কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম

ইসলা‌মের নবির মাহাত্ম্য প্রচা‌রে এত আপত্তি কেন?

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : নভেম্বর ১২, ২০২০

বুধবার আবু তাহের সরফরাজ তার ফেসবুক ওয়ালে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে মন্তব্য এবং পাল্টা মন্তব্য করেন কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যকার কামরুল আহসান, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা আবু সাইয়ীদ এবং সমাজ-ইতিহাস গবেষক ও শিল্প-সাংস্কৃতির সমালোচক রাহমান চৌধুরী এবং কবি এহসান হাবীব। এসব মন্তব্যে নজরুলের ইসলামি ভাবধারা এবং একটি শ্রেণির বিরোধিতার বিষয়টি উঠে এসেছে। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তা তুলে ধরা হলো— ছাড়পত্র ডেস্ক

আবু তাহের সরফরাজ: কাজী নজরুল ইসলাম এই সময়ে ইসলামি গানের চর্চা (ইসলামি ভাবধারায় লেখালেখি) করলে মারাত্মক ফ্যাসাদে পড়ে যেতেন। একদিকে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের (প্রকৃতপ্রস্তাবে পড়াশোনা না করা অথচ নিজেকে জ্ঞানী ভাবা জনগোষ্ঠি) তাকে মৌলবাদী আখ্যা দিয়ে উঠেপড়ে লাগত। আরদিকে, প্রচলিত ইসলামের (প্রচলিত ইসলাম প্রকৃত ইসলাম নয়) ঝাণ্ডাবাহীরা তাকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলত। নজরুল বেঁচে গেছেন। বিভ্রান্তির জালে বন্দি থাকাই আজকের মানুষের নিয়তি!
কামরুল আহসান: নজরুল বাঁচলেও তুই বাঁচবি না সর্পরাজ।

আবু তাহের সরফরাজ: কেন, আমি আবার কি করলাম?
কামরুল আহসান: তুই তো নব্যনজরুল!

আবু তাহের সরফরাজ: দ্যাখ, আমি কারো সাতে-পাঁচে নাই। নিজের ধ্যানে থাকি। খুব বেশি তাড়না বোধ না করলে এখন আর কিছু লিখতে চাই না। কবি-লেখকও হতে চাই না। কোনোমতে খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারলেই আমি খুশি। ফলে আমার লেখালেখি নিয়ে কারো ক্ষোভ তৈরি হলে বিনয় দেখানো ছাড়া আমার আর কোনো অস্ত্র নেই। জগতে সবাই বড় লেখক, আমি ছাড়া।
কামরুল আহসান: এ তোর হঠকারিতা।

আবু তাহের সরফরাজ: বিনয় যদি হঠকারিতা হয় তাহলে অমেধাবীদের আস্ফালনকে তুই কি বলবি?
কামরুল আহসান: মূর্খতা।

রাহমান চৌধুরী: নজরুলকে নিয়ে এটা চমৎকার একটি বিশ্লেষণ। কিন্তু সে যু‌গেও প্রথম প্রথম তি‌নি গোঁড়া মুসলমান‌দের আক্রমণের কম শিকার হন‌নি।
আবু তাহের সরফরাজ: সে তো জানিই। তবে সেসময়ের প্রেক্ষাপট আজকের মতো এতটা ভয়াবহ ছিল না। সত্য বোঝার মতো ক্ষমতা কিছু মানুষের তখন ছিল। এখন তাও নেই।

আবু সাইয়ীদ: নজরুল এইসব লিখেছেন টাকার জন্য। আজকাল কবিদের টাকার অতটা অভাব নেই।
আবু তাহের সরফরাজ: টাকার জন্যেই হোক কিম্বা ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই হোক, লিখেছেন তো। আর, কবিদের টাকার অভাব তখনো ছিল, এখনো আছে। শুধু ধান্দাবাজ কবিদের (তাদের কবিতা হয় না যদিও, তবু তারা কবি) টাকার অভাব হয় না।

আবু সাইয়ীদ: একমত। নজরুল লিখেছেন, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মাদ’— ইসলামে ত্রিভুবন বলে কিছু নেই।
রাহমান চৌধুরী: নজরুল টাক‌ার জন্য লে‌খেন‌নি। লি‌খে‌ছেন বি‌ভিন্ন কার‌ণে। আব্বাসউদ্দীনের আর তার গ্রা‌মো‌ফোন কম্পানির অনু‌রো‌ধেও। লি‌খে‌ছেন, তখন একদল তা‌কে কা‌ফের চি‌হ্নিত কর‌তে চাওয়ায়। তি‌নি প্রমাণ ক‌রে‌ছেন, তি‌নি তা‌দের চে‌য়ে কম ইসলাম বা নবিকে জা‌নেন না। তি‌নি বিরাট এক সমস্যার সম্মুখীন হ‌য়ে‌ছিলেন কিছু গোঁড়া মুসলমান‌দের দ্বারা। ক‌বি গোলাম মুস্তাফার স‌ঙ্গে পর্যন্ত তার বি‌রোধ হ‌য়ে‌ছিল একদা।

আবু সাইয়ীদ: উনি শুধু কবিতাই নয়, অনেক ইসলামি গানও লিখেছেন। কবিতার চেয়ে গান লেখায় আয় বেশি। কবিতায় উনি ধর্মের সমালোচনা করেছেন।
আবু তাহের সরফরাজ: প্রকৃত ইসলামকে তুলে ধরে প্রচলিত ইসলামের ঝাণ্ডাবাহীদের সমালোচনা তার গানেও আছে।

রাহমান চৌধুরী: ইসলা‌মি গান উনি টাকার জন্য লে‌খেন‌নি। কিছুই টাকার জন্য লিখ‌তেন না। টাকা পে‌তেন, টাকা চাইতেন, টাকা দরকার ছিল। কিন্তু টাকার জন্য নি‌জের লেখা বা গান‌কে বি‌ক্রি ক‌রেন‌নি। পণ্য বানান‌নি নি‌জের লেখা‌কে। কিছু মানু‌ষের অনু‌রো‌ধে বি‌শেষ ক‌রে আব্বাসউদ্দী‌নের অনু‌রো‌ধে প্রথম ইসলামি গান লে‌খেন। সম্ভবত সেটা ঈদের গান ‘রমজা‌নের ঐ রোজার শে‌ষে এলো খু‌শির ঈদ।’ এটা খুব জন‌প্রিয়তা পাওয়ার পর উনার কা‌ছে দা‌বি বাড়‌তে থা‌কে। তি‌নি মুসলমান সমা‌জের স‌ঙ্গে নি‌জের ভুল বুঝাবু‌ঝি দূর করার সু‌যোগ পান। নজরুলের এসব গান সাধারণ হিন্দু সমা‌জেও খুব কদর পে‌য়ে‌ছিল ব‌লেই জানা যায়। তখনকার সমাজ আজ‌কের ম‌তো এত কট্টর বা বি‌ভেদপূর্ণ ছিল না। হিন্দু-মুসলমান শ‌ব্দের এত প্রয়োগ ছিল না সাধারণ ঘ‌রে ঘ‌রে।
আবু সাইয়ীদ: একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে কেন যে ধর্মের দিকে টেনে নিচ্ছেন! বেচারা তখন মৌলবাদীদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন, এখন আবার আদৃত হচ্ছেন।
আবু তাহের সরফরাজ: ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি আসলে কোনো মানে বহন করে না। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষ্য অনুযায়ী, জগতে প্রতিটি পদার্থেরই নিজ নিজ ধর্ম রয়েছে। মানুষও এর বাইরে নয়।

 

আবু সাইয়ীদ: বস্তুর ধর্ম এবং ঈশ্বর প্রেরিত ধর্ম যে এক নয়, তা সকল কবিই জানেন।

আবু তাহের সরফরাজ: ধর্ম কথাটার মানে হচ্ছে, স্বভাবগত প্রকৃতি। ঈশ্বরের সৃষ্টি প্রতিটি বস্তুরই নিজ নিজ স্বভাবগত প্রকৃতি রয়েছে। মানুষকে সেই প্রকৃতি জানাতেই ঈশ্বর ধর্মীয় গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন। এ কারণে যে, সেই প্রকৃতি অনুযায়ী যেন মানুষ জীবনযাপন করে। মানুষ ছাড়া প্রকৃতির সব জিনিসই প্রকৃতির নির্দিষ্ট নিময় মেনে চলে। কেবল মানুষ ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে সে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে পারে।  

রাহমান চৌধুরী: ধর্ম‌নির‌পেক্ষ নজরুল‌কে আমি ধর্ম‌নির‌পেক্ষই রাখ‌ছি। কিন্তু তি‌নি যে তার‌চে‌য়ে মহান ছি‌লেন, সেটাই বল‌তে চে‌য়ে‌ছি। তি‌নি ইসলাম ধর্ম প্রচা‌রের জন্য জেহাদ ক‌রেন‌নি, আবার বৃহত্তর মুসলমান জন‌গোষ্ঠীর অনুভূ‌তির বাইরেও ছি‌লেন না। তি‌নি সাধারণ মুসলমান সমা‌জের জন‌গোষ্ঠি থেকে  বি‌চ্ছিন্ন হ‌য়ে ‘এলিট’ বা ‘বুদ্ধিজীবী’ হি‌সে‌বে বাস ক‌রেন‌নি। নিজ ভূ‌মির মা‌টির স‌ঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল, নিজ সমা‌জের সাধারণ মানু‌ষের চাওয়া-পাওয়ার চা‌হিদা মি‌টি‌য়ে‌ছেন। আমাদের ম‌তো `কুক্ষ‌ণে ভিক্ষাবৃ‌ত্তি আচরি’ তৃষ্ণ‌ার্ত হ‌য়ে পাশ্চাত্য তাকে পুরস্কার দে‌বে কিনা, পাশ্চা‌ত্যের স্বীকৃ‌তি পা‌বেন কিনা— সে বি‌বেচনা মাথায় রে‌খে লিখ‌তে যান‌নি। যদি একজন মাও সেতুং, মার্কস, লে‌নিন‌কে নি‌য়ে ক‌বিতা লিখতে পা‌রেন, আর একজন বুদ্ধ‌কে নি‌য়ে লিখ‌বেন, কেউ শ্রীকৃষ্ণ-রাধা‌কে নি‌য়ে, কেউ মীরার না‌মে, কেউ ইসলা‌মের নবি‌কে নি‌য়ে। মানুষ তার প্রিয় ব্যক্তিকে নি‌য়ে গান লিখ‌বেন বা তার গান শুন‌তে চাইবেন। গান্ধীর ম‌তো ধা‌র্মিক হিন্দু বর্ণপ্রথায় বিশ্বাসী মানুষ ইসলা‌মের নবি সম্প‌র্কে উচ্চ প্রশংসা কর‌তেন। মানু‌ষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। বহুকাল ধ‌রে তা-ই চল‌ছে। ইসলা‌মের নবির মাহাত্ম্য প্রচা‌রে তাহ‌লে হঠাৎ এত আপত্তি কেন? নজরুল যে ইসলা‌মের নবির মাহাত্ম্য প্রচার ক‌রে বহু কিছু লি‌খে‌ছেন সেই সত্য প্রকা‌শিত হ‌লে, সামান্য সমস্যা নেই। লু‌কোচু‌রিরও কিছু নেই। ‌তি‌নি অর্থের জন্য এসব লিখ‌তেন ব‌লে তাকে রক্ষা করার কিছু নেই। সত্য সূ‌র্যের আলোর ম‌তো। তি‌নি শ্যামা সঙ্গীত লি‌খে‌ছেন, তি‌নি ভগবান বু‌কে পদ‌চিহ্ন এঁ‌কে দি‌য়ে‌ছেন। তি‌নি তার সম‌য়ের সাধারণ মানু‌ষের মনের খোরাক মি‌টি‌য়ে‌ছেন। তি‌নি সাধারণ মানু‌ষের ক‌বি, সাধারণ মানু‌ষের গী‌তিকার। তি‌নি ধর্ম‌নির‌পেক্ষ ছি‌লেন না, এ কথা কি কেউ ব‌লে‌ছে? তি‌নি ধা‌র্মিক হ‌লেও সমস্যা ছিল না। লিও টলস্টয় য‌থেষ্ট ধা‌র্মিক ছি‌লেন, তা‌তে তার লেখা‌লেখির সঙ্কট ‌হয়‌নি। ‌তি‌নি ধা‌র্মিক হ‌য়েও মানবসভ্যতার প্রগ‌তির বিরু‌দ্ধে লে‌খেন‌নি। টলস্ট‌য়ের ম‌তো ধা‌র্মি‌কের লেখা সকল মার্কসবাদীরা খুব গুরুত্ব ‌দি‌য়ে পাঠ ক‌রেন, কারণ বি‌শ্বের সেরা‌ সা‌হিত্য সেগুলো। আর দুঃখের স‌ঙ্গে জানা‌চ্ছি, মৌলবাদ শব্দটার প্রকৃত অর্থ না জে‌নে আমরা কথাটা ব্যবহার ক‌রে থা‌কি। বাংলা‌দে‌শে মানুষকে আজকাল আমরা চিনি বা বিচার ক‌রি কিছু শব্দ দি‌য়ে— মৌলবাদী, ধর্ম‌নির‌পেক্ষ, সাম্প্রদা‌য়িক, মু‌ক্তি‌যোদ্ধা, রাজাকার, মু‌ক্তিযু‌দ্ধের প‌ক্ষের শ‌ক্তি ইত্যা‌দি। মনবসভ্যতা এত ক্ষুদ্র নয় যে, ক‌য়েক‌টি শব্দ দি‌য়ে তা‌কে প্রকাশ করা যায়! চট ক‌রে কা‌রো প্রতি তকমা ব্যবহার বন্ধ করা দরকার।
আবু তাহের সরফরাজ: দারুণ বলেছেন। এমন স্বচ্ছ চিন্তা যদি এ দেশের অনন্ত একশো মানুষের হতো, তাহলে হয়তো বর্তমান প্রেক্ষাপট কিছু হলেও বদলাতে শুরু করত।

 

আবু সাইয়ীদ: খিচুড়ি খেতে ভালোই লাগে, তবে খিচুড়ি খিচুড়িই।
রাহমান চৌধুরী: স‌ত্যি বল‌তে, আপনার কথাটার মর্মার্থ বুঝ‌তে পা‌রি‌নি। পোলাও খে‌তে ভা‌লো, কিন্তু সেটাও পোলাও। তা‌তে কী বোঝা গেল? কথাটা সব ক্ষে‌ত্রে সত্য, যে যা প্রিয় খাদ্য ‌হি‌সে‌বে খায়, সেটা তার কা‌ছে প্রিয় আর নামটাও পা‌ল্টে‌ যায় না।

 

আবু সাইয়ীদ: রাহমান ভাই, আপনি লেখক মানুষ। দ্রুত অনেক বাক্য লিখে ফেলতে পারেন। আমি অক্ষম। যাই হোক, আমি মনে করি, কবিত্ব এমন এক সত্তা— কবি নিজেই ঈশ্বর রচনা করতে পারেন। কবি কেন অন্যদের সৃষ্ট অনেক ঈশ্বরের বন্দনা করবেন? তিনি বন্দনা করবেন তার নিজের রচিত ঈশ্বরকে।

কামরুল আহসান: সাইয়ীদ ভাই, এ-কথা বোঝার মতো ক্ষমতা অনেক শিল্পীরই নাই। এ-দেশের বেশির ভাগ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পই স্রেফ স্বভাব কবি, ভাবের লোক। যুক্তিবোধ তাদের বিকাশ হয় নাই।

 

রাহমান চৌধুরী: বি‌শ্বে মানুষ যেখা‌নে নানা সম্প্রদা‌য়ে, নানা গো‌ত্রে দেশকা‌লের প্রে‌ক্ষি‌তে বিভক্ত, বি‌শেষ ক‌রে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বি‌শেষ একধর‌নের ছাঁ‌চে তৈরি ‘ক‌বি’ থ‌াক‌তে পা‌রে না। কিছুই থাক‌তে পা‌রে না। আশা‌ করাটাও ঠিক না। শ্রেণি‌বিভক্ত সমা‌জে সা‌হিত্য-সংস্কৃ‌তি ভোগ-উপ‌ভোগ সব‌কিছু সেভা‌বেই নি‌র্মিত হয়, প্রধানত শ্রেণির ভি‌ত্তি‌তে, কিন্তু কো‌নোটাই ছাঁচে গড়া নয়। সবটাই ব্যক্তিসত্তা, সমাজসত্তা, আর রাজ‌নৈ‌তিক সত্তার সং‌মিশ্রণ।

আবু সাইয়ীদ: এবার স‌ত্যি বল‌তে আপনার কথাটার মর্মার্থ আমি বুঝ‌তে পা‌রি‌নি। এ লম্বা আলোচনা। বাদ দেয়া যাক। আসলে অন্যের পোস্টে নাক না গলানোই উত্তম।

 

এহসান হাবীব: জাস্ট ফাক দেম। তুই কি কাউরে তোর লেখালেখি বন্ধক দিছস? যা মনে চায় তাই লিখবি।
আবু তাহের সরফরাজ: কৃতজ্ঞতা দোস্ত, ভালোবাসা।