আশিকুজ্জামান টুলুর স্মৃতিগদ্য ‘ছাদের সেই মেয়েটি’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২০

ছোটবেলায় পাশের ছাদের কিংবা পাশের বাসার মেয়েটার প্রতি কেমন যেন একটা অমোঘ আকর্ষণ থাকে। খুব ভালো লাগে তা চেহারা যেমনই হোক না কেন। বিশেষ করে স্কুলড্রেস পরা মেয়েগুলির প্রতি ভালোলাগাটা খুব বেশি থাকে। আরেকটা বিষয় হলো, একটু বয়সে বড় মেয়েদের প্রতি ওই বয়সে কেমন যেন একটা ভালোলাগা থাকে। আমি জানি না অন্য ছেলেদের ব্যাপারে, তবে আমার ছেলেবেলায় বড় মেয়ে কিংবা বড় আপাদের প্রতি অদ্ভুত একটা আকর্ষণ ছিল। ওই সময়ে আমাদের পাড়ার পলি আপা যিনি বয়সে বেশ বড়ই ছিলেন, তার প্রতি ক্রাশিত হইলাম। একবার এক ঈদে পলি আপাকে সাহস করে বলেই ফেললাম, আপা কোলাকুলি করবেন না? তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। পলি আপা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো, ক্লাস নাইনে উঠো তারপর কোলাকুলি করবো।

আমি কিন্তু তা দিয়ে বসে থাকলাম কবে নাইনে উঠবো। আশায় আশায় একসময় নাইনে উঠে গেলাম। কিন্তু একটু বড় হয়ে যাওয়ায় লজ্জায় পলি আপাকে আর বলতে পারলাম না, মনটা কোলাকুলি করতে চায় আপনার সাথে। চোখের সামনে দেখতে থাকলাম পলি আপা ওনার মন মতোদের সাথে কোলাকুলি করতে থাকলো। আমি শুধু আনকোলাকুলিড হয়ে পড়ে রইলাম। পলি আপার অবশ্য কিছু আসে যায় না। কারণ ওনার কোলাকুলির শখতো মিটেই যাচ্ছে, শুধু আমি গরিব পড়ে থাকছি কোলাকুলির আশায়।

ফিরে যাই আবার সেই ক্লাস সেভেনে। আমাদের পুরান ঢাকার বাসাটা তিনতলা ছিল। তিনতলার ছাদে দুটো বড় বড় ঘর ছিল, যেখানে দুজন থাকতো। ছাদে ওঠার মেইন গেটে তালা লাগানো থাকতো না। আমরা যেকোনো সময়ে যেতে পারতাম। বিকেলে মাঝে মাঝে ছাদে গিয়ে সময় কাটাতাম। ঘুড়ি উড়াতাম। ওই দুটা ঘরের ছাদেও উঠে যেতাম। আমাদের বিল্ডিঙটা ওই সময়ে সবচাইতে উঁচু ছিল। অর্থাৎ তিনতলা এবং তার উপরে আরও দুটা রুমের ছাদ, যেটা বেসিক্যালি চারতলার ছাদ ছিল। ওই সময় দুই কি তিনতলা খুব উঁচু বিল্ডিং হিসাবে পরিগণিত হতো। আমাদের ছাদ থেকে পুরান ঢাকার প্রায় অর্ধেকটা দেখা যেত। নওয়াবপুর রোডকে যদি পুরান ঢাকার মিডিল ডিভাইডার ধরে ভাগ করা যেত, তাহলে মিডিল ডিভাইডারের পূর্বদিকের সত্তুর ভাগ দেখা যেত ওই ছাদ থেকে। উত্তর দিকে ডিআইটি বিল্ডিং, বায়তুল মুকাররম ধরে পুরানা পল্টন, সেক্রেটারিয়েটসহ আরও অনেক দূর দেখা যেত। পূর্বে তাকালে মতিঝিল, ওয়াপদা বিল্ডিং, ইলিসিয়াম ভবন দেখা যেত, আর দক্ষিণে তাকালে তেমন উঁচু কোনো স্থাপনা দেখা যেত না। তবে গালিচার মতো পুরান ঢাকার ২ কি ৩ তলা হাজার হাজার পুরানো দালান দেখা যেত। দৃষ্টি গ্যান্ডারিয়া পর্যন্ত চলে যেত। ওইসব দালানের অনেক ছাদেই উড়াতে দেখা যেত নানান রঙের ঘুড়ি। কী এক অদ্ভুত সময় সারা বিকেলটাকে ছেয়ে রাখতো, ভালোলাগায় মগ্ন করে রাখতো আমাদের ছোটবেলাকে।

তবে আমাদের বাসার সবচাইতে উঁচু ছাদ, যেটা আসলে চারতলার ছাদ, সেটাতে উঠতে গিয়ে ভয় লাগতো এবং ওঠার পরেও ভয় লাগতো। অবশ্য সেটা কয়েক মিনিটের জন্য। তারপরই মনটা উড়ে যেত আকাশে ভেসে থাকা মেঘের দেশে, মেঘ ছেড়ে নীল আকাশেও হারাতো। একমাত্র মন, যাকে যখন যেখানে ইচ্ছা সেখানে হারানো যায়। ওই ছাদটায় উঠলে মনে হতো, পৃথিবীর সবচাইতে উচ্চতম স্থানে উঠে পড়েছি। খুব ভালো লাগতো। তিনতলার ছাদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আরেকটা তিনতলা বিল্ডিং ছিল। একদিন হঠাৎ দেখি, ওই ছাদে একটা মেয়ে উঠেছে এবং ঠিক আমাদের ছাদের কোনাকুনি এসে দাঁড়িয়েছে যেখান থেকে আমি ওকে এবং ও আমাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ওকে দেখামাত্রই বিকেলের বাতাসে মনটা প্রেমে টইটুম্বুর হয়ে গেল। মেয়েটাও দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে দেখেও না দেখার ভান করতে থাকলো। আমার মুহূর্তে ভালো লেগে গেল। মনটা এমনই নরম ছিল যে, কি পরিচয়, কি চেহারা কিছু না জেনেই ভালো লেগে যেত। আমি রেডিমেড একটা হাসি দিলাম, ও শুধু মুখটাকে গোমড়া করে তাকিয়ে দেখলো এবং বিষয়টা অপছন্দ করেছে সেটা চেহারায় বুঝিয়ে দিলো তবে ছাদের কোনা থেকে সরলো না। আমি দমে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ও চলে গেল, আমিও নেমে এলাম ছাদ থেকে।

পরেরদিন আবার নতুন আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে ঈদের শার্ট-প্যান্ট পরে ছাদে উঠে গেলাম বিকেলবেলায়। উঠে দেখি, ও আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। খুব ভালো লাগলো। আজ আমাকে দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিলো, আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। দৌড়ে নিচে গেলাম এবং একটা কাগজ ও কলম নিয়ে আবার ছাদে ফিরে এলাম। কী যেন দু’লাইন লিখে ফেললাম এবং কাগজটায় একটা ছোট্ট ইট পেঁচিয়ে ছুড়ে মারলাম ওদের ছাদে। ও সেটা তুলে নিয়ে পড়লো এবং চলে গেল নিচে। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। ও একটু পরে ফিরে এলো এবং ঠিক আমার মতো করে ছুড়ে মারলো ওর চিঠিটা। মেয়ে মানুষের ছুড়ে মারায় তেমন জোর ছিল না বিধায় ইটসহ চিঠিটা দুই বিল্ডিঙের মাঝখানে একতলা আজিজদের টিনের চালে গিয়ে পড়লো। হঠাৎ এভাবে মাঝখানে পড়ে যাওয়ায় ও ভয় পেয়ে গেল, যদি কেউ দেখে ফেলে! আমি ওকে ইশারায় আসস্ত করে দৌড় দিলাম নিচে। আজিজদের বাসার ছাদটা আমার ঘরের ঠিক সামনেই ছিল। তাই চিঠিটা কালেক্ট করতে ঝামেলা হলো না। হাতে পেয়েই মুহূর্তে খুলে ফেললাম এবং পড়ে ফেললাম। লেখা ছিল, কাল বিকালে তোমাদের বাসার সামনে দিয়ে যাব, থেকো ওখানে। আমার তো ‘দিন কাটে না, আমার রাত কাটে না’ অবস্থা।

পরদিন আবার আরেক সেট নতুন প্যান্টশার্ট পরে বিকেলে আমাদের বাসার গলির মাথায় জাফর ভাইয়ের পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম ওর অপেক্ষায়। কখন আসবে তাতো জানি না, তবুও দাঁড়িয়ে থাকতে অসম্ভব ভালো লাগলো। ঠিক আধা ঘণ্টা পরে দেখলাম দুইটা মেয়ে স্কুলড্রেস পরে আমাদের বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমি সেভাবে খেয়াল করতে পারিনি। কারণ খুব উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো আলাদা বিষয় ছিল না মেয়ে দুটোর ড্রেসআপ কিংবা চেহারায়। এখানে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, কোনো মেয়েকে স্কুলড্রেসে দেখে প্রেমের অফার দেয়ার আগে বাসার ড্রেসে কিংবা অন্য ড্রেসে দেখে অফার দেয়া ভালো। কারণ স্কুলড্রেসে যেকোনো মেয়েকেই একটু বেশি সুন্দর লাগে। যাইহোক, ওদের মধ্যে একজন আমার দিকে তাকিয়ে বেশ হাসছিল বিধায় খেয়াল করে দেখলাম, আরে এই তো সেই ছাদের মেয়েটা!। আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটাকে। এতদিন দূর থেকে দেখেছি, আজ দেখলাম একেবারে কাছে থেকে। মনটা ভেঙে গেল। মানুষ কি ভাবে আর কি হয়! ‘চেহারা বড় বিষয় না, মনটাই আসল’ এই কথা বই পুস্তক কিংবা বেসিক ফেসবুকারদের বাণী হিসাবে লেখা যায় কিন্তু বাস্তবে মেয়েদের সুন্দর একটা চেহারার কোনো বিকল্প নাই। বিষয়টা সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েহিলাম। ওই দিনের পর থেকে আমি আর কোনোদিন আমাদের ছাদে উঠিনি।

লেখক: কণ্ঠশিল্পী