
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ৩০
প্রকাশিত : আগস্ট ০৮, ২০২৫
রোজ সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। আজ শুনছি মানুষের ডাক। কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। বর্ষার পানি নেমে গেছে, অগ্রহায়ণ মাস। হালকা শীত পড়েছে। সকালের তীব্র রোদে পুড়ছে জলের নিচ থেকে ভেসে ওঠা জলজ উদ্ভিদ। আমি শুনতে পাচ্ছি জলজ উদ্ভিদের কুড়মুড়ে কার্পেট মচমচ করে ভেঙে একদল মানুষ হাঁটাহাঁটি করছে। এ-সময়টাতে নানান রকম পাখি আসে। ওদের কলকাকলিতেই ঘুম ভাঙে। কিন্তু সাতসকালে আমার নাম ধরে কে ডাকছে? আমি উৎকর্ণ হই। ভুল শুনছি না তো?
বাদল, ওই বাদল, উডো মিয়া। দেহো কেডায় আইছে।
ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠলে কণ্ঠ শনাক্ত করা কঠিন। আমি কণ্ঠ শনাক্ত করতে না পারলেও কথা বলার ধরণ শুনে অনুমান করতে পারছি, সালাহউদ্দিন। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই, ততক্ষণে দরোজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেছে।
বাইরে বেরিয়ে দেখি, যা ভেবেছি তাই, সালাহউদ্দিন। শুধু ও একা না, ওর সঙ্গে আরো তিনজন। বাশার, সাব্বির এবং একজন অচেনা কেউ। বাশার ছয়ফুট উঁচু এক যুবক, কোকড়া চুল, চোখ দুটো আগুনের মত লাল, সাব্বির আমাদের এলাকারই ছেলে, করিম ডাকাতের ভাগ্না। অন্যজনকে আমি চিনি না, মধ্যবাড্ডার এক যুবক। ওরা হচ্ছে বাড্ডার ত্রাশ, এই চারজনের যে কোনো একজনকে দেখলেই এলাকার মানুষ ভয়ে কাঁপে, অথচ ওরা চারজন এখন আমার বাসায়।
আমি বলি, কী ব্যাপার, এত সকালে তোমরা?
বাশার আমার দিকে ওর লাল চোখ তাক করে আছে বন্দুকের ব্যারেলের মতো। সত্যি বলতে কী আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। একটা আত্মবিশ্বাস অবশ্য আমার আছে, আর যাই হোক সালাহউদ্দিন আমার কোনো ক্ষতি করবে না, বরং অন্য কেউ ক্ষতি করতে চাইলে ও আমাকে বাঁচাবে। এবং সে পরবর্তীতে একাধিকবার তা করে দেখিয়েছে। একবার তপন আমার গায়ে হাত তুলেছে, এই কথা কারো কাছে শোনার পর ও দলবল নিয়ে ছুটে এসেছে, তপনদের বাড়িতে গিয়ে হামলা করেছে, চিৎকার করে বলেছে, তপনরে ওর মায়ের কোল থাইকা কাইড়া নিতে আইছি।
জঙ্গুইলা বাড়ির কুড়ি/বাইশজন ছেলেপেলে সব দৌড়ে ইঁদুরের হর্তে ঢুকেছিল তখন।
সালাহউদ্দিন বলে, তোমার নামটা এত বড়ো কেন? লেখক মানুষের নাম হবে দুই শব্দে। যেমন: হুমায়ূন আহমেদ।
আসলে ওরা তখন হুমায়ূন আহমেদ খুব পড়ত।
আমি বলি, তোমার নামের উদ্দিনটা কিন্তু খুব সেকেলে।
আমার এই মন্তব্যটা সালাহউদ্দিন খুব সিরিয়াসলি নেয়। ও চুপ করে থাকে। চুপ করে থেকে ডান পায়ের সেন্ডেল খোলে, এরপর বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে ভেজা মাটি খোঁচাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর বলে, উদ্দিন নামটা সেকেলে, এটা ঠিক, তবে এর সঙ্গে যখন সালাহ যোগ হয়ে সালাহউদ্দিন হয় তখন এটা চির-আধুনিক। এই নাম কখনো সেকেলে হয় না।
আমি সালাহউদ্দিনের যুক্তি শুনে বিস্মিত হই। মনে মনে ভাবি ওকে দিয়ে অবশ্যই লেখালেখি হবে। সালাহউদ্দিন শুধু একজন মাস্তান না, যথার্থই সতর্ক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। আমাদের এই রকম আলাপচারিতায় সাব্বির, বাশার ও তৃতীয়জন কিছুটা বিরক্ত হচ্ছে এবং নিজেদের অজ্ঞতায় ক্ষুদ্রও হচ্ছে। ওদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে আমি খুব স্পষ্টত তা বুঝতে পারি।
সাব্বির বলে, সালাহউদ্দিন, আসল কথা কও।
এবার আমার বুকটা ধক করে ওঠে। আসল কথা মানে কী?
সালাহউদ্দিন বলে, হোনো মিয়া, তুমারে একটা প্রস্তাব দেওনের লাইগা আইছি। তুমগো এলাকায় রেকি কৈরা দেখলাম, তুমারে সবাই পছন্দ করে। সামনে ইউনিয়ন কাউন্সিলের ইলেকশন, মোজাম্মেল চেয়ারম্যানে খাড়াইবো, তুমি এই এলাকার মেম্বর পদে খাড়াইবা।
আমি সালাহউদ্দিনের এই কথায় যুগপৎ অবাক হই।
কী কও মিয়া। এইসব বুড়া মাইনসের কাজ। টেকা-পয়সা আছে, এইরকম অসৎ বুইড়া মানুষেরা এইসব করে। আমি স্টুডেন্ট মানুষ, টিউশনি করে চলি। কবিতা লেখি, তুমগো লগে পত্রিকা বাইর করি। এইসব কী আমারে দিয়া হবে?
আলবৎ হবে। তুমারে পাশ করানোর দায়িত্ব আমগো। বাকি সব আমরা করুম। তোমার এক টেকাও খরচ হৈবো না। আমরা দেখায়া দিমু পয়সা ছাড়া নির্বাচনে পাশ করন যায়।
আমি তখন পেছনে তাকিয়ে আমাদের ভাঙা, জীর্ণ ঘরটি দেখি।
আমার মিয়া ভাঙা ঘর।
হ, আমরা ঠিক করছি এই ভাঙা ঘরেরও একটা ছবি তুলুম, পোস্টারে এইটাও থাকবো।
এবার আমি জোরে জোরে হাসি।
আর কী খবর কও। তোমরা ঘরে চলো, নাশতা খাইবা। আম্মারে কই নাশতা বানাইতে।
হৈছে বুজছি, খালাম্মারে আর কষ্ট দেওনের কাম নাই, তুমি শার্ট পরো, মুখ ধুওনের কাম নাই, হোটেলে গিয়া খামু, ওইহানেঐ কুলি কৈরা নিবা।
যেতে যেতে আমি ওদেরকে ঠাণ্ডা করতে পারি। বোঝাতে সক্ষম হই যে, পাবলিক অফিস হোল্ড করা আমার কাজ নয়। এইসব ঝামেলায় জড়ালে আমি লেখক হতে পারবো না। তাছাড়া আমি যে দারিদ্রের মধ্যে আছি, এখান থেকে বের হবার জন্য আমাকে খুব দ্রুতই কর্মজীবনে ঢুকে যেতে হবে। এইরকম ভারী সমাজসেবামূলক কাজে আমি এখনই ঢুকতে পারবো না।
আসলে পাবলিক অফিস হোল্ড করার প্রতি আমার একটা অনীহা ছোটোবেলা থেকেই ছিল। তবে এর স্বাদও আমি একবার নিয়েছি। দুই হাজার সালে জাতিসংঘের অধীনে কাজ করার জন্য কসোভোতে যাই। এক পর্যায়ে আমি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় প্রশাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমাদের মন্ত্রী ছিলেন বেহজেত ব্রাইশোরি।
তিনি কোনো এক কারণে জার্মানি যাচ্ছেন, সকালে আমাকে বলেন, কাজী, আমি কয়েকদিনের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছি, তুমি এই সময়টা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবে।
আমি বলি, এটা কী ঠিক হবে? তোমার চারজন উপদেষ্টা আছে, মন্ত্রণালয়ের পার্মানেন্ট সেক্রেটারি আছে, কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা আছে।
তিনি বলেন, আমি ভেবে-চিন্তেই বলছি। ওরা সব ব্যুরোক্রেট, পাবলিক অফিসের দায়িত্ব নেবার মতো স্পিরট ওদের নেই। এই কাজের জন্য আমাদের মন্ত্রণালয়ে তোমার চেয়ে উপযুক্ত আর কাউকে আমি দেখছি না।
সেদিন আমি না করিনি। আগ্রহ নিয়েই দায়িত্বটি নেই। মন্ত্রী হিসেবে কী কী করেছি, কতটা উপভোগ করেছি এই দায়িত্ব সেইসব আমার ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছি, এখানে শুধু এইটুকুই জানিয়ে রাখলাম, দেশে না হোক দেশের বাইরে হলেও, একবার পাবলিক অফিস হোল্ড করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।
কয়েকদিন পর আমি দক্ষিণগাঁও, কনকদের বাসায় যাই। কনক ও রিপন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। কনক অকৃতকার্য হয়েছে, রিপন দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছে। ওরা দুজনই অঙ্কে কাচা বলে মানবিক বিভাগ নিয়েছিল।
কনকের মধ্যে আবার পরীক্ষা দেবার কোনো আগ্রহ বা আয়োজন নেই। রিপন কেন পাশ করলো এজন্য ওই বাড়িতে ও বেশ কোণঠাসা হয়ে আছে। রিপনের আব্বা, আমাদের বাচ্চু মামা, আমাকে বলেন, বাদল, তুমি রিপনকে এই বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাও। এখানে থাকলে ছেলেটা মানুষ হতে পারবে না।
রিপনের সাথে কথা বলে মনে হলো, পড়াশোনা করে মানুষ হবার একটা দারুণ আগ্রহ ওর আছে কিন্তু সে তা কিছুতেই প্রকাশ করে না।
আমি ফিরে এসে আমার বন্ধু কাইয়ুমকে বলি, আমার এক ভাইয়ের জন্য একটা লজিংয়ের ব্যবস্থা করে দাও।
কাইয়ুম সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা করে ফেলে। ওর ছোটো চাচা, রমজান আলী হাজীর কনিষ্ঠ পুত্র, মান্নানের বাড়িতে লজিং মাস্টার লাগবে। মান্নানের শিশুপুত্র লিটন মাত্রই স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
পরদিনই আমি আবার কনকদের বাসায় যাই, গিয়ে একরকম জোর করেই রিপনকে ওই বাড়ি থেকে বের করে আনি। আমার খালা এতে আমার ওপর খুব রাগ করেন।
এরপরে কনক আরও বেশ ক`বার এসএসসি পরীক্ষা দেয়, গ্রামে গিয়েও দেয় কিন্তু পাশ করতে পারেনি। এর মূল কারণ হলো পড়াশোনা ওর ভালো লাগত না, পৃথিবীর সব কিছুতে আছে কিন্তু পড়াশোনায় নেই। মাকে দেখানোর জন্য সুবোধ পুত্রের মতো সন্ধ্যায় পড়তে বসা, ঠিক সময়ে স্কুলে যাওয়া সবই করত কিন্তু প্রকৃত অর্থে আসলে এসব কিছুই সে করত না।
রিপন আমার পাশে, এই লজিং বাড়িতে থেকে, ছাত্র পড়িয়ে এইচএসসি, বিএ এবং এমএ পাশ করে। সোনালী ব্যাংকে চাকরি নেয়। বিয়ে করে এখান থেকে বের হয়। বের হয়ে, যাত্রাবাড়ির ওই দিকটায়, শ্বশুরের নিজের বাড়ি ছিল, সেখানে গিয়ে ওঠে। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপেই রিপন আমার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। বলা যায় আমিই ছিলাম ওর প্রধান অভিভাবক।
আমি মনে করি রিপনকে আমার খালার বাড়ি থেকে বের করে এনে আমি একটি বড়ো ধরনের সমাজসেবা করেছি। কনকের জন্যও অনেক কিছু করতে চেয়েছি কিন্তু ও ছিল ভিন্ন ধাতুতে গড়া। ওর পুরোটাই ছিল ফাঁকি দিয়ে ভরা। ফলে ফাঁকিতেই ওর জীবন আটকে ছিল এবং একটা বিশাল ফাঁকিতে পড়ে ওর জীবনাবসানও ঘটে। চলবে