আশিকুজ্জামান টুলুর স্মৃতিগদ্য ‘খুঁজে যাচ্ছি জীবনের অর্থ’
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২০
মাঝে মাঝে জীবনে কিছু জায়গা, কিছু সময় কেমন একটা গভীর দাগ কেটে যায় এবং পরবর্তীতে ক্ষত ঠিক হয়ে গেলেও দাগটা থেকেই যায়। সেন্ট ক্যাথেরিন্স ছোট্ট একটা শহর, ২৪ আইডা স্ট্রিট সেই ছোট্ট শহরের আরও ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্টের অ্যাড্রেস। মাত্র সাততলা অ্যাপার্টমেন্ট, ঢোকার কাচের গেটটা অনেক পুরনো। ঢুকে ছোট্ট একটা এলিভেটর, ভীষণ ছোট্ট, ঠিকমতো চারজনও চড়া যায় না। এলিভেটরের অবস্থাও ভীষণ সঙ্গীন, পুরনো হয়ে যাওয়ার কারণে বয়স্ক লোকের মতো কোনোরকমে আস্তে আস্তে উপরে ওঠে, আস্তে আস্তে নামে।
আইডা স্ট্রিট ছোট্ট এক চিলতে একটা স্ট্রিট। অর্থাৎ খুব বেশি হলে দুশো গজ লম্বা একটা রাস্তা। রাস্তার শেষ মাথায় ২৪ আইডা স্ট্রিট অ্যাপার্টমেন্টটা অবস্থিত। কুইন্সটোন স্ট্রিট দিয়ে আইডা স্ট্রিটে ঢোকার মুখে ছোট্ট একটা আধমরা মুদি দোকান। দোকানটাকে দেখলেই মনে হয়, ICU তে আছে বহুদিন যাবত। যেকোনো সময় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। সাথে দোকানও বন্ধ হয়ে যাবে। তিন বছর ছিলাম ওখানে। সেই কবে বাংলাদেশ থেকে এসে প্রথম উঠেছিলাম মিসিসাগায় মাত্র তিন দিনের জন্য, তারপরে এটাই ছিল আমার তিন বছরের ঠিকানা।
এই শহরে ব্রক ইউনিভার্সিটিটা অবস্থিত। ওখানেই আমি পড়াশোনা করেছিলাম বিধায় এই শহরে থাকা। এই ছোট্ট টাউনে তিন বছর থেকে কেমন একটা মায়া হয়ে গিয়েছিল, চাকরি নিয়ে অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছা করছিল না। আমার কাছে ক্যানাডা তখন ওটাই। পড়াশোনা শেষ করে যখন সবাই বড় বড় সংস্থায় চাকরি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে গেল, আমি পড়ে রইলাম ওই ছোট্ট শহরের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে। ওটাই হয়ে গেল আমার মাথা গোঁজার ঠাই। হয়তো বলতে পারেন, বড় চাকরি আমি পাই নাই বলেই রয়ে গিয়েছিলাম।
আমাদের ওই সময়টায় কম্পিউটার সাইন্সে বিএসসি করলেই মিনিমাম ৫০কে’র চাকরি খুব সহজেই পাওয়া যেত এবং সবাই তাই পেয়েছে। আমি আসলে অলস। বিএসসি’র পর শুরু করলাম অনার্স করা। কম্পিউটার সাইন্স ডিপারমেন্টের চেয়ারম্যানের সাথে হয়ে গেল খাতির। একটা চাকরি পেয়ে গেলাম ওনার একটা প্রজেক্টে। এছাড়া আরেকটা চাকরি পেলাম ওয়েল্যান্ড শহরে ওয়েব ডেভেলপার হিসাবে। ওয়েল্যান্ড সেন্ট ক্যাথেরিন্স এর চাইতেও আরও ছোট শহর। সকাল ৮টা থেকে ৫টা পর্যন্ত করি ওয়েল্যান্ড শহরের চাকরিটা, ঠিক ৬টায় এসে পৌঁছাই ব্রক ইউনিভার্সিটিতে চেয়ারম্যানের প্রজেক্টে কাজ করতে। আমার দিন শুরু হয় ৭টায় আর শেষ হয় কোনোদিন রাত ১১টায়, কোনোদিন ১২টায়।
ওয়েল্যান্ডে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে রওনা দিতাম ঠিক সকাল ৭টায়। ধোঁয়াটে শীতের সকাল। একগাদা বরফ ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে আন্ডারগ্রাউন্ড পারকিংয়ে গিয়ে ঢুকতাম। শ্যাম্পেন কালারের হোন্ডা অ্যাকর্ডটা স্টার্ট দিয়ে ভুশ করে উঠে যেতাম মেইন ফ্লোরে। বেরিম্যান অ্যাভেনিউতে উঠে রাইটে গিয়ে কুইন্সটনে লেফট করতাম। তারপর ওয়েস্ট চেষ্টারে রাইট করে কিছুদূর গিয়ে একজিট নিয়ে নিতাম হাইওয়ে ৪০৬ এ। ঠিক মিনিট বিশেক চলার পরই পৌঁছে যেতাম ওয়েল্যান্ডে। কেমন একটা জীবন যার সঠিক লিখায়ন বা চিত্রায়ন আমি এখন বসে শুধুই মনের ক্যানভাসে করতে পারি, লেখার ক্যানভাসে না।
আমাদের অফিসটা খুব ছোট্ট ছিল। একশো বছর পুরানো একটা দোতলা বিল্ডিঙে অফিস। আমাদের প্রোগ্রামারদের বসার জায়গা ছিল বেজমেন্টে। সারাদিন আলোজ্বলা অন্ধকার বেজমেন্ট। সবার আলাদা আলাদা ছোট্ট ছোট্ট কূপ। একমনে বসে কাজ করা, ঠিক সকাল ১০টায় ১০ মিনিট সিগারেট খাওয়ার ব্রেক, সাথে এক কাপ কফি। পাশেই ছিল টিম হরটন, আমি যাওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করতাম অন্য কলিগদের কফি লাগবে কিনা। ওরা যাওয়ার সময়ও আমাকে জিজ্ঞাসা করতো। এক কাপ স্মল ডাবল ডাবল নিয়েই বেন্সন হেজেসটা ধরাতাম। ক্যানাডার বেন্সন সিগারেটের সাইজ নরমালের চাইতে লম্বায় বড় এবং এক প্যাকেটে ২৫টা থাকতো। সহজে শেষ হতো না। অনেককে দেখতাম, ছোট সাইজের সিগারেট কিনতো। অর্থাৎ নরমাল সাইজের চাইতেও ছোট সাইজের সিগারেট পাওয়া যেত তাদের জন্য যারা নিকোটিন কম খেতে চাইত। তবে আমার ভালো লাগতো বড় সিগারেট, অনেকক্ষণ টানা যেত আর জ্বলজ্বলে অতীত ভাবা যেত বেশ কিছুক্ষণের জন্য।
ঠিক ১২:৩০ এ লাঞ্চ ব্রেক হতো। আমি বের হয়ে অফিসের ঠিক পাশের ছোট্ট স্ট্রিপ মলটায় গিয়ে ছয় ইঞ্চি সাইজের একটা সাবওয়ে খেতাম। যদিও ভালো লাগতো না, তবুও। ওখানকার অধিবাসীদের জীবন খুব খুটে খুটে দেখতাম। খেয়াল করতাম চাল-চলন, কথা বলা, সবকিছু। একটা বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, সাদারা বেশির ভাগ মানুষ জীবনের ব্যাপারে খুব বেশি হাই অ্যাম্বিশন রাখে না। জীবনটাকে খুব সাধারণভাবে নেয়। হয়তো ছোট্ট একটা বাসায় যগের পর যুগ কাটিয়ে দেয় কোনো কমপ্লেইন ছাড়া। হয়তো ছোট কোনো শহরে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয় কোনো নতুনত্ব ছাড়া। অনেক ওয়েল্যান্ডে অধিবাসীকে দেখেছি, কোনোদিন টোরান্টতে আসেনি কিংবা টোরান্টোতে এসে বসবাস করার চিন্তাও করে না। যেখানে যেভাবে আছে, সেখানেই থেকে যেতে চায়। ওদের এই একেবারে সাদামাটা জীবনটা আমাকে এত বেশি টানে, যা আমি কাউকে আজবধি বুঝিয়ে বলি নাই বা বলতে পারি নাই।
ওদের কাছে জীবনের অর্থটা আমাদের থেকে বেশ খানিকটা ভিন্ন। আমাদের দেশ থেকে আসা ম্যাক্সিমাম লোকের বড় বড় বাড়ি কিংবা দামি গাড়ি আছে। কিন্তু বাপ দাদাসহ চৌদ্দ গুষ্টি এখানে জন্মানো অনেক সাদাদেরই হয়তো খুব দামি কোনো বাড়ি কিংবা গাড়ি নাই। অথবা অতবড় কোনো স্বপ্নও নাই। আছে যখন তখন এদিক সেদিক পরাণ খুলে ঘুরে বেড়ানো, কিংবা অপরিচিত কোনো লেকে গিয়ে মাছ ধরা। কিংবা সী-বিচের বালিতে সটান হয়ে শুয়ে থাকা কিংবা বোট নিয়ে অন্টারিও লেকের মাঝে গিয়ে চাঁদনি রাতে মুরগী বারবিকিউ করে বিয়ার দিয়ে খাওয়া আর একদৃষ্টিতে তারকাখচিত বিশাল আকাশের তাকিয়ে থাকা। অনেকে বলে ওদের আবেগ নাই। কথাটা খুবই ভুল। ওদের অনেক গভীর আবেগ আছে, তবে প্রকাশটা ভিন্ন। ওরা একটা কথায় খুব বিশ্বাস করে, কিছু অনুভূতি প্রকাশের নয়, শুধু উপলব্ধির।
আমি ওখানে থাকতে থাকতে কিছুটা ওদের মতো হয়ে গেলাম। সন্ধার সময় একটা ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া করে নিয়ে আসি। ছবিটা শেষ করে ডিনার সেরে অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাই এবং হারিয়ে যাই আমার পুরানো সাউন্ড গার্ডেন কিংবা সারগাম স্টুডিওতে। হারিয়ে যাই ঢাকা শহরের যানজটে, হারিয়ে যাই ফেলে আসা বন্ধুদের আড্ডামুখর প্রহরে। ঢাকা শহরের এ গলি থেকে থেকে সে গলি, এ স্টুডিও থেকে সে স্টুডিও, এক জেলা থেকে আরেক জেলা ঘুরে বেড়ানো আমি, তখন ওয়েব ডেভেলপার যার দিন শুরু হয় ৭টায় এবং শেষ হয় রাত ১২টায়। কী সুন্দর জীবন, এই জীবনের জন্যেই তো এসেছিলাম ক্যানাডা। এইতো জীবনের সার্থকতা। এই কথাটা ভেবে একদিন সত্যি মনে হয়েছিল, জীবনটা কত অর্থহীন! অনেক সময় এই পড়াশোনা কিংবা ইমিগ্রেশন কোনো অর্থই রাখে না। আসলে যে যেভাবে জীবনটা দেখে, তার কাছে জীবনের সংজ্ঞাটা নিজস্ব হয়। আমারও তাই হলো। বিদেশে বসবাস মানেই আমার কাছে ইংরেজি সিনামায় দেখা একটা রঙিন জীবন ছিল। কিন্তু বাস্তবে যখন দেখলাম, সেন্ট ক্যাথারিন্সের অধিবাসীরা সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ বাসায় ফিরে ৯টা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়ে পরের দিনের কড়চার জন্য এবং আমি আমার পুরনো সারারাত জাগা অভ্যাস নিয়ে অন্ধকারে চোখ খুলে জেগে রই সারারাত, তখন জীবনের অর্থ খোঁজার জন্য মনটা পাগল পারা হয়ে যায়। যদি সত্যি কথা বলি তাহলে এখনো খুঁজে যাচ্ছি জীবনের অর্থ।
এতক্ষণ যা বললাম সব আজ থেকে ২০ বছর আগের কথা। কথাগুলি ছিল আমার প্রথম দেখা শহর সেন্ট ক্যাথারিন্সের কড়চা। আমার প্রবাসী প্রেম, প্রবাসী হিসাবে প্রথম কষ্ট পাওয়া এবং ক্রমেই শুকিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে সেরে ওঠা ক্ষত। ক্ষতটা সেরে গিয়েছে কিন্তু দাগটা এখনও রয়ে গিয়েছে। জীবনে তাই হয়, ক্ষত শুকিয়ে গেলেও দাগটা কিন্তু থেকেই যায় যতই ফেয়ার এন্ড লাভলি লাগানো হোক না কেন। আমার দাগটা নিয়ে এখনও মাঝে মাঝে খুব গভীর রাতে ছুটে যাই সেই 24 Ida Street এ কিংবা নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতায় ঘুরে বেড়াই সেন্ট ক্যাথারিন্সের রাস্তায় রাস্তায় আর খুঁজে ফিরি ফেলে আসা অসম্ভব কষ্টের সময়টা।
লেখক: কণ্ঠশিল্পী
























