
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়: প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষাধারা
পর্ব ১
রাহামান চৌধুরীপ্রকাশিত : আগস্ট ২০, ২০২৫
ভাররতবর্ষ জুড়ে বিশেষ করে উত্তর ভারতে ১৮৫৭ সালে যখন সিপাহী বিদ্রোহসহ গণ অভ্যুত্থানের রণধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে ইংরেজ শাসিত তিন প্রেসিডেন্সিতে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ভাবনা এলো ইংরেজ শাসকদের মনে। প্রথমে তৈরি হলো কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পরে খুব কাছাকাছি সময়ে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়। আসলে গড়ে তোলা হলো ঔপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থে কিছু কূপমণ্ডুক ধরনের করণিক বানাবার প্রতিষ্ঠান। সবার আগে যে কথা বলবার তাহলো, শুরুতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আদৌ পড়ানোর কথা ভাবেনি, বর্তমান কালের ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড’ যে ভূমিকা পালন করে থাকে কলিকাতা বিশ্বিবিদ্যালয় তাই করেছে প্রথম পঞ্চাশ বছর। পরীক্ষা নিয়েছে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বছর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দেই পরীক্ষা গ্রহণ আরম্ভ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছিল তখন প্রশ্নপত্র তৈরি করা, পরীক্ষা গ্রহণ, খাতা দেখা এবং পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা। ভারতের বড়লাট বসে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথার ওপরে। ছয়জন ছিলেন সিন্ডিকেট সদস্য। সবাই তারা সাহেব ছিলেন, একজনও ভারতীয় ছিলেন না। সিন্ডিকেটের সভাপতি ছিলেন উপাচার্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সরকারি বরাদ্দ ছিল খুব কম। পাঠক্রম তৈরির দায়িত্বও ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। কলকাতার কেন্দ্রে ক্যামাক স্ট্রীটের এক ভাড়া বাড়িতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের সূচনা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যালয় বলতে ছিল সর্বসাকুল্যে একজন নিবন্ধক বা রেজিস্ট্রার আর একজন করণিক। সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হতো উপাচার্যের বাড়িতে আর সিনেট সভা হতো টাউন হলে।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে বাংলায় মোট কলেজ ছিল চৌদ্দটি। অবশ্য আধুনিক অর্থে কলেজ বলতে যা বোঝায় সেগুলো তেমন ছিল না। সেই ১৪টি কলেজের ৬টি প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজ সরকার আর বাকি ৮টি বেসরকারি ইউরোপীয় সংস্থার উদ্যোগে স্থাপিত হয়। ১৪টি কলেজের মধ্যে ৯টি কলকাতায় অবস্থিত ছিল। কলেজ বা মহাবিদ্যালয়গুলি প্রকৃত মহাবিদ্যালয় ছিল না-জন্য যতটুকু শিক্ষাদানের প্রয়োজন-সেইটুকু শিক্ষাদান করেই সনদপত্র ধরিয়ে দেওয়া হতো।
বিশ্ববিদ্যালয় মানেই নতুন এক আমলাতন্ত্রের অধীনে সম্পূর্ণ মাধ্যমিক-উচ্চ শিক্ষা কাঠামোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা, দেশীয় উচ্চবর্গের ভিতর থেকে ইংরেজ শাসন পরিচালনার জন্য কিছু সেবাদাস গড়ে তোলা। যখন ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে উডের ডেসপ্যাচ প্রস্তাবনা হিসেবে এসেছিল তখন সেখানে ‘বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক’ পদ তৈরির পরামর্শ ছিল। সে পরামর্শ ছিল সকল অনুষদের জন্যই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি নিজস্ব অধ্যাপক থাকে তাহলে নিজস্ব ভবন থাকাটাও দরকার। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন সিন্ডিকেট সভায় ঠিক হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা ভবন তৈরি করা হবে এবং তা হবে কলকাতাতেই। সেই ভবনে কী কী থাকবে? সিনেটের বার্ষিক সভা হওয়ার জন্য একটি প্রশস্ত সিনেট হাউস বা ইউনিভার্সিটি হল। একটা উপযুক্ত পরিসরের বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থগার। একটি পাঠকক্ষ ও পরামর্শ কক্ষ।
সিনেট, সিন্ডিকেট বা ফ্যাকাল্টির সভা হওয়ার জন্য একটি সাধারণ কক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, উপাচার্য, সিনেট সদস্যদের বিশ্রাম নেয়ার জন্য একটি বিশ্রাম কক্ষ। নিবন্ধকের দপ্তর। একটি রেকর্ড রুম এবং করণিকের অফিস। দুটো বড় পরীক্ষা গ্রহণ কেন্দ্র। সেই পরিকল্পনায় উপাচার্যের কার্যালয়ের কোনো প্রস্তাব ছিল না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মাত্র একটি পাঠকক্ষের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষকদের কক্ষ বা শিক্ষাদানের জন্য ক্লাসরুমের কথা বলা হয়নি। যা প্রমাণ করে শিক্ষাদান গুরুত্ব পায়নি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। গুরুত্ব পেয়েছিল পরীক্ষা গ্রহণ করে সনদপত্র প্রদান। সনদপত্র প্রদানের ভিতর দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আয়ের উৎস তৈরি হয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন তৈরি হতে আরো দশ বছর সময় লেগেছিল।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৬৩ সাল থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দিতে আরম্ভ করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ইংরেজি উচ্চশিক্ষার চাহিদা আরও বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় বেসরকারি উদ্যোগে কলেজ গড়ে উঠতে থাকে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি অনুদান ছিল খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু ছিল প্রধানত শিক্ষার্থীদের দেয়া অর্থে। সকল পরীক্ষার্থীকে আবেদনপত্রের সঙ্গে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা দিতে হতো। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ভারতীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে নানারকম অনুদান লাভ করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম যে বড় অনুদান পেয়েছে তার দাতা বাংলার কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তি নন। তিনি ভারতীয় হলেও ছিলেন একজন মারাঠি। মহারাষ্ট্র ছিল তার কর্মস্থল এবং তার নাম প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দুই লাখ টাকা দান করেন।
তার অনুদানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি’ চালু হয়েছিল। গিলক্রাইস্ট এডুকেশনাল ট্রাস্ট কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দুটো বৃত্তি দিয়েছিল। ড. গিলক্রাইস্ট ছিলেন ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসে কর্মরত চিকিৎসক। তিনি শিক্ষার উন্নতিতে বেশ খানিকটা অর্থ রেখে যান। প্রফুল্লচন্দ্র রায় এই বৃত্তি পেয়েছিলেন। সরোজিনী নাইডুর পিতা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ও এই বৃত্তি লাভ করেন। বৃত্তির কথা বলতে গেলে ভিজিয়ানাগ্রামের মহারাজার দেয় আর্থিক অনুদানের কথাও বলতে হয়। বৃত্তির পরিমাণ ছিল মাসে পঞ্চাশ টাকা। তখনকার দিনে এটা ছিল যথেষ্ট টাকা। শুধুমাত্র দেশীয় ছাত্রদের জন্য এই বৃত্তি দেয়া হয়েছিল।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো শিক্ষক বা অধ্যাপক ছিল না। কিন্তু ১৮৬৮ সালের একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে একজন অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রসন্নকুমার ঠাকুর ছিলেন রক্ষণশীল হিন্দু। খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব থেকে হিন্দু সমাজকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন আজীবন। হিন্দু কলেজের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৮৬৮ সালের তিরিশে আগস্ট প্রয়াত হন। বিশাল সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। তার পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর ছিলেন প্রথম ভারতীয় ব্যারিস্টার। কিন্তু জ্ঞানেন্দ্রমোহন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে বাবা প্রসন্নকুমার ঠাকুর তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন।
মারা যাবার সময়ে প্রসন্নকুমার ঠাকুর নিজের সম্পত্তির ব্যাপারে একটি ইচ্ছাপত্র রেখে যান। ডিসেম্বর মাসের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় সেই ইচ্ছাপত্র পাঠ করা হয় এবং পরের সিন্ডিকেট সভায় সেই ইচ্ছাপত্রের ওপর আলোচনা করার কথা বলা হয়। প্রসন্নকুমার ঠাকুরের সেই ইচ্ছাপত্রে বলা হয়েছিল, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ‘আইনের অধ্যাপক’ পদ সৃষ্টি করা হোক। সেই অধ্যাপকের পরিচয় হবে ’টেগোর আইন অধ্যাপক’। কলকাতা শহরের কোথাও সেই অধ্যাপক বার্ষিক কয়েকটি বক্তৃতা দেবেন। ছাত্র ও অন্যান্য আগ্রহীরা সেই বক্তৃতার শ্রোতা থাকবেন। প্রসন্নকুমার ঠাকুর এই অধ্যাপক পদের জন্য যে টাকা দান করেছিলেন তা থেকে মাসে কমপক্ষে এক হাজার টাকা সুদ পাওয়া যেত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়া বেসরকারি অনুদানের মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় অনুদান। দানের পরিমাণ ছিল তিন লক্ষ টাকা। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এইভাবে একটি অধ্যাপকের পদ তৈরি করা হয়েছিল।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবার পঞ্চাশ বছর পরেও তা ছিল পরীক্ষা গ্রহণ কেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বহু পরীক্ষার্থী ছিল কিন্তু শিক্ষার্থী ছিল না। বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরাই ছিল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থী। সেই পরীক্ষার ভয়াবহরূপ নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা মানেই প্রধানত পরীক্ষাভীতি। মূল লক্ষ্য জ্ঞান অর্জন নয়, মুখস্থ বিদ্যার জোরে পরীক্ষা দিয়ে একটি সনদপত্র লাভ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষা ব্যবস্থা সাজানো হয় প্রলোভন দিয়ে-চাকরির ও প্রতিষ্ঠার। মনে করা হতো, ব্রিটিশ শাসকদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা দরকার ভারতবাসী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করার সুযোগ লাভের জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সিটনকার ১৮৬৮ সালের সমাবর্তনে ঠিক সেই কথাটাই বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের ব্রিটিশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। ব্রিটিশদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেছিলেন, শিক্ষার্থীরা যেন ব্রিটিশ শাসকদের প্রতিদান দিতে ভুলে না যায়। পরের বছরের সমাবর্তনেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন, দেশ শাসনের কাজে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির দায়িত্ব হলো সরকারের সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে দেশীয় উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন, প্রার্থনা করি তোমরা যেন ভারতের প্রতি ইংল্যান্ডের শুভেচ্ছার কথাটা স্মরণ রেখে তাদের দাবির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারো এবং ভারত সম্পর্কে তাদের যাবতীয় অবিশ্বাস আর ভ্রান্তধারণা দূর করে পারস্পরিক সম্পর্কে আস্থা তৈরি করতে পারো।
খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করা দরকার, উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় শিক্ষার্থীদের নিকট বলছেন ভারতের প্রতি ইংল্যান্ডের শুভেচ্ছার কথা। অথচ ইংল্যান্ড ভারতের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে নিজ দেশে, ইংরেজদের শাসনে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বাংলায় এবং ভারতের আরও কয়েকটি অঞ্চলে। ১৮৭৩ সালে নতুন ভবন তৈরির মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। সিন্ডিকেট সভায় ঠিক হয়েছিল ৮ মার্চ নতুন ভবনে সমাবর্তন হবে। এরই মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম, পাঠক্রম, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা নানা বিষয়ে বিতর্ক আর দ্বিমত দেখা দিয়েছিল। শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে যে একেবারেই প্রশ্ন ওঠেনি তা নয়। ভারতীয়রা সেসব নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন না তুললেও, দু-চারজন ইংরেজ ঠিকই প্রশ্ন উঠিয়েছিলেন। পাদ্রী লঙ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। পাদ্রী জেমস লঙ লক্ষ্য করেছিলেন লেখাপড়ায় মুখস্থবিদ্যার প্রাধান্য। তিনি দেখলেন, অন্ধভাবে বিদেশি শিক্ষানীতি অনুসরণ করার ফলে চিন্তার স্বাধীনতা উধাও হয়ে যাচ্ছে। মানুষ সব মুখস্থ করার যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। হু হু করে মুখস্থ বিদ্যার খপ্পরে পড়ে এমন সব মাথার সংখ্যা বাড়ছে যে, ‘শিক্ষিত দুরাচারীতে ভরে যাবে বাংলা’।
সঙ্কটটা ছিল পাশ্চাত্যের শিক্ষাদান করতে চাওয়ার কারণে নয়। বরং পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞান সঠিকভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছিলো না বলেই। সতেরো-আঠারো এবং উনিশ শতকে পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা যেভাবে চার্চের প্রতিক্রিয়াশীল কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করা আরম্ভ করেছিল, পদার্থবিদ্যা বা প্রকৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেসব অবদান রাখতে শুরু করেছিল, ভারতের শিক্ষাধারায় তার স্থান ছিল না। ফরারি বিপ্লব রাষ্ট্র ও মানুষ সম্পর্কে যেসব ধারণা প্রচার করেছিল, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ঠিক তার উল্টো পথে হাঁটছিল। কলিকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য ও ইতিহাস পঠন-পাঠন ছিল প্রাচীন হিন্দুযুগের পৌরাণিক গালগপ্পে ভরা। ইংরেজ সরকার ভারতবাসীকে অজ্ঞানের অন্ধকারে রাখতে চেয়েছিল। শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়। এই শিক্ষা শুধুমাত্র ভদ্রলোকরা নিজেদের সন্তানদের জন্যই চাইছিলেন এবং একই সাথে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেছিলেন যার ফল খুব খারাপ হয়েছিল।
নতুন বিজ্ঞানমনস্ক ধ্যানধারণা বিকাশে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো অবদান রাখেনি। বরং সাম্প্রদায়িক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মতন প্রত্যাশিত নবযুগ আনতে পারেনি। বিনয় ঘোষ লিখেছেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধীরে ধীরে গুণের চেয়ে তাদের দোষগুলিই মারাত্মক হয়ে ওঠে। সিন্ডিকেট সিনেট থেকে আরম্ভ করে প্রত্যেকটি বিভাগ গোষ্ঠীগত-ব্যক্তিগত প্রভুত্ব বিস্তারের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। সত্যিকারের শিক্ষার প্রসার আর সেভাবে ঘটেনি। পরীক্ষা গ্রহণের মধ্যেই বছরের পর বছর তার কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। দূর দূর জায়গায় পরীক্ষার্থীরা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরীক্ষা দিচ্ছিলো। পরীক্ষার সময়ে বা তার আগে কী ঘটতো?
শ্যামল চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের ক্লাসনোটের জন্য যেমন শিক্ষার্থীদের চঞ্চল হতে দেখা যায়, সে নোটের কপি করার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে, সেই লক্ষণ বহু আগেই দেখা গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রেই দেখা যায়, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের ডি পি আই বিশ্ববিদ্যালয়কে লিখেছিলেন, বারানসী কলেজের প্রিন্সিপাল গ্রিফিথ তাকে প্রথম নোট সম্পর্কে অবহিত করেন। বারানসী কলেজের পরীক্ষায় কিছু ছাত্র একদিন ক্লাসে বসে প্রেসিডেন্সি কলেজের ক্রফট সাহেবের নোট কপি করছিলেন। ছাত্রদের একজন প্রিন্সিপাল গ্রিফিথকে জানিয়েছিলেন, কলকাতার এক বন্ধুর কাছ থেকে সে এই নোট সংগ্রহ করেছিল। সেইসব দিনেও নোটের কারবারি ছিল। ছাত্রদের কাছে শিক্ষা বলতে প্রধানত ছিল, নোট মুখস্থ করা এবং পরীক্ষায় দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া। পরীক্ষায় নকল করা তখন থেকেই আরম্ভ হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে পাঠ্যক্রম নিয়েও নানান প্রশ্ন উঠেছিল।
শিক্ষাবিদরা বলেছেন,পাঠ্যক্রম ছিল এত বড় এবং বিস্তৃত যে এক বছরের পাঠক্রম তিন-চার বছরেও শেষ করা সম্ভব কিনা সন্দেহ। পাঠক্রম নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছিলেন আলফ্রেড ক্রফট। তিনি ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজে দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক পদে যোগ দেন। পরে ডি পি আই হয়েছেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন। বঙ্গীয় পরিষদের সভ্য ছিলেন। তিনি পাঠক্রম নিয়ে সিন্ডিকেট সভায় যে দীর্ঘ চিঠি দিয়েছিলেন তা সকলের নজর কেড়েছিল। সেই সময়ে তার বয়স ছিল সাতাশ বছর। বিজ্ঞান পাঠ নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠেছিল। ভারতে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রশ্নে অ্যাটকিনস বলেছিলেন, ভারতে যে-কোনো ভাষায় প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে চাইলে বেশ কয়েক প্রজন্ম অতিক্রম করতে হবে। জনপ্রিয় বিজ্ঞানের আদলে এদেশে কিছু হ্যান্ডবুক আছে বটে তবে তা প্রকৃত বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসাকে জাগ্রত করে না। ইউরোপের বিজ্ঞানের বই অনুবাদ হলেও তার ফসল এদেশের মাটিতে ফলতে সময় লাগবে। ক্লার্ক এই একই বিষয়ে তাঁর দ্বিধার কথা জানিয়েছিলেন। তার অভিমত ছিল, সবসেরা স্কুলেও বিজ্ঞানের পাঠদান খুব নিচু মানের। বিজ্ঞান চর্চা ছিল নামমাত্র। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা জীববিদ্যা সম্পর্কে কিছু তথ্য না বুঝেই মুখস্থ করা-তাকে আর যাই হোক, বিজ্ঞানচর্চা বলা যাবে না।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন হেনরি মেইন। তিনি কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার দোষত্রুটিগুলো মানতে চাননি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৬৬-র সমাবর্তন অনুুষ্ঠানের ভাষণে মেইন যা বলেছিলেন, ‘যে অভিযোগটি এখানে সব চাইতে পরিচিত তা হল, অধীনস্থ কলেজগুলোতে যা কিছু শেখানো হয় এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যা অনুমোদন করে থাকে, তা একেবারে অকেজো, অগভীর এবং ভাসা ভাসা। অনেক সময় বলা হয়, গলদ নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে। এবং এমন অভিযোগ করা তো রেওয়াজই হয়ে গেছে যে, এটাই নাকি মুখস্থ বিদ্যাকে উৎসাহিত করছে’। তিনি আসলে অভিযোগকারীদের ব্যঙ্গ করেই এসব কথা বলেছিলেন। তিনি স্পষ্টই বলেন, ‘মুখস্থবিদ্যা’ ব্যাপারটাকে তিনি মোটেই দোষণীয় বলে মনে করেন না। তিনি মনে করেন, ‘এ হলো দ্রুত জ্ঞান অর্জনের এক নিরীহ পদ্ধতি মাত্র।’ তিনি আরো বলেন, ‘যেহেতু এখন প্রতিটি সরকারি চাকরির প্রবেশপথই পরীক্ষাব্যবস্থা দিয়ে আটকানো, তাই এর প্রবল চাপের মধ্যে পড়ে জ্ঞান দ্রুত অর্জন ও আত্মস্থ করার একটা তাগিদ ছাত্রদের ভিতর জেগে উঠেছে’।
তিনি জানান, তা ছাড়া এই ‘মুখস্থ বিদ্যা’ নামক জিনিসটি সত্যি সত্যি ‘নির্ভেজাল খারাপ’ কিনা, তা নিয়ে খোদ ইংল্যান্ডে এখন পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত মীমাংসা হয়নি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বা উপাচার্যদের মধ্যে আর কেউ এমন জোরালোভাবে মুখস্থবিদ্যার পক্ষে কথা বলেননি। দ্বাদশ-চতুর্দশ শতক পর্যন্ত বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠার পর্বে মুখস্থবিদ্যার প্রভাব ছিল। পনেরো শতক থেকে সেই অবস্থাটা পাল্টে যেত থাকে। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে সেই বদঅভ্যাস পরেও থেকে যেতেই পারে-কিন্তু সেটা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার উদাহরণ হতে পারে না। কারণ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন পদার্থ, চিকিৎসা ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনা আর সৃষ্টিশীলতায় ছিল ভরপুর। বিজ্ঞান গবেষণার জন্য তখন প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। অথচ ভারতে বিজ্ঞানচর্চার জন্য গবেষণাগার ছিল না বললেই চলে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান গবেষণাগার গড়ে ওঠে অনেক পরে জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রচেষ্টায়। ঠাণ্ডা মাথায় উপাচার্য হেনরি মেইন যখন মুখস্থবিদ্যার পক্ষে কথা বলছেন, তখন তাদের শিক্ষাদানের লক্ষ্যটা স্পষ্ট-বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টিশীল মানুষ তারা চাইছেন না। কারণ তা তাদের ভারত শাসনের জন্য ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারতো। চলবে