়বে। যেমন এখনো পঠিত হয় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত।

আল মাহমুদ আমাদের মাঝে আর বেঁচে নেই। কিন্তু সমকালকে ধারণ করে কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি হেঁটে চলেছেন মহাকালের পথে। যেন তিনি মহাকালের পরিব্রাজক। সমকালে যা-যা দেখেছেন সেসব ভাষায় রূপ দিয়ে গেছেন। এজন্য তাকে নির্মাণ করে নিতে হয়েছে কবিতার স্বকীয় ভাষাশৈলী। কবিতার সৌন্দর্য বিশেষভাবে ফুটিয়ে তুলতে ভাষাশৈলী গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু ভাষা দিয়েই নির্মিত হয় কবিতার অবয়ব। ভাষার ক্ষেত্রে মাহমুদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তার কবিতার ভাষা কোষ্ঠকাঠিন্যমুক্ত। সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষার সাবলীল বুননে তিনি কবিতার ভেতর বিষয়কে পাঠকের হৃদয়গ্রাহী করে তোলেন। এই বুননে চোখ রাখলে দেখা যাবে, শব্দ ব্যবহারে তার পরিমিতি বোধ আরসব কবির জন্য অনুসরণীয়।

শব্দের যথেষ্ট ব্যবহারে কবিতা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এই ভার কবিতার সৌন্দর্য ম্লান করে দ্যায়। কিন্তু মাহমুদের ভাষাশৈলী এতটাই সৌন্দর্যমণ্ডিত যে, সৌন্দর্য-তৃষ্ণার গন্তব্যে পৌঁছুতে পাঠককে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। এই বৈশিষ্ট্য আসলে মাহমুদ পেয়েছেন প্রকৃতির সরলতা থেকে। প্রকৃতির উদারতা তার কবিতাকে দিয়েছে আবহমান বাংলা কবিতার আদল। প্রকৃতির ঐকতান নিবিড়ভাবে ধ্বনিত হয় তার কবিতায়। তাই তো আমরা দেখি, বাংলার লোকজ ঐতিহ্য তার বেশির ভাগ কবিতায়।