কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

পর্ব ২৯

প্রকাশিত : আগস্ট ০৬, ২০২৫

যারা উড়ুপ ও বিহঙ্গপ্রবণ পড়েছেন তারা আমার খালাতো ভাই কনককে চেনেন। কনক নাছোড়বান্দা, ওকে চিত্রনায়ক আলমগীরের বাড়িতে নিয়ে যেতেই হবে। কারণ সে আলমগীরের ভীষণ ভক্ত, প্রিয় অভিনেতাকে তার কাছে থেকে দেখতে হবে। আলমগীর ভালো অভিনেতা শুধু এটিই ভক্ত হবার একমাত্র কারণ নয়, আলমগীরের গ্রামের বাড়ি নবীনগর থানার গোপালপুর গ্রামে, ওদের বাড়ি পাশের গ্রাম শ্রীরামপুরে।

আমার মতো কনক জন্ম থেকে ঢাকায় বেড়ে ওঠেনি। ওর জন্ম ও শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে শ্রীরামপুর গ্রামে। কাজেই একই গ্রামের বা পাশের গ্রামের কারো প্রতি আমি আলাদা কোনো টান অনুভব না করলেও কনক এই টানটা সাংঘাতিক অনুভব করে।

আমি বলি, আমি তো আলমগীরের ভক্ত নই। তার অভিনয় ভালো লাগে কিন্তু সেই অর্থে আমি তার ভক্ত নই। যদি বাংলাদেশের কোনো নায়কের ভক্ত হই তো আমি রাজ্জাকের ভক্ত। তা ছাড়া ওই বাসায় আমি যাই অনু আপার কাছে, তোমাকে আমি কী করে আলমগীরের কাছে নিয়ে যাব?

কনক বলে, আপনি আমাকে অনু আপার কাছেই নিয়ে যান, বাকি ব্যবস্থা আমি করবো।

আমি তাতেও দ্বিধায় পড়ি। তুমি তো কবিতা লেখ না। অনু আপার সঙ্গে তো আমাদের কবিতার সম্পর্ক। তুমি যাবে কোন সূত্রে? একদিন না হয় আমি আমার ভাই হিসেবে নিয়ে গেলাম, তারপর?

আমিও কবি হিসেবেই যাব।
আমি খুব খুশি হই। ভাবি, কনক হয়তো কবিতা লেখা শুরু করেছে। আমার সংস্পর্শে এসে অনেকেই কবিতা লেখা শুরু করেছে। নুরুল ইসলামের লজিং মাস্টার মিজানও ইদানীং কবিতা লিখছেন।

তুমি কবিতা লিখেছো?
না, লেখি নাই। আপনার কয়েকটা কবিতা, যেগুলি ছাপা হয় নাই, আমারে দেন। সেগুলি আমার নামে চালিয়ে দিব।

আমি বলি, ধ্যাৎ, এটা হয় নাকি? কবিতা নিয়ে প্রতারণা করা যাবে না।

খালি কয়েকদিনের লাইগ্যা ধার দিবেন, অনু আপার লগে খাতির কৈরা ফালাইলে আর লাগবে না।

আমি ওর কথায় কিছুটা কনভিন্স হই। বলি, ঠিক আছে, আজ থেকে তোমার নাম আর কাজী শামীম আহমেদ নয়, এখন থেকে তুমি কবি কাজী কনক। এটা তোমার নতুন নাম। তবে আমার কবিতা তোমাকে দিব না। এখন থেকে কাজী কনক নিয়মিত কবিতা লিখবে। তুমি আমার কিছু কবিতা পড়ো এবং এইরকম কিছু লেখার চেষ্টা করো। আমি সম্পাদনা করে সেগুলোকে কবিতা বানিয়ে দেব। ৩/৪টা কবিতা হয়ে গেলে তোমাকে বনানীতে নিয়ে যাবো।

কনক পাগলের মতো লিখতে থাকে। কিছুই হয় না কিন্তু কিছু একটা তো বলতে চায়। সেগুলোকে আমুল বদলে দিয়ে, নতুন ভাষা ও শব্দ দিয়ে, আমি লিখে দেই। শুধু লিখেই দেই না, দৈনিক নব-অভিযান পত্রিকায় সেগুলো ছাপানোরও ব্যবস্থা করে দেই। এরপর এক বিকেলে ওকে অনু আপার কাছে নিয়ে যাই। পরিচয় করিয়ে দেই কবি কাজী কনক হিসেবে। এরই মধ্যে অনুপ্রাস হয়ে গেছে, ওকে অনুপ্রাসের সদস্যও করে নেই।

কনকের নম্র ও বিনয়ী ব্যক্তিত্ব অনু আপা পছন্দ করেন। এবং দেখা গেল, আমার চেয়ে এখন ওই বাসায় কনকের যাতায়াত অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, এরই মধ্যে কনক গোপালপুরের মেম্বার জসীম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে নিয়ে আলমগীরের সঙ্গে দেখা করে ফেলেছে। কনক আরেকটা কাজ খুব ভালো পারত, দেখা গেল বনানী বাজার থেকে কিছু লাউশাক আর শিং মাছ কিনে কোনো একজনের বাসায় গিয়ে বলছে, গতকাল গ্রাম থেকে এসেছি, আমাদের পুকুরের শিং মাছ আর গাছের লাউশাক আপনার জন্য নিয়ে এসেছি।

এই জাতীয় উপহার পেলে ঢাকার ধনী লোকেরা, যারা গ্রাম থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন, তারা খুব খুশি হতেন। কাকে কীভাবে খুশি করা যায় এটা কনক খুব ভালো জানত। নানানভাবে ও আমাকেও খুশি করত। কনকের সঙ্গটা আফিমের মতো। যে কয়দিন আমি ঠাটারি বাজারে ছিলাম, মনিরের সঙ্গে বেশি মিশতাম, সেই সময়ে কনকের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। এখন সেই দূরত্বটা আর নেই।

কনক এখন প্রায় রোজ সকালেই আমার কাছে চলে আসে এবং আমরা দুজন ঢাকা শহর চষে বেড়াই। কনক খুঁজে খুঁজে দূর সম্পর্কের আত্মীয়, গ্রামের লোক, অল্প চেনা মানুষ এমন যারা ঢাকা শহরে আছে তাদের ঠিকানা জোগাড় করে এবং একেক দিন আমাকে একেক বাড়িতে নিয়ে যায়। তারাও বহুদিন পর অমুক আপার পুত আইছে, এই আবেগে আমাদের জড়িয়ে ধরেন, আদর করেন, ভালো ভালো খাবার খেতে দেন। বাড়িতে এসে এইসব গল্প যখন বলি, আম্মা খুশি হন, খালাম্মা খুশি হন।

আমাদের মাধ্যমে তাদেরও বহুদিন দেখা না হওয়া কৈশোরের বন্ধু-বান্ধব, গ্রামের সম্পর্কে অমুক তমুক বোন বা ভাইয়ের সঙ্গে একটা যোগাযোগ তৈরি হয়। আমার উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। এখন ভর্তি হবার পালা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দেই, ইচ্ছে একাউন্টিংয়ে ভর্তি হবো। প্রথম ১২০ জন একাউন্টিং পাবে এটা নিশ্চিত৷ কিন্তু আমার সিরিয়াল আরো পরে। আমি কিছুটা ভেঙে পড়ি।

আমাদের পাড়ায় অল্প সময়ের জন্য ইসলাম মাস্টারের বাড়িতে একজন লজিং মাস্টার ছিলেন, দেলোয়ার, আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র। তিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাউন্টিং পড়ছেন এবং লজিং ছেড়ে দিয়ে জসীম উদদীন হলে উঠেছেন। আমি প্রায়ই তার কাছে যাই। জসীম উদদীন হলে খাই দাই, তার বিছানায় ঘুমাই।

দেলোয়ার ভাই আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। যোগাযোগ না হলেও আমি বহুদিন পর্যন্ত তার ট্র্যাক রেখেছিলাম, তিনি ছাত্রদল করতে শুরু করেন এবং ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদকও হয়েছিলেন। এরপর আর তার খবর জানি না। ফেইসবুকের কল্যাণে কত লোককে খুঁজে পেয়েছি কিন্তু আমার অতি প্রিয় এই মানুষটিকে আর কখনোই খুঁজে পেলাম না।

দেলোয়ার ভাই বলেন, চিন্তার কোনো কারণ নাই, তুমি যে সাবজেক্ট পাও ভর্তি হয়ে যাও, পরে তোমাকে ট্রান্সফার করে আনার দায়িত্ব আমার।

ঠিক মনে নেই কী কারণে, হয়ত ভর্তির টাকা জোগাড় করতে দেরি হবার কারণেই হতে পারে, অথবা আমার আলসেমির কারণে, ভর্তি হবার শেষদিন আমি প্রস্তুতি নিই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার। ফাইল-পত্র, টাকা পয়সা সব তৈরি করে আমি বাসা থেকে বের হব ঠিক তখন কনক এসে হাজির। আমি ওকে বলি,

কনক, আজ আমি তোমার সঙ্গে কোথাও যেতে পারব না, আজ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার শেষ দিন, আমি ভর্তি হতে যাচ্ছি।

ও বলে, চলেন, আমিও আপনার সঙ্গে যাই।
আমি জানি, ও আমার সঙ্গে যাওয়া মানে কোনো না কোনো একটা ঝামেলা হবেই। আমি লক্ষ্যে অটুট থাকতে পারবো না। এবং হলোও তাই। নিউ মার্কেটে গিয়ে কতক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সময় নষ্ট করি। এরপর একটা রিক্সা নিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য, কাছাকাছি এসে ও রিক্সাঅলাকে বলে, ভাই, বাংলা একাডেমিতে যান।

আমি বলি, কনক, আমার হাতে সময় নেই আজ ভর্তি হতে না পারলে আমি একটা বছর পিছিয়ে যাব।

ও বলে, এই যাব আর আসবো, সুকুমার বড়ুয়ার সঙ্গে একটু দেখা করেই চলে আসবো।

আমি রিক্সা থেকে নেমে যেতে চাইলাম কয়েকবার, ও আমার হাত চেপে ধরে রাখলো। অপরাজেয় বাংলা, টিএসসি পার হয়ে রিক্সাটা যখন বাংলা একাডেমির দিকে ছুটছে আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। অন্যদিকে সুকুমার বড়ুয়ার সঙ্গে দেখা করারও প্রচণ্ড আগ্রহ অনুভব করছিলাম। একই সঙ্গে এও ভাবছিলাম, অনেক বড় কবিই একাডেমিক পড়াশোনা করেন নাই, আমি তো জীবনে কবি ছাড়া আর কিছু হতে চাই না, কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হলে কী এমন ক্ষতি হবে?

একই সঙ্গে এটাও ভাবতে শুরু করি, আমি তো সারা জীবন এই বিশ্বাস খুব দৃঢ়ভাবে ধারণ করেই বেড়ে উঠেছি, আমাকে যিনি পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তিনি একটা দায়িত্ব আমার জন্য নির্ধারিত করে দিয়েই পাঠিয়েছেন, কাজেই আমার জীবন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কোন পথে এগুবে, সেটা নিয়ে আমি কেন ভাবব? এই ভাবনা যার তিনিই তো সব ঠিক করে রেখেছেন। এইসব ভাবনার গভীরে আমি যখন ডুবে আছি তখন রিক্সা এসে থামে বাংলা একাডেমির গেইটে।

কিন্তু কোথায় সুকুমার বড়ুয়া? কনকের সঙ্গে তার কোনো পরিচয়ই নেই। তার সঙ্গে কোনো অ্যাপোয়েন্টমেন্টও নেই। কনক ছিল আমার কলিজার টুকরা ভাই, বন্ধু এবং শিষ্য। ওর সঙ্গে আমি কখনো রাগ করতে পারতাম না। কখনো রাগ করলে ও এসে জড়িয়ে ধরত এবং বোকা বোকা একটা হাসি দিত, বেশি বিপদ দেখলে পায়ে ধরে ফেলত, এইসব বিষয়ে ওর মধ্যে কোনো দ্বিধা ছিল না, ইগো ছিল না। আমি যখন ওর দিকে কটমট করে তাকাই ও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে।

ওখান থেকে বের হয়ে আমাদের গ্রামের এক আজমেরি খালাম্মার বাসায় যাই। তার স্বামী ছিলেন পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর। অর্থনৈতিকভাবে তারা বেশ স্বচ্ছল ছিলেন। দুই ভাগনাকে পেলে আজমেরি খালাম্মা প্রচুর রান্নাবান্না করতেন। আমরা ওই বাসায় খেয়ে-দেয়ে বিকেলবেলা আরামে একটা ঘুম দিই। আজমেরি খালাম্মা তরুণী, সম্ভবত তখনও তার সন্তান হয়নি। তিনি কিছুটা খাটো ছিলেন, কিন্তু তার খুব বড়ো বড়ো চোখ ও দীর্ঘ চুল ছিল। তার সঙ্গে বসে গল্প করতে আমাদের খুব ভালো লাগত। তিনিও কিছুটা নিঃসঙ্গ বোধ করতেন হয়ত, তার স্বামী পুলিশের চাকরি করার কারণে অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকতেন।

আমি ভুলেই যাই যে আমার জীবনে আজ খুব বড়ো একটি ঘটনা ঘটে গেছে, বলা যায় একটি বিপর্যয়ই ঘটে গেছে। জসীম উদদীন পরিষদের সাহিত্য সচিব তখন মুস্তফা ফারুক। তার পুরো নাম মুস্তফা ফারুল আল কাদরী, তিনি মুনীর হাসান চৌধুরী তারার ছোটো ভাই। ফারুক ভাই এবং তারা ভাই থাকতেন তাদের বড়ো বোনের বাসায়। তারা ভাই ততোদিনে বিয়ে করে রামপুরায় আলাদা বাসা নিয়েছেন কিন্তু ফারুক ভাই আপার সঙ্গেই আছেন। আপার স্বামী আলাতুন নেসা স্কুলের শিক্ষক। তিনি অবশ্য আলাতুন নেসা স্কুলে যোগ যেন আমি বের হয়ে আসার পরে। আপার বড়ো মেয়ে পল্লবী আমার ছোটো বোন শাহনাজের সহপাঠী। নানান দিক থেকেই এই পরিবারের সঙ্গে আমার একটা যোগসূত্র আছে।

ফারুক ভাই আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ো হলেও খুব প্রিয় একজন বন্ধু। আমি যে সাবিনা, আমিনাকে পড়াতাম তাদের বাসার সামনে একটা মাঠ ছিল, সেই মাঠের উল্টোদিকে একটি হলুদ দালানে ভাড়া থাকতেন ফারুক ভাইয়েরা। ফারুক ভাইয়ের ঘরটি ছিল রাস্তার পাশে, একেবারে রাস্তার ওপর একটা সবুজ রঙের কাঠের জানালা ছিল। আমি গিয়ে সেই জানালায় টোকা দিতাম, তখন ফারুক ভাই দরোজা খুলতেন। আপা অসাধারণ চা বানাতেন। ফারুক ভাইয়ের কাছে যাবার একটা বড়ো আকর্ষণ ছিল আপার হাতের সেই মজার দুধ চা। ফারুক ভাই গল্প লিখতেন। তিনি শুদ্ধ প্রমিত বাংলায় একটি গল্প দাঁড় করাতে পারতেন ঠিকই কিন্তু গল্পে যে ধার থাকে, আকর্ষণ থাকে, পাঠকের আবেগকে নাড়িয়ে দেবার উপকরণ থাকে, সেগুলো পেতাম না। তারপরেও তিনি ভালো গল্পকারই ছিলেন, লেগে থাকলে একজন ভালো কথাসাহিত্যিক হয়ে উঠতে পারতেন।

আমি পরদিন ফারুক ভাইয়ের কাছে যাই। ফারুক ভাই নিজেও পাসকোর্সে বিএ পাস করে এখন চাকরি খুঁজছেন। আমাকে তিনি বলেন, একদিকে ভালোই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে বেরিয়ে চাকরি পেতে তোমার কমপক্ষে ৮ বছর লাগবে, অথচ পাসকোর্সে বি,কম পাশ করে তুমি দুই বছরের মধ্যেই একটা চাকরি নিয়ে নিতে পারবে। গ্রাজুয়েশন করে তুমি যে কোনো পদেই দরখাস্ত করতে পারবে, বাকিটা তোমার মেধা ও যোগ্যতার ওপর নির্ভর করবে। বিসিএস করতেও তো গ্রাজুয়েশনই লাগে, মাস্টার্স তো লাগে না। যদি মাস্টার্স করতে চাও, পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে মাস্টার্স করে নিবা, মন খারাপের কিছু নেই।

আমি ফারুক ভাইয়ের বাসা থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, মন্দের পেছনেও একটা ভালো কিছু থাকে, হয়ত বৃহত্তর কোনো ভালোর দিকেই আমি এখন থেকে হাঁটবো, সে-কারণেই প্রকৃতি গতকাল আমার সঙ্গে এই আচরণ করেছে। চলবে