
কাজী নাসির মামুন
কবি কাজী নাসির মামুনের সঙ্গে গপসপ
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৫
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মেধাবী কবি কাজী নাসির মামুনের জন্ম ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর। শৈশব থেকে বসবাস করছেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। পেশায় সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজ মুক্তাগাছা, ময়মননিংহ। কবিতার বই: লখিন্দরের গান (২০০৬), অশ্রুপার্বণ (২০১১), কাক তার ভোরের কোকিল (২০১৭), রোহিঙ্গাপুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই (২০১৮), মুহূর্তগুলো তরবারি (২০২২) এবং রাষ্ট্রনৈতিক সনেটগুচ্ছ (২০২৫)। এক সময় সম্পাদনা করতেন লিটলম্যাগ `মেইনরোড`। স্বীকৃতি: কবিতাসংক্রান্তি সম্মাননা ২০০৭ এবং লোক লেখক সম্মাননা ২০২০। কবিতা, গণমাধ্যম, রাষ্ট্র ও জীবন নিয়ে কাজী নাসির মামুন কথা বলেছেন প্রথম দশকের আরেক মেধাবী কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজের সঙ্গে।
সরফরাজ: কবিতা কী? কবিতা কি লেখা যায় নাকি কবিতা হয়ে ওঠার বিষয়?
মামুন: বহুবার বহুভাবে এমন প্রশ্ন আমাকে করা হয়েছে। না, কোনো সদুত্তর দেই নাই বা দিতে পারি নাই। কবিতা কী? একথা জানার আগেই কবিতা লেখতে শুরু করি। ফলে কবিতার সংজ্ঞায়ন আমার কর্তব্য হয়া ওঠে নাই। যখন সেই কর্তব্য বোধ করবো তখন হয়তো আর কবিতা লিখতে পারবো না। আমাদের আবহমান অবচেতনায় কবিতা নিয়া একটা ধারণা তো আছেই। সেইটারে সংজ্ঞায়নে সীমিত করলে কবিতার ক্ষতি হবে। ওই কাজটা কবির জন্য নয়। গবেষকরা ভাবতে পারেন। তবে নশ্বরতার উপলব্ধিই আমার শিল্পচেতনার মৌলিক ভিত্তি। আমরা আছি; কিন্তু থাকবো না। ফলে যাপনের মধ্যে উদযাপনের মহিমা দিতে চাই। জীবনের মধ্যে দিতে চাই উজ্জীবনের সারবস্তু। তাই আমরা কবিতা লেখি, গান গাই, ছবি আঁকি। এইটাই আমার শিল্পদর্শন।
হ্যাঁ, কবিতা হয়া ওঠার বিষয়। তবে মনে রাখতে হবে, লীলার কথা অবলীলায় বলে ফেলবার একটা সময় ছিল। সেটা ছিল স্বভাব কবিদের যুগ। সেই সময় আমরা পার হয়া আসছি। জীবন লীলা নয়, জীবন সংগ্রামই এখন মুখ্য। ফলে স্বভাবের মধ্যেই কবিতা সার্বভৌম হয়া ওঠে না। কিছুটা নির্মিতিরও দরকার পড়ে। কবিতার যেটুকু আমাদের স্বভাব, সেটুকু হয়া ওঠে। যেটুকু নির্মাণ, সেটুকু আমরা লেখি। এ দুয়ের সমন্বয়েই কবিতা হয়। ‘যা হয়া ওঠে’ তার মেদ ও অদরকারি আবেগ ঝাড়তেই নির্মিতি লাগে।
সরফরাজ: আপনার কবিতা পাঠক পড়বে কেন? মানে, আপনার কবিতা পড়ে পাঠক কী পাবে?
মামুন: না, আমার কবিতা পড়ার বিশেষ কোনো ঠ্যাকা নাই পাঠকের। পাঠক নিজের ইচ্ছামতো যে-কারোর কবিতাই পড়তে পারেন বা পরিহার করতে পারেন। তার এই ‘দায়হীন’ কাব্যপাঠের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। তবে পাঠক যদি সত্যিকারের পাঠক হন, তিনি অবশ্যই চাইবেন নানান কিছিমের কবিতার সঙ্গে নিজের একটা বোঝাপড়া করতে। ঘাগু পাঠক তো বিচিত্র কবিতাপাঠের মাধ্যমে তার নান্দনিক আস্বাদনকে ঊর্বর করতে চাইবেনই। সেক্ষেত্রে তার নিজেরও প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। সেই প্রস্তুতি নিয়া তিনি যদি আগায়া আসেন তবে আমি চাইবো আমার কবিতাও তিনি পড়ুন। বোর্হেসের একটা কথা মনে পড়তেছে। তিনি বলছিলেন, ‘কোনো লেখা পাঠের মাধ্যমে পাঠক ওই লেখায় নিজের ভূমিকা বা অবদান রাখেন।’ আমি যতদূর বুঝছি, তিনি বলতে চাইছেন যে, পাঠকের মাধ্যমে লেখাটার নতুন মূল্যায়ন তৈরি হয়। আবার এও ঠিক, সমালোচকের কাজ হইলো কোনো ভালো লেখাকে বা অভিনব কোনো শিল্পসৃষ্টিকে মানুষের সামনে তুইলা ধরা। প্রকৃত সমঝদারের জন্য বাছাইয়ের কাজটা তখন সহজ হয়। তো বাছাইয়ের কাজটা কেন জরুরি সেইটা নিয়া একটা কথা মনে পড়তেছে।
অনেকদিন আগে আমার সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘মেইনরোড’ নিয়া একবার শামসুর রাহমানের বাসায় গেছিলাম। তিনি কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘এখন তো অনেক কবি। অনেক কবি থাকার সুবিধা হইলো, নানান রকম কবিতার স্বাদ পাওয়া যায়। আবার অসুবিধাও আছে, ভালো কবিতা থেকে আগাছাগুলো আলাদা করা কঠিন হয়।’
তো আমাদের দেশে সেইরকম সমালোচকও নাই, আবার কবিরা সমালোচনা সহ্যও করতে পারেন কম। তাই পাঠকের স্বেচ্ছাচারী পাঠ কবিতার সত্যিকারের মূল্যায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করি না। জাতীয় সাহিত্যের চারিত্র্য নির্মাণে ভ্যালু অ্যাড করাটাই কবির কাজ। কোনো কবির জনপ্রিয়তা দিয়া সেইটা আপনি আবিষ্কার করতে পারবেন না। একাডেমিক প্রয়োজন ছাড়া ‘মেঘনাদবধ’ এখন কেউ সেভাবে পড়ে না। কিন্তু বাংলা কবিতায় ‘মেঘনাদবধ’ নতুন ভ্যালু অ্যাড করছে। শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, সামগ্রিকভাবেই শূন্য দশকের কবিতার ব্যবচ্ছেদ প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
আমার কবিতা পড়ে পাঠক কী পাবে? যে-পাঠক আমার কবিতা পড়বেন, তিনিই পারবেন এই প্রশ্নের জবাব দিতে। আর আমি নিজের কবিতার প্রোপাগাণ্ডা করতে বসি নাই। ফলে কে আমার কবিতা পড়লো বা না-পড়লো, কী পাইলো আর না-পাইলো, এইসব নিয়া আমার মধ্যে কোনো হাহাকার নাই। কবিতার জগৎ তুমুল অনিশ্চয়তার জগৎ। ওইটুকু ঝুঁকি নেওয়ার হেডম আছে বলেই এখনও কবিতা লেখতেছি। আর ধরেন, জনরুচি মান্য করা কবির কাজ না। কবির কাজ হইলো নতুন রুচির নির্মাণ। সেই রুচির সঙ্গে কত পাঠক কখন কতটা জড়িত হইছে বা ভবিষ্যতে হবে, সেই বিবেচনা কবি নিজে করবে কেন? তার সেই সময় কই? কাব্যসাধনা একটা নিষ্কাম কর্ম। ফলে লেইখা যাওয়াটাই আমার কাজ।
তবে আমার কবিতা পড়ে আপনি কী পেয়েছেন, সেটার একটা ফিরিস্তি দিতে পারেন প্রথমত। তারপর আমার দুয়েকজন পাঠকের কাছে প্রশ্নটা করলে বিষয়টার বৈধতা এবং ফলপ্রাপ্তির সম্ভাবনা শতভাগ। হা হা হা।
সরফরাজ: কবিতার শরীর নির্মাণে ছন্দ কি জরুরি? আপনি কি মনে করেন, ছন্দের শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলার কারণেই এখন হরেদরে যে-কেউ কবিতা লিখে কবি হয়ে যাচ্ছে?
মামুন: মাইন্ড কইরেন না, এই প্রশ্নও পুরানা গোছের। বহুবার শুনছি। ওই যে বলে না, পুরানা চাইল ভাতে বাড়ে, সেই রকম জরুরিও লাগে প্রশ্নটা। তাই বলতেছি, শুনেন। ভাষা, ভাব, ছন্দ এসব তো কবিরই ডিল করার বিষয়। কবিতার সঙ্গে কবির যে-মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া, সেইটাই বইলা দেয় তার জন্য বা ওই বিশেষ কবিতার জন্য ছন্দ জরুরি কিনা। তাই ছন্দে লেখা বা না-লেখা, কোনোটাই কবির জন্য অনিবার্য কিছু নয়। সমর সেন একটা কবিতাও ছন্দে লেখেন নাই। আবার সুধীন দত্ত ছন্দ ছাড়া একটা কবিতাও লেখেন নাই। এজন্য তাদের কবিতার গুরুত্ব কমেও নাই, বাড়েও নাই। তবে যতদূর জানি, পৃথিবীর সব বড় কবিই নিজ ভাষার ছন্দ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। কীভাবে প্রয়োগ করবেন সেইটা তার নিজের দক্ষতার ব্যাপার। ধরেন, কেউ যখন কী-বোর্ডে প্রথম টাইপিং শেখে, তখন অনেক জড়তা থাকে। অক্ষর দেইখা দেইখা হাত মসকো করে। দক্ষতা অর্জন হয়া গেলে আঙুল আপনা আপনি চলতে থাকে। অক্ষর দেখতে হয় না। যারা ছন্দে লেখবে তাদের ওইটুকু স্ফূর্ততা লাগবে। ছন্দ মগজে নিয়া কবিতা লেখতে পারবে না। আর প্রথাগত ছন্দ না জানলেও কবির নিজস্ব ছন্দবিধি হয়তো থাকে। নইলে হরেদরে কবিতা লেইখা সবাই কবি হয়া উঠতো। তা তো হয় না। শামসুর রাহমান যেইটারে ‘আগাছা’ বলছেন সেটাই তো বেশি হইতেছে।
একটা কথা আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, কবিতারে কেউ শাস্ত্রজ্ঞান করে না। সহজ নিরীহ কিছু মনে করে। সঙ্গীতকে শাস্ত্রজ্ঞান করে। তাই সঙ্গীতের সাধনাকেও স্বীকার করে। কিন্তু কাব্যসাধনারে স্বীকার করে না বইলাই হরেদরে কবিতা হয়। পানি যখন পানীয় হবে, তখনই সেটা শিল্প। কিন্তু পানীয় হইতে গেলে কিছু প্রক্রিয়া তো লাগবেই। কবিতা লেখতেও ওইরকম ভাব আর ভাষার কিছু ভণিতা তো লাগেই। নইলে কবিতা বইলা আলাদা কিছু হইতো না। এখন অবশ্য সবই সহজ হয়া গেছে। মুহূর্তের মধ্যে এআই জেনারেটেট বহু কবিতা উৎপাদন করা যায়। কবিতা লেখাটা আসলেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়া উঠছে।
সরফরাজ: বর্তমান সময়ে যেসব কবিতা লেখা হচ্ছে সেসব কবিতার ধরণ ও শৈলী নিয়ে কিছু বলুন।
মামুন: বর্তমান সময় বলতে নবীনতম তৃতীয় দশক যেমন সক্রিয় তেমনি সত্তর দশকের অনেক কবিও লিখতেছেন। মাঝখানে দ্বিতীয় দশক, শূন্য দশক ও নব্বই দশকের কবিরা তো আছেনই। তো সামগ্রিক কবিতা নিয়া এইভাবে বলা সম্ভব নয়। অরবিন্দ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় দ্বিতীয় দশকের যে সঙ্কলনটা বের হইছে, ওইখানে আমি বড় একটা ভূমিকা লেইখা দিছি। ও চাইছিল, তাই লিখছি। ওই লেখাটা পইড়া দেখতে পারেন। সবকিছু তো এত সুলভ চাইতে পারেন না। আপনি নিজেও তো কবি, বিদগ্ধ পাঠক ও সম্পাদক। ওই লেখাটা আপনার দৃষ্টিতে আসা উচিত। ওখানে দ্বিতীয় দশকের অনেকের কবিতা নিয়া কিছু-কিছু মন্তব্য করছি। তবে সেইসব তাদের প্রথম দিককার কবিতা নিয়া মন্তব্য। এখন অনেকেই আরও পরিপক্ক হইয়া উঠছে। আপনার সম্পাদনায় নব্বই দশকের কবিতার ওপর সমালোচনার যে বইটা বের হইছে ‘ভাষাচিত্র’ থেকে, সেইখানে অনেকের ওপর লিখছি। নিশ্চয়ই পড়েছেন। আমভাবে কিছু কথা অবশ্য বলতে পারি তবু। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের কবিতা এখন সত্যিকারের বাংলাদেশি কবিতা হয়া উঠতে চাইতেছে। ভাষার মধ্যে প্রমিত-অপ্রমিতের ভেদরেখা আর থাকতে চাইতেছে না। কোলকাতাকেন্দ্রিক কাব্যভাষার বিরুদ্ধে এই বিপ্লবটা চোখে পড়বার মতো। মুসলমানি বা ইসলামি শব্দ ব্যবহারে কবিদের মধ্যে কোনো ছুঁৎমার্গ কাজ করে না। আগে সচেতনভাবে এসব পরিহার করা হইতো। আরেকটা বিষয় আমার দৃষ্টিগোচর হইছে। আশির দশকের নির্মিতির চাইতে সত্তর দশকের স্ফূর্ততার দিকে এ সময়ের কবিতার ঝোঁক বেশি। তাই কবিতায় প্রকরণচেতনা অনেকটাই ভাইঙা পড়তেছে বইলা মনে হয় আমার। বিষয়বস্তুর দিকে কবিদের নজরদারি বাড়তে থাকলে এমনটা হয়। শূন্য দশকের কবিতায় সাম্প্রতিক বিষয়াদি নিয়া ডিল করবার প্রবণতা ছিল। আমি নিজেও রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে দীর্ঘকবিতা লিখছি। ‘লখিন্দরের গান’ কাব্যগ্রন্থের একটা কবিতা ‘ঝড় ও মরাকটালের দিন’। বুশ যখন ইরাক আক্রমণ করে সেই সময়ের লেখা। ওই সময় কবিতাটার প্রশংসা করছে অনেকেই। এছাড়া পুরো একটা দীর্ঘকবিতার বই লিখছি ‘রোহিঙ্গাপুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই’ শিরোনামে। তো, রোহিঙ্গা সমস্যা তো এখনও চলমান। শূন্যের ওই ধারা এখনও অব্যাহত আছে এসময়ের কবিতায়। সমসাময়িক বিষয়াদি অবলীলায় আসতেছে। তবে আশানুরূপ টেকনিক্যাল স্ট্র্যান্থ না থাকার কারণে শামসুর রাহমান কথিত অনেক ‘আগাছা’ও পাইতেছি আমরা। কবিতায় সাম্প্রতিকতা যখন বেশি আসতে থাকে তখন বিষয়বৈচিত্র্যও কমতে থাকে। ফলে নিজের স্বাতন্ত্র্য রাখতে চাইলে আবার সেই নির্মিতির দিকেই নজর দিতে হয়।
একটা বিষয় আমি ইতিবাচক ভাবেই দেখতেছি। অনেকেই ছন্দে লিখতেছেন। অন্ত্যমিল, পয়ার ফিরে আসতেছে কবিতায়। সত্যিকারের কবি তো দক্ষ কৃষকের মতো। আগাছা ছাঁটাই করে প্রকৃত ফসল তুলে নিতে পারেন।
সরফরাজ: কবিদের কয়েকটি সিন্ডিকেট রয়েছে। এসব সিন্ডিকেট কিভাবে কবিতার ক্ষতি করছে?
মামুন: সিন্ডিকেটের নাম তো উল্লেখ করলেন না। প্রশ্ন করতে গেলেও হেডম লাগে। সেইটা দেখাইতে পারলেন না। কাজেই আন্দাজের ওপর জবাব দেওয়া কঠিন। সিন্ডিকেট বলতে আপনি কী বোঝেন, সেইটা স্পষ্ট হইলো না। আমি যতদূর বুঝি, সিন্ডিকেটের আসল উদ্দেশ্য হইলো ব্যক্তির ইমেজ তৈরি করা। কবিতা কে কেমন লিখলো, সেইটা নয়। নিজেদের নাম নিজেরাই কপচাকপচির মাধ্যমে জানান দেওয়া যে, ইনি বা ইনারাই কবি। বাকিরা বরবাদ। ব্যক্তির নাম যখন সরগরম হয়া ওঠে তখন সে কী লিখলো সেইটা ব্যাপার নয়। তার লাইক, কমেন্ট, শেয়ার বাড়তে থাকে। শামসুর রাহমান যে ‘আগাছা’র কথা বলছিলেন সেইটাকেই ফসল হিসেবে সামনে আনা উদ্দেশ্য সম্ভবত। আর ধরেন কবিতার বাজার দখল করার একটা কৌশলও হইতে পারে এই সিন্ডিকেট। কিন্তু এইটা কবিতার ক্ষেত্রে খুব কার্যকর পন্থা বলে মনে হয় না। অবাধ এই সোস্যাল মিডিয়ার যুগে ব্যক্তির একক ইমেজ কতদিন ধইরা রাখা যায়? কিছুকাল জনপ্রিয় হইলেও এভাবে কেউ কবি হয়া ওঠে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, সত্যিকারের সমালোচনা সাহিত্যের অভাব আছে আমাদের দেশে। বুক রিভিউয়ের মতো যা-কিছু দেখি সেসব সাহিত্য সমালোচনার ধারে-কাছেও নাই। তাই ‘আগাছা’ নিধন তো দূরের কথা, ‘আগাছা’ বাছাই করাটাও দুরুহ ব্যাপার। তাই কবিতা এমন সস্তা হইছে যে, সোস্যাল মিডিয়ায় কবিতা পোস্ট কইরা লাইক-কমেন্টের জোরে যে-কেউ সহজেই কবিখ্যাতি পাইতেছে। আপনি খুব সচেতন বা মনোযোগী পাঠক হইলেও সবসময় বাছাই কইরা পড়তে পারবেন না। সেই সময় আপনার বা আমার নাই। এই নানাবিধ কারণে সিন্ডিকের দৌরাত্ম্য হয়তো আপনার চোখে পড়তেছে। তবে আরেকটু গভীর দৃষ্টিপাত করলে দেখবেন, এইসব ডিঙাইয়াও ভালো কবিতা লেখা হইতেছে। কাব্যসাধনা যার কাছে শখ নয়, ধ্যান; তার কিন্তু এইসব সিন্ডিকেট-ফিন্ডিকেট দেখবার সময় নাই। তার শুধু দরকার লেখার ফুসরৎ। না, আর কিচ্ছু না।
সরফরাজ: সিন্ডিকেটের বলয় ভেঙে কবিতাকে কিভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া যায়?
মামুন: কবিতা তো এমনিতেই উন্মুক্ত। সোস্যাল মিডিয়ায় আপনি চাইলেই কবিতা পোস্ট করতে পারেন। এখন প্রিন্ট মিডিয়ায় কবিতা ছাপা হইলেও ছবি তুইলা বা অনলাইন ভার্সনের লিঙ্ক কপি কইরা সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার দেয়া হয়। কাজেই কবিতাকে পাঠকের সামনে আনার যে-স্পেস দরকার সেইটার কোনো অভাব নাই। প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদকের কাছে ধরনা ধরার প্রয়োজনও নাই। আপনি সসম্মানে নিজের লেখাটা নিজেই প্রকাশ করতে পারতেছেন। প্রায় বিশ কোটি জনসংখ্যার যে-দেশে বইমেলায় মাত্র তিনশো কপি বই বিক্রি হইলেই বিশাল কাটতি মনে করা হয়, সেইখানে সিন্ডিকেট বা বলয় ভাঙা না-ভাঙায় কী আসে-যায় বলেন? কোনো কবি চাইলে নিজেও একটা সিন্ডিকেট কইরা নিতে পারে। কবিতার নতুন অভিব্যক্তির প্রয়োজনে আইডিয়ালিস্টিক সিন্ডিকেট হইলে ক্ষতি নাই। নতুন কাব্যান্দোলনের স্বার্থে কবিকুল যুক্ত হয়া কোনো সিন্ডিকেট হইলেও খারাপ কিছু না। কিন্তু তাতেও কারো কবিতা পাঠকমনে ক্লিক করবো কিনা, বলা যায় না। এই ক্লিক করাটা একটা মহাজাগতিক ব্যাপার বইলা মনে হয় আমার কাছে। হ্যাঁ, সত্যি বলতেছি। জীবদ্দশায় জীবনানন্দ দাশের জনপ্রিয় না-হওয়ার ব্যাপারটা ভাবেন। আর তার মৃত্যুর পর তাঁকে উপেক্ষা করবার সাধ্য কার আছে?
ওমর খৈয়ামের জন্ম হইছে ১০৪৮ সালে আর মৃত্যু ১১৩১ সালে। কিন্তু ১৮৫৯ সালে ফিটজেরাল্ড তারে অনুবাদ না করলে ইউরোপসহ সারা পৃথিবীতে তিনি এতটা জনপ্রিয় হইতেন? অর্থাৎ জনমনে ক্লিক করতে প্রায় পাঁচ/ছয়শ বছর লাইগা গেছে তার। অনেক সময় ক্লিক করানোর জন্য এই রকম ফিটজেরাল্ডের দরকার হয়া পড়ে। এইসব একটা কসমিক ইভেন্ট-ই আসলে। তবে জাগতিকভাবে আরেকটা পথ এখন উন্মুক্ত। জ্ঞান, কবিতা, মানুষ সবই তো এখন পণ্য। তো কাব্যগ্রন্থ বা অপরাপর সাহিত্যের প্রকাশনাই সবকিছু নয়। এর বাজারজাতকরণটা মুখ্য ব্যাপার। সেইজন্য একটা জুঁতসই মার্কেটিং পলিসিও দরকার। সেইটা না হইলে যতই উন্মুক্ত হোক না ক্যান, আমাদের সাহিত্য বিশ্বদরবারে পৌঁছবে না। কিন্তু পলিসি মেকিংটা কে করবে? করবে রাষ্ট্র। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই রাষ্ট্রের কবি-সাহিত্যিকদের নিয়া ভাবনার সময় নাই। যদি পলিসিটা হয়ও, দেখবেন সেইটাও কোনো সিন্ডিকেটের আওতায় পইড়া গেছে। এইটা একটা দুষ্টচক্রের মতো। কাজেই এইসব নিয়া ভাবলে কবিতা লেখতে পারবেন না। তার চাইতে নিজের আনন্দের জন্য লেখেন। লিখতে গিয়া আমি এতকিছু ভাবনায় আনি না। ‘ঝিনুক নীরবে সহো..’ এই মন্ত্র মাইনা চলি।
সরফরাজ: গণমাধ্যম কিভাবে সাহিত্যের ক্ষতি করে?
মামুন: গণমাধ্যম আসলে জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করতে চায়। চমকপ্রদ সাহিত্য, যার বাজারে কাটতি ভালো সেই সাহিত্যকে প্রমোট করে। মাসমিডিয়া হিসেবে এতে তার নিজের প্রসারটা ভালো হয়। ফলে যারা সত্যিকারের সাহিত্যসাধক, নিভৃতে কাজ করতেছেন, তারা আরও আড়ালে পড়ে যায়। গণমাধ্যমে চটকদার জিনিস দেখতে-দেখতে মানুষের রুচিরও বিকার ঘটতে থাকে। তাই জাতীয় সাহিত্যের চারিত্র্য নির্মাণে যে-সাহিত্য ভূমিকা রাখতেছে, সেইটা জনসম্মুখে আসতে দেরি হয়া যায়। চারিত্র্য নির্মাণ বলতে আমি বুঝাইতেছি, সাহিত্য-শিল্পে নতুন ভ্যালু অ্যাড করা। জীবনানন্দ দাশরে নিয়া গণমাধ্যমের ভূমিকা কী? কমলকুমার মজুমদার বা শহীদুল জহির নিয়া? আসলে ইনাদেরকে পণ্য কইরা তোলা সহজ নয়। যে-কোনো গণমাধ্যমেরই নির্দিষ্ট বা কাঙ্ক্ষিত গ্রাহকচাহিদা থাকে। সেই চাহিদা মিটানোর দিকেই নজর থাকে গণমাধ্যমের। কাজেই প্রকৃত লেখক-কবি খুঁইজা ফেরা তাদের কাজ হয়া ওঠে না। তবে সত্যিকারের অনুসন্ধানী দৃষ্টি ও সদিচ্ছা নিয়া আগায়া গেলে গণমাধ্যমই তো পারে ডেডিকেটেড কবি লেখদের বৃহত্তর পাঠকের কাছে পরিচয় করায়া দিতে। যদি পণ্যও হয়, তারও তো মান বিচারের দায় থাকা দরকার, নাকি? তবে মিডিয়ার দ্বারস্থ হয়া টাইমকিলিং জাত লেখকের কাজ হইতে পারে না।
লোভ সংবরণ তথা নিষ্কাম সাহিত্যকর্মই একমাত্র ব্রত হইলে মিডিয়া নিয়া এত দুঃশ্চিন্তার কারণ দেখি না। মরুভূমিতে উট নাকি তৃষ্ণার্ত হইলে চোরাবালিরে পানি ভাইবা দৌড়াইতে থাকে। পরে যখন ভুল ভাঙে খেজুরগাছের কাণ্ডে কামড় দেয়। মাড়ি ফাইটা রক্ত বের হয়। সেই রক্ত পান কইরা পিপাসা মিটায়। তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিডিয়া হইতেছে সেই চোরাবালি। আর আপন রক্তপান হইতেছে কবি-লেখকদের তৃষ্ণার নিয়তি। নিয়তির এই গ্যাঁড়াকল মাইনা নেওয়ার সাহস না থাকলে কিসের লেখক, কিসের কবি?
সরফরাজ: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আপনার পরামর্শ কী?
মামুন: প্লেটো তো আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের রাখতে চান নাই। রাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করছেন। তো সেই কবির কাছে আপনি রাষ্ট্র বিনির্মাণের পরামর্শ চাইতেছেন, অবাক হইলাম। তবু বলি, রাষ্ট্রে যারা থাকে তারা হইলো পলিটিক্যাল কমিউনিটি। কিছু মৌলিক বিষয়ে তারা একমত হয়, সেই ভিত্তিতে রাষ্ট্র তারে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয় বা এরকম আরও অনেক কিছু করে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হইলেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতির ব্যাপারে কোনো ঐকমত্য হয় নাই। তার মানে, রাষ্ট্র গঠনের আসল জায়গাটাই এখনো আমাদের ঠিক হইলো না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে তিনটা মৌলিক নীতি ছিল: সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায় বিচার। তো সংবিধানের কোনো জায়গায় সরাসরি এসবের উল্লেখ নাই। যখন যে-দল ক্ষমতায় আসছে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে ইতিহাসের বয়ান তৈরি করছে তারা। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের দলীয়করণ করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কুক্ষিগত কইরা আওয়ামীলীগ যে-নিষ্ঠুর ফ্যাসিজম জারি রাখছিল, জুলুম নির্যাতন চালাইছিল ১৫ বছর, তার থেকে আমরা মুক্ত হইছি ঠিকই, কিন্তু জুলুম নির্যাতনের রাজনীতি নিঃশেষ করবার যে-অঙ্গীকার দৃঢ়ভাবে দৃশ্যমান হওয়ার কথা ছিল, রাজনৈতিকদলগুলোর মধ্যে এখনও তা দেখতেছি না।
পক্ষ-বিপক্ষ, দেশপ্রেমিক-দালাল এইরকম বিভিন্ন বাইনারিতে আইটকা আছে রাজনীতি। অথচ প্রত্যেকেরই ভোটাধিকার আছে, প্রত্যেকেই রাষ্ট্রীয় ট্যাক্সের অধীন। ফলে রাজনীতিতে আদর্শিক বক্তব্য দিয়া আইনগতভাবে কাউরেই বিতাড়িত করতে পারবেন না। কিন্তু আমাদের রাজনীতি মতাদর্শ আর ইতিহাসের দলীয় বয়ান প্রতিষ্ঠার অহেতুক বিতর্কে ঘুরপাক খায়। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে যার কোনো প্রভাব নাই। ৫৪ বছরে এসব শুনতে-শুনতে মানুষ ত্যাক্ত-বিরক্ত বলেই আমি মনে করি। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষানীতি, বেকারত্ব নিরসন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ এরকম বহুবিধ অতি প্রয়োজনীয় বিষয়াদি নিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গঠনমূলক তর্ক-বিতর্ক নাই। তাই দরকার হইলো মূল্যবোধকেন্দ্রিক রাজনীতি। সততা, সহানুভূতি, সহনশীলতা, দুর্নীতিমুক্ত থাকার মানসিক ও দলীয় প্রবণতা, ন্যায় বিচার, অপরের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এসবই আসলে রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় মূল্যবোধ হওয়া দরকার। আদর্শ তো হইলো কল্পিত মানদণ্ড। সেইটা যে-কোনো দলের গন্তব্য হইতে পারে। কিন্তু মূল্যবোধ হইলো সেই গন্তব্যে পৌঁছার পথ। সেই পথে আমাদের রাজনীতি এখনও নাই।
কেবলমাত্র ইতিহাসের অতীত আর আদর্শের ভবিষ্যত দিয়া রাজনীতি হয় না। রাজনীতি এমন এক দুনিয়াদারি যা সমসাময়িকতা বা সাম্প্রতিকতাকে গুরুত্ব দিয়া চালাইতে হয়। আমাদের রাজনীতিবিদরা এই আলোকে নেসেসিটি অব দ্য টাইম যদি বুঝতে পারেন তাহলে হয়তো রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে।
সরফরাজ: পৃথিবীতে মানুষের জীবনের মানে কী?
মামুন: জীবনকে অর্থময় করে তোলাই জীবনের মানে। তো সেইটা আপনে কীভাবে করবেন, কোন দর্শন, ধর্মবোধ বা কোন জীবন ব্যবস্থাকে মাইনা লইয়া, সেইটা আপনে নিজে ডিসাইড করবেন। আপনে যদি ধর্মবিশ্বাসী না হন, তাইলে মানুষ হিসেবে দায়িত্বশীল কাজ ও আচরণের মধ্য দিয়া জীবনকে অর্থময় করবেন। জাঁ পল সার্ত্র বা আলবেয়ার কামু তো প্রায় এমন কথাই বলছেন। তো জীবনের পূর্বনির্ধারিত অর্থই বলেন অথবা নৈতিক মানদণ্ডের কথাই বলেন, এসব তারা মানতেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে ধর্মপ্রবণ। কিছু ক্ষেত্রে প্র্যাকটিসিং মুসলিম বলতে পারেন। আমাদের ধর্মমতে জ্বিন ও মানবজাতিকে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হইছে। তো এইটার আবার আমার নিজের মতো একটা ব্যাখ্যা আছে। আমার ব্যক্তিগত দর্শন হইতেছে, জীবন হইতেছে যাপনের জন্য। আর মৃত্যু উদযাপনের জন্য। শুধু যাপনের মধ্য দিয়া আপনে জীবনের অর্থ খুঁইজা পাবেন না। যাপিত জীবনের মধ্যে উদযাপনের মহিমা ঢালতে হইবো। মানে সকল উদযাপনই আপনের নশ্বরতার উপলব্ধি; অবচেতনায় মৃত্যুর ছায়াকে সামনে রাইখাই জীবনকে নেয়ামত হিসেবে অনুভব করা। সেই অর্থেই বলছি, মৃত্যু হইতেছে উদযাপনের জন্য। নামাজ হইলো জীবনকে আধ্যাত্মিকভাবে উদযাপন করা। এইটা কি করে? আপনার জীবনকে আরও বৃহত্তর উদযাপনের দিকে লয়া যায়। ইনসাফের পক্ষে আপনার সংগ্রাম ও আচরণকে শক্তি দেয়। আর ইনসাফের পক্ষে থাকাই আমাদের জীবনের ইথিক্যাল স্ট্র্যান্থ। এইটারে সত্যিকারের ইবাদতও ভাবতে পারেন। মানবিক মূল্যবোধের যে বিষয়গুলারে আমরা মহৎ ভাবি, সেইগুলা ইথিক্যাল জায়গা থেকেই আসে। রাষ্ট্র দেখতে চায় আপনি নিজেরে লিগ্যালি কতটা জারি রাখতে পারছেন। তাতেই সে খুশি। কিন্তু ইথিক্যালি আপনি স্ট্রং না হইলে জীবনের সত্যিকারের অর্থ হয় না। একটা বাচ্চা নদীর স্রোতে পড়ছে। আপনি তারে বাঁচাইতে নদীতে ঝাঁপ দিলেন। স্রোতের পাঁকে পইড়া আপনেও মরলেন। জাগতিক যুক্তিতে আপনার এই মওতের অর্থ বোকামি। কিন্তু এই মরণ আপনার জীবনের এমন এক মহত্ত্ব দিছে যা যুক্তিতে খাটে না। অনুভবে ধরা পড়ে। তো জীবনের মানেও সবসময় ধরাছোঁয়া যায় না। যার-যার ব্যক্তিগত অনুভবে বুইঝা নিতে হয়।
সরফরাজ: নিজের লেখা কবিতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী রকম?
মামুন: আমার কোনো মূল্যায়ন নাই। পাঠকের মূল্যায়নই মূলত আমার মূল্যায়ন। সেক্ষেত্রে পাঠকদের উদ্দেশ্যে আমার একটি কবিতা এখানে তুলে ধরা যেতে পারে—
পাতার প্রলাপ
পৌর গোরস্থানে মৃত শেয়ালের পাশে
ব্যাপ্ত চরাচর নিয়ে বসে আছি; একা।
উদ্বুদ্ধ সকাল নম্র রোদের সোনালি দেহ
আমার পায়ের কাছে মেলে দিলে
সূর্যকে ভাবতে শিখি আলোর দালাল।
দূরে পুষ্পকঙ্কাল, মলিন ধুলো শরীরে মেখে
ললিত সৌরভ-স্মৃতি ভুলে যেতে থাকে।
হয়তো প্রেমিক তার আনত প্রেমের
ভূলুণ্ঠিত প্রতিদান মাটির সান্নিধ্যে ফেলে গেছে।
কত ভুল, পাপের নিয়তি, তীব্র তর্কের করাত
কবরের মাটির ভদ্রতা বুকে নিয়ে
একদিন নত হয়; বিচ্ছিন্ন বনের কাছে
পাখির সম্পর্ক খোঁজে। বস্তুত সম্পর্ক এক জটিল পুরাণ।
মানুষ গল্পের ক্রীড়নক হয়ে ব্যর্থতার করাল সত্যকে
একদিন নিজের সঙ্কটে বুঝে ফেলে:
দেখে, কেউ তার সঙ্গে নেই।
দেহের পুরনো ছাল ফেলে
যেভাবে পালায় সাপ, সেরকম
অধীর নিস্তার চেয়ে সবাই পালায়।
স্মৃতিবিষ বুকে নিয়ে
আগুনে আগুনে পুড়ি আমরা সবাই একা একা।
মানুষের শ্রমে আজ উৎকীর্ণ সকাল।
মায়াবী গরুর চোখে পৃথিবীর সব মধু বোবা হয়ে আছে।
আমূল সাধনাগুলো চুপচাপ হয়;
কত মর্ম-আলাপন গভীর সঙ্কেতে
নিজের জীবনে জমা রাখে
নিঃসঙ্গ বধির।
একটা বিড়াল হাঁটে; তার ভয় চতুর পুলকসহ
পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে দেখি।
জীবনের লাস্য ঘিরে বহুদিন
মাতাল বাসনা ছিল আমারও; ভেবেছি
লোমশ আদর পেলে
একটা বিড়াল হব নারীর মুঠোয়।
চুপি চুপি টিকে র`বে জান্তব যৌনতা
দুর্বিনীত আমাদের সকল খেলায়।
আজ আমি সঙ্গপ্রিয়; জনতার নিষ্ফল মস্তকে
চমকের মতো মিশে আছি।
পলে পলে সাজানো সকল সংক্রমণে
গ্রীষ্মের মুগ্ধতা দেখি; আর দেখি গোপন শূন্যতাগুলো
ঘুমন্ত খরগোশের পরাজয়ে জেগেছে হঠাৎ।
কারো কারো জীবন তো বিজয়ী কচ্ছপ।
বিষণ্ন মর্মরে ঝিরিঝিরি হাওয়া-গান
আমার শরীর ছুঁয়ে গেলে
কেন যে পাতার কথা মনে পড়ে আজ!
পাতা এক নিবিড় সবুজ হাহাকার।
বিভোর বাতাসে নড়ে; তবু
চকিতে পাখির মতো উড়তে পারে না।
ডালে ডালে তার শোক, হলুদ বেদনাগুলো
গাছের স্পন্দনে টিকে থাকে;
মড়কে মড়কে শেষ হয়। আহা পাতা!
নিঝুম মৃত্যুর দিকে আমাকেও সঙ্গে নিও।
সবুজ প্রলেপ নিয়ে ঝরে যেতে
আমি এক পাতা হতে চাই।
নীরবতা কবরের স্পর্ধা।
উদগ্র পোকার চলাফেরা, নীল মাছি
হরিৎ গুল্মের নিচে
সামান্য মলিন ছায়া—সবকিছু মহাকাল;
তুমুল স্খলন যেন; আরেক ভঙ্গুর কোলাহলে
পরম শান্তির দিকে নষ্ট হতে চায়।
ভাষা হয়ে ফোটে।
প্রজাপতি রঙিন ডানায় লিখে নিজের পতন।
তবু পাতা, তোমার তরঙ্গ আছে স্পর্ধিত মৃত্যুর।
নির্ঝর বেদনা আছে; বিরল মমতা এক বোঁটায় বোঁটায়।
আমি হাতে নিই; আহা! রিনি রিনি তোমার শরীর
স্পন্দিত বুকের মধ্যে তিলে তিলে গড়ে তোলে আমার সাহস।
স্ত্রী-পুত্র, বিবিধ সঙ্গ, আরো দূর ফলনবেষ্টিত স্বজনের
মুখর সত্যকে মানি; তবু
সুকণ্ঠী বন্ধুর গান, প্রেমিকা পসার
আকুল স্তনের দিকে ধাবমান সকল সুখের মেদ, আর
নম্র চুম্বনের আশা দুলতে দুলতে
ঠোঁটের ওপর
যদি কোনোদিন ক্লান্তি বয়ে আনে
আমি খুব একা হতে পারি।
কখনো চন্দনকাঠ অগ্নিদগ্ধ হলে
মানুষ পোড়ার আগে বিগলিত হই।
কাঁদি একা একা।