কামরুল আহসানের গদ্য ‘প্রকৃতির ভারসাম্য’

প্রকাশিত : অক্টোবর ২২, ২০২০

এ-বছর যে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে এর কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন করোনাকালে প্রকৃতি স্বাভাবিক ভারসাম্যে ফিরে আসার কারণেই নাকি এমনটা হচ্ছে। কার্তিক মাস চলছে, তাও আষাঢ়-শ্রাবণের মতো মুষলধারা ঝরছে। গাছগুলো কী সবুজ! ঢাকায় এম্নিতেই গাছ নাই, তাও যেকটা আছে এমন সবুজ নিকট অতীতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। রমনাপার্কের পাশ দিয়ে আসার সময় মনে হয় স্বর্গের একটা বাগান হাসছে। গাছ ও সবুজ প্রকৃতির অপরূপ এক নান্দনিক দিক। মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের চারপাশে যদি সবুজ একটা পৃথিবী না থাকতো তাহলে বেঁচে থাকাটা কেমন লাগতো। যতই ক্লান্তি আসুক, জীবনের ক্লেদ আসুক একটু টুকরো সবুজের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দেখি বেঁচে থাকার একটা আরাম আছে।

একবার এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় এক মজাপুকুরে ফুটে উঠা একথোকা কচুরিপানার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। পাশেই ছিল এক আবর্জনা, লোকজন ওখানে ময়লা ফেলে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবলাম, প্রাণের কী স্পন্দন, একটু জল পেয়েই কচুরিপানাগুলো কীরকম বেড়ে উঠেছে! এটুকু কচুরিপানাই যদি মঙ্গল গ্রহে পাওয়া যেত তাহলে তো পৃথিবীর মানুষ পাগল হয়ে যেত! অথচ, এই পৃথিবীর সবুজ প্রকৃতি ধ্বংসের আয়োজন করে বসে আছে মানুষ! বারান্দার টবে দুচারটে গাছ লাগানোই তো সবুজ পৃথিবীতে ভালোবাসা না। সবুজ পৃথিবীকে ভালোবাসতে হলে সারা পৃথিবীটাকেই সবুজ রাখতে হবে।

আড়াই হাজার বছর আগে লাও ৎসু বলেছিলেন, পৃথিবীর কোনো কিছুই পরিবর্তন করো না। একটা গাছ কেটো না, একটা গাছ লাগিয়োও না। তোমার তো গাছ কাটার দরকার নেই। প্রকৃতির মধ্যে যত গাছ আছে এনাফ। তুমি গাছ লাগাবে তো কেটে ফেলার বাসনায়।  মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি সে প্রকৃতির মধ্যে পুনরুৎপাদন করতে পারে। এই পুনরুৎপাদনের চিন্তাই তাকে প্রকৃতি সমস্ত সম্পদ লুটে নেবার প্ররোচনা দেয়। তেলের খনি মানুষ খালি করে ফেলছে। কিন্তু সেই তেল আবার ভরবে কি দিয়ে সেই চিন্তা করে না। গ্যাস, কয়লা উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভে যে শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে সেই শূন্যতা মানুষ পূর্ণ করবে কী দিয়ে! আছে কি এমন কোনো প্রযুক্তি?

দুশো বছরের ধনতান্ত্রিক বিকাশ দুই লক্ষ বছরের সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিল। কী হবে আগামী প্রজন্মের, কী আছে মানুষের ভবিষ্যৎ! প্রকৃতি ধ্বংসের যে আয়োজন এটা তো অসংখ্য পারমাণবিক যুদ্ধের চেয়েও খারাপ। একটা এটম বোম এক দেশে ফুটলে সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের ক্ষতি হয়, সমস্ত প্রকৃতি ধ্বংস তো সারা পৃথিবীর ধ্বংসের আয়োজন করছে। এই যে এত তেল-গ্যাস-কয়লা পুড়ছে তাতে তো ওজনস্তর ভারি হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতা বাড়ছে। হাজার বছর ধরে জমাটবদ্ধ বরফ গলে যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। মানুষের জন্য ভূমি কমে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষ বাড়ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধ, হানাহানি, রক্তপাত অনিবার্যই হবে। প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার আগপর্যন্ত তো কোনোভাবেই মানুষের জীবন স্বাভাবিক কাম্য হতে পারে না।

মানুষ এটা বুঝতে পারলেও খুব যে সচেতন হচ্ছে তা না। আমরা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে গেছি। আমিও কোনো না কোনোভাবে প্রকৃতি ধ্বংসের পেছনে কাজ করছি। আমি তো মোবাইল ব্যবহার করছি, কম্পিউটার ব্যবহার করছি, ফ্রিজ ব্যবহার করছি। এগুলো তো সবই শুধু প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর তা তো না, আমার স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। কিন্তু কী করব! মানুষ কি আবার আদিম সমাজব্যবস্থায় ফিরে যাবে? আদিম সমাজব্যবস্থায় ফিরে না গেলেও আদিবাসীদের অনুসরণ করতে পারে। নানা গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা আদিবাসীরা যে-ধরণের জীবনযাপন করেন প্রকৃতি ও মানসিক শান্তির জন্য তা আমাদের তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার চেয়ে অনেক বেশি শ্রেয়। এমন কি, তাদের অর্থনীতিও যুগ যুগ ধরে প্রায় একই থাকে। খুব বেশি তারতম্য হয় না। আমরা যে বছর বছর মন্দা, দরপতন, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি নিয়ে চিন্তিত থাকি তাদের এ-ধরনের কোনো ব্যাপার নেই।

চলচ্চিত্র পরিচালক অবু সাইয়ীদ ভাই সবুজ পৃথিবীর পক্ষে জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন।  সবুজ পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষায় তিনি উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করেছেন। চলন্ত রাস্তা থেকে তা আবাসন-ব্যবস্থা পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি এমন একটা আবাসিক প্রকল্প দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন যেখানে কম জায়গা ব্যবহারেই বাড়ির সাথে সুন্দর বাগান তৈরি করা যাবে। আমাদের এখন নতুন কিছু চিন্তা দরকার। পুরনো চিন্তাগুলো দিয়ে তো আর কাজ চলছে না। তিনি সেই নতুন চিন্তায় মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করছেন। আগ্রহীদের তার পেইজে গিয়ে তার কাজ ও চিন্তা দেখার অনুরোধ করছি।