চলার পথে সমস্যার সম্মুখীন না হলে বুঝবে, ভুল পথে চলেছ

পর্ব ১১

প্রকাশিত : মে ০৩, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো ১১ পর্ব।

২৭ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার
দুই-তিন দিন ধরে দেখছি, এক নতুন যন্ত্রণার উদয় হয়েছে। সকাল ৯টা সাড়ে ৯টার দিকে মোহাম্মদপুরে কোনো রিকশা পাওয়া যায় না। আজও তিন রাস্তার মোড়ে এসে দেখি, ঠা ঠা রোদের মধ্যে একঝাঁক মানুষ জিয়ল মাছের মতো খলবল করছে। রিকশা নেই। হঠাৎ একটা দুটো রিকশা এলে সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। রিকশাচালকের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। সে বেকুবের মতো টাউন হলের ভাড়া চাচ্ছে আশি টাকা! ধানমণ্ডির ভাড়া চাচ্ছে দেড়শো টাকা! সায়েন্স ল্যাবের ভাড়া চাচ্ছে দুশো টাকা!

খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই আজব রঙ্গমঞ্চ উপভোগ করলাম। তারপর হাঁটতে শুরু করলাম। সকাল সকাল সূর্যের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। গগনে গরজে রোদ অবস্থা। এর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনে হলো, রোজ হাশরের ময়দানে হাঁটছি। মাথার আধা হাত উপরে নেমে এসেছে সূর্য! মনে পড়ল স্বামী বিবেকানন্দের একটা কথা, `সারাদিন চলার পথে যদি সমস্যার সম্মুখীন না হও, তাহলে বুঝবে তুমি ভুল পথে চলেছ`। আমার তো দিন শুরুই হয় সমস্যা দিয়ে। আমি কি সঠিক পথে আছি?

লালমাটিয়ার কাছাকাছি এসে একটা রিকশা পেলাম। অফিসে যেতে যেতে বেশ খানিকটা দেরিই হয়ে গেল। কী আর করা! দ্রুত কাজে ডুবে গেলাম। অফিসের জরুরি কয়েকটা কাজ সেরে একটা অনুবাদ নিয়ে বসলাম। ইউভাল নোয়াহ হারারির একটা নতুন লেখা। দীর্ঘ কলেবর, প্রায় চার হাজার শব্দের। এত বড় লেখা কতক্ষণে অনুবাদ করব, খোদা!

হারারি আমার পছন্দের চিন্তক। জিজেক কিংবা নাসিম নিকোলাস তালেবের চেয়ে হারারির চিন্তাভাবনা অনেক স্বচ্ছ মনে হয় আমার কাছে। আমি নিয়মিত এদের সবার লেখা পড়ি। আমার বয়সী অন্যরা যখন সোলায়মান সুখন, ডন সামদানি, আরিফ আজাদ, আজহারী, মুনজেরিন, আয়মান সাদিককে ‌`ইনফ্লুয়েন্সার` বলে অনুসরণ করে, আমি তখন হারারি জিজেকের মাঝে ইনফ্লুয়েন্স খুঁজি। আমি হয়ত সময় থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষ!

অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনুবাদ এগিয়ে নিচ্ছিলাম। ততক্ষণে দুপুর হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটা একটা অতিক্রান্ত। হঠাৎ বাসা থেকে ফোন এলো, সবার বাসায় বিদ্যুৎ আছে, আমাদের বাসায় নেই। বললাম, মিটারের টাকা শেষ হয়ে গেছে সম্ভবত। তারপর বিদ্যুতের কার্ড রিচার্জ করার দোকানের ঠিকানা দিয়ে বললাম, টাকা রিচার্জ করে আন।

সারা বাসা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কার্ড না পেয়ে আবার ফোন করল। আমি বললাম, অমুক ড্রয়ার, তমুক ড্রয়ার, অমুক টেবিল, তমুক টেবিল খুঁজে দেখ। তারা আবার সব কিছু উলটপালট করে খুঁজে বলল, পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে আমি নিজের মানিব্যাগ তালাশ করে দেখলাম, হ্যাঁ, আমার মানিব্যাগের মধ্যেই আছে সে বস্তুখানা!

এখন তো বাসায় যাওয়া দরকার। যা গরম পড়েছে, মা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। কালক্ষেপণ না করে এই মুহূর্তেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু তখনই বেরুতে পারলাম না। টুং টুং করে হোয়াটস অ্যাপ পতনের শব্দ হলো। খুলে দেখি, স্বয়ং চেয়ারম্যান মহোদয়ের মেসেজ। একটা কাজ দিয়েছেন। এই কাজ না করে তো অফিস থেকে বের হওয়া যাবে না। কাজটা শেষ করে অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে বিকেল চারটা পার হয়ে গেল।

অফিস থেকে বের হওয়ার আগে ফেসবুকে ঢুকে দেখি তুলকালাম অবস্থা। এক অতিশয় সুশ্রী কিশোরী মারা গেছে। তার মৃত্যুর জন্য অভিযোগ উঠেছে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহানের বিরুদ্ধে। একবার ফেসবুক স্ক্রল করতেই অনেক লেখা, অনেক ছবি চোখে পড়ল। কেউ মেয়েটার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, কেউ মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আমার চোখে পড়ল সায়েম সোবহানের বউ-ছেলে-মেয়ের একটা গ্রুপ ছবি। মৃত মেয়েটির সঙ্গে সায়েমের ফাঁশ হওয়া এক অডিও রেকর্ডও শুনলাম। সত্যিই তাদের কথপোকথন কি না জানি না।

মনটা তবু ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। বিষণ্ণতা আর গা গুলিয়ে ওঠা অনুভূতি নিয়ে অফিস থেকে বের হলাম। রিকশায় ওঠার পরেও সেই অডিওর কথা আর সায়েমের পারিবারিক ছবিটা মাথা থেকে গেল না। আমার বারবার মনে পড়তে লাগল, সায়েম সাহেবের ছোট ছোট ছেলে মেয়ে দুটির কথা। ওরাও তো কোনো না কোনো স্কুলে পড়ে। ওদেরও তো বন্ধু আছে। এখন থেকে ওদের বন্ধুরা কি জিজ্ঞেস করবে, এই তোর বাবার নামে ফেসবুকে এসব কি দেখছি রে? এই তোর বাবা কি সত্যিই এরকম ভাষায় কথা বলে?

ছেলেমেয়ে দুটোর মাথা নিচু করা লজ্জিত মুখ, মাটিতে মিশে যাওয়া মুখ কল্পনা করে আমার চোখে পানি এসে গেল। এরপর থেকে ওই শিশুরা কি ওদের বাবার পরিচয় দিতে পারবে? বাবাকে শ্রদ্ধা করতে পরবে? কি মূল্যবোধ নিয়ে বড় হবে ওরা? নাকি এখনই বাবাকে নিয়ে গর্ব করতে শিখে গেছে ওরা? ওদের চোখে বাবাই ওদের জীবনের আইডল? বড় হয়ে ওরাও সায়েম সোবহানই হতে চায়। কি ভাবছে সায়েম সাহেবের স্ত্রী? পরিচিত মহলে মুখ দেখাতে পারছে তো? এইসব উদ্ভট চিন্তা করতে করতে বাসার কাছাকাছি চলে এলাম। রিকশা থেকে নেমে দ্রুত বিদ্যুতের প্রিপেইড কার্ড রিচার্জ করলাম।
বাসায় গিয়ে দেখি, মা গরমে হাঁসফাঁস করছে। আমার ভীষণ অপরাধবোধ হলো। চলবে