লেখকের কন্যা সেতুবালা

লেখকের কন্যা সেতুবালা

চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৬০

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুন ০১, ২০২০

এক.
চার বছর আগে এই দিনে সন্ধ্যাবেলা হাসপাতালে ভর্তি হলাম। পরের দিন সকাল সাড়ে ন’টায় ওটি বুক করা ছিল। কেবিনে কিছুক্ষণ থেকে ফিরে গেছিল সুদীপ্ত। তখন বোধহয় রাত আটটা-ন’টা হবে। দুজন নার্স এসে কিছু রুটিন চেকাপ করে গেছে সবেমাত্র। হঠাৎ পেটের নিচের দিকে সজোরে একটা ঝাঁকুনি টের পেলাম আর আমার জামাকাপড় বিছানা সব ভিজে যেতে শুরু করলো। যেন যুগান্তের জলধারা আমার পেটের ভেতর ফুঁসছিল। যেন হড়কা বানের ভেতর জেগে উঠছিল এক প্রাণ পূর্ণ চেতনায়। নিজের ভূমিষ্ঠ হওয়ার সন্ধিক্ষণ সে নিজেই ঘোষণা করলো এবার।

বেল টিপে নার্স দিদিদের ডাকলাম। সুদীপ্তকে ফোন করলাম। ও প্রায় বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছিল। বললো, ‘আসছি এক্ষুণি।’ আমি হতভম্বের মতো বসে রইলাম কেবিনের বেডে। অবিরত জলপ্রপাতের মধ্যখানে ক্লান্ত শ্রান্ত আমি ভাবতে লাগলাম, এ কেমন স্নান, কেমন এ আবাহন! পৃথিবী একটি প্রাণের বাসনায় ছিল। মাধ্যম শরীরে প্রস্তুতি শেষ। এবার তাকে স্নেহ চুম্বন দিয়ে বরণ করে নেয়ার পালা। আমার প্রথম প্রাণের সম্ভাবনা শুরুতেই বিনষ্ট হয়েছিল। সে এক অসম্ভব যন্ত্রণা। যেদিন তার প্রথম আসার ইঙ্গিত পেয়েছিলাম, সেদিনই সে আমাকে ছেড়ে গেছিল। ডাক্তার আলট্রাসাউন্ড করে বলেছিলেন, ‘নেই।’ এই এক ‘নেই’ এ সমস্ত সম্ভাবনা নস্যাৎ করে চলে গিয়েছিল কাঙ্ক্ষিত প্রাণ। ধিক ধিক করে তার অগঠিত সত্তার নিষ্ক্রমণ হয়েছিল প্রবল যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে।

এবারেও সেই যন্ত্রণা । তবে তা দশ গুণ বেশি। এ যন্ত্রণা তো আবাহনের। ডাক্তারকে ফোন করে জানানো হয়েছে ততক্ষণে। তিনি কথা দিয়েছেন ইমার্জেন্সি বেসিসে সিজার করবেন আজ রাতেই। তবে অ্যানাস্থেসিস্টের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তাকে তো বলা আছে সকাল সাড়ে ন’টা। এদিকে ডাক্তারের কথামতো নার্স দিদিরা আমাকে প্রস্তুত করতে লেগে পড়েছে। কিছু ওষুধ দেয়া, অ্যাপ্রন পরানো আরো কীসব। থেকে থেকে যন্ত্রণা বাড়ছিল। কখনো সে আলোড়ন উত্তাল কখনো বা আপাত শান্ত। পৃথিবীর সাথে সংযোগ ছিন্ন করে দিয়ে কেউ যেন আমার শরীরটাকে গ্রাস করে আমার ভেতরে তার নিষ্কৃতির পথ খুঁড়তে ব্যস্ত। এতদিন আমার শ্বাসে শ্বাস নিয়েছে যে, আমার দেহের খাদ্যকণা শোষণ করে বেড়ে উঠেছে যে নাভিবীজ, এবার সে আমার সাথে তার অন্তর্গত সম্পর্ক বিস্মৃত করে নির্গত হতে চায়। তাই এত বিদ্রোহ।

রাত তখন গভীর। বোধহয় তিনটে হবে। স্ট্রেচারে করে যখন আমাকে লিফটে তুললো ওটিতে নেবে বলে, সিডেটিভের ঘোরে আমি অস্পষ্ট ভাবে আমার মায়ের মুখটা দেখলাম। ওটিতে ঢুকে দেখলাম সুদীপ্তকে, অ্যাপ্রন পরে অপেক্ষারত। ডাক্তার অ্যানাস্থেসিস্ট নার্স সকলেই প্রস্তুত। একবার আমার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, খুবই হাস্যকর প্রশ্ন, ‘আচ্ছা ম্যাডাম, বেবি হওয়ায় পর তো আমার জ্ঞান থাকবে না কিছু সময়। আমার বেবিটা অন্য কারোর বেবির সাথে বদলে যাবে না তো?’ ডাক্তার হেসে বলেছিলেন, ‘হওয়ায় পর যে দেখবে তাকে, সারাজীবন ভুলবে না তার মুখ। বদলাবে কি করে শুনি?’

তারপর চেতনা শক্তি রহিত হওয়ায় পালা। মেরুদণ্ডে একখানা ইনজেকশন পুশ করার সাথে সাথেই শরীরের নিচের অংশ ক্রমশ অবশ হয়ে গেল। যেন স্থবির ব্যাঙ! আশপাশে সকলের নড়াচড়া কথাবার্তা অস্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি তখনো। আমার মাথার কাছে উদগ্রীব পিতার মুখ স্থির হয়ে আছে অনাগত ভোরের অপেক্ষায়। ডাক্তাররা তাদের ক্রিয়াকলাপে ব্যস্ত, অস্বচ্ছ ঘোরের ভেতর তাদের ঋত্বিক বলে বোধ হতে থাকে। আমাকে মাঝখানে রেখে চলছে যেন মন্ত্রপাঠ, উপচার, যজ্ঞীয় ঘৃতাহুতি। হঠাৎ শুনি পার্কস্ট্রীটের মসজিদে বেজে উঠেছে ভোরের আজান। তারিখ পয়লা জুন। এক স্বর্গীয় ভোর পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যেন। চামর দোলাচ্ছে। এরই মাঝে প্রবল ঝংকারে কেঁদে উঠলো এক শিশু। ডাক্তার তাকে নিয়ে এসে আমাকে দেখালেন, ‘দ্যাখো, তোমার মেয়ে হয়েছে।’ দেখালেন শিশুর পিতাকেও। অচেতন হয়ে পড়ার আগে একটা কথাই বলেছিলাম সুদীপ্তকে, তোমাকেই বেশি ভালোবাসবে, দেখো...

এই অবধিই সত্য। এই অবধি চিরন্তন ও শাশ্বত। এই প্রকৃতির প্রয়োজনে এসেছে যে শিশু মাতৃদুগ্ধের অধিকারে আমি তাকে একান্তই আমার করে গড়ে তোলা শুরু করলাম। আমার সেতুবালা। আজ তার জীবনের চার বছর পূর্ণ হচ্ছে।

দুই.
মানুষ নিজের জীবনে অন্ধকারকে যতই প্রশ্রয় দিক না কেন, দিনের শেষে সে আলোর পিয়াসী। তাই তো রুপালি পর্দায় হিরো যখন ভিলেনের হাতে মার খায় তখন দর্শক ঠোঁট কামড়ে ধরে। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে সেই যুদ্ধের শেষ দেখবে বলে। তারপর হিরো যখন সবাইকে খতম করে রক্তাক্ত ফিনিক্সের মতো উদিত হয় তখন পুরো হল ফেটে পড়ে হাততালিতে। সে জিতলে মানুষেরও জিৎ হয়। জীবনেও আমরা এমনই একটা ক্লাইম্যাক্সের জন্য অপেক্ষা করি, খুব গোপনে।

তিন.
রাত যেভাবে বাড়ে, তেমনই নীরবে বয়সও বাড়তে থাকে। বয়স যত বাড়ছে তত বুঝতে পারছি, আমি আমার অপছন্দের বিষয়গুলোর সাথে আর চলতে পারছি না। অথচ চূড়ান্ত তিক্ততার বিষয়গুলোকে আমি আমার অস্তিত্ব থেকে বাদও দিতে পারছি না। ভেতর থেকে কেউ যেন বলছে, ‘ডোন্ট বি টাচড। ডোন্ট বি টাচড। ডোন্ট বি টাচড।’ অথচ ভেতরে ভেতরে আমার অপছন্দগুলো চূড়ান্ত বিবমিষায় পরিণত হচ্ছে।

অনেককেই দেখি, দিব্যি হেসে কেঁদে জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছে কোনও বেসিক ইন্টিগ্রিটি ছাড়াই। আমি একজন মানুষকে যখন দেখি শুধু সে কি বলছে সেটা দেখি না। সে কি করছে সেটাও দেখি। ফোনের ভেতর যখন কোনও মানুষ কথা বলে, তার কণ্ঠস্বর নীরব শ্বাসের ওঠাপড়াও অনেক কিছু বলে, যা সে কখনো মুখে বলবে না। একজন মানুষ মুখে যা বলে আর যা মনের ভেতর ধারণ করে তার ভেতরে সূচারু ফারাকটুকুও ধরতে পারি অনেকসময়। কিন্তু খুব বড় রকমের ব্যবধান হলে আমি তা নিতে পারি না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার সাথে চলি, কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা বিলীন হতে থাকি পরস্পরের কাছে।

এসবের মধ্যে দিয়েই, যেভাবে রাত বাড়ে নীরবে, তেমন করেই আমাদের বয়স বাড়তে থাকে। আমরা বুড়োই।

চার.
বৃষ্টি হলে দোতলার ছাদ বেয়ে জল নামে। দৌড়ে গিয়ে একটা চাদর বা তোয়ালে বিছিয়ে দিতে হয়। শোওয়ার ঘরের দক্ষিণের জানলাটা বদলানো হলো বিয়ের একবছরের মাথায়। পুরনো ধাঁচের জানলাটার নিচের দিকে বৃষ্টি জল নিকাশের জন্য ছোট একটি নালী করা ছিল। সেটা বুজে যাওয়ায় বৃষ্টি হলে হড়হড় করে জল ঢুকতো। আমি একটা চাদর কম্বল যা হোক দিয়ে প্রতিরোধের বৃথা চেষ্টা করতাম। এরকম কতকিছু বদলে গেল এক এক করে। পুরনো থেকে নতুন।

গঙ্গার ধারে বাড়ি। মাটি ভিজে। প্রথম যখন গেলাম তলার আপিসঘরে উঁই লেগেছিল। সেখান থেকে একটা একটা করে পাশের ঘরে। আমি একটা স্প্রে বোতলে কেরোসিন তেল ভরে সারা বাড়িতে ছুটে বেড়াতাম। দরজা জানলায় পুরনো কাঠের কোণে কোণে স্প্রে করতাম। এত আমার না করলেও চলতো, তবু করতাম। এমনই একদিন স্প্রে গান হাতে দৌড়তে গিয়ে দোতলার মার্বেলের সিঁড়ি দিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলাম। কোমরের টেল বোনে আর বাম হাঁটুতে চোট। ডাক্তার বললো কোমরের টেল বোন জয়েন্টে সামান্য ডিসলোকেশন আছে। ওটা অপারেশন করানো দরকার। নইলে প্রেগন্যান্সিতে খুব কষ্ট দেবে, কারণ ওই হাড়ে চাপ পড়বে অ্যাডভান্সন্ড স্টেজে।

অপারেশন করালাম না। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, সেতু হওয়ায় পর ওই ব্যথাটা নিজে থেকেই গায়েব হয়ে গেল। ঠিক হলো না হাঁটুর জখম। জখমের ওপর জখম হলো। আছাড় খেলাম মার্বেলেই। পুরো হাঁটুতে বীভৎস রকম কালশিটে পড়লো। কালশিটে মেলাতে মাস দুয়েক লাগলো, কিন্তু ইন্টারনাল ইনজ্যুরি ছিল হয়তো কিছু, সে ব্যথার মতো জেগে রইলো। গেলাম না আর ডাক্তারের কাছে। এইভাবে আমি আর এ বাড়ির মধ্যে কত উপাখ্যান তৈরি হলো। বাইরে থেকে দু’এক পলক দেখে যারা সব বুঝে ফেলতে চায় জীবনের উপন্যাস সম্পর্কে তারা খুব ছেলেমানুষ। শুধু আমি জানি আর জানে ওই বাড়ি...

সত্তরটা বছর ধরে ঝড় বিদ্যুৎ মাথায় করে যে দাঁড়িয়ে আছে, এ কথা জেনেছি বলেই আমি যাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম বালিকা সুলভ সম্ভ্রমে। আজও ভালোবাসি। শুধু বাঁ হাঁটুটা জখম হয়ে গেছে এই যা...

পাঁচ.
সারা পৃথিবী যখন অতিমারির সাথে লড়তে লড়তে ক্লান্ত, যে বিজ্ঞানী গবেষণাগারে বসে দিনরাত এক করে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টায় রত থাকেন, মনে হয় তিনি ভগবান। মানুষ যখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে, যে চিকিৎসক তার জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে এসে দাঁড়ান, মনে হয় তিনি ভগবানের অবতার। প্রচন্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে যে রুগীটি, যে নার্স দিদি ঘড়ি ধরে তার মুখে প্রাণদায়ী ওষুধটি ঢেলে দেন, মনে হয় তিনি সাক্ষাৎ দেবি। সারা শহর যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, যে সকল কর্মীরা দিনরাত এক করে মানুষের ঘরে ঘরে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করে, মনে হয় তারা সুপার হিরো।

মানুষ যখন গৃহহীন অন্নহীন বিপন্ন, যে নেতা পথে নেমে মানুষের সেবা দেন, মনে হয় তিনিই প্রকৃত ত্রাতা। বিপদে আপদে যে ঈশ্বরকে আমরা স্মরণ করি, সৃষ্টিকে ধারণ করাই তাঁর একমাত্র কাজ নয়। যিনি ধ্বংস করেন বিনাশ করেন তিনিও ঈশ্বর। তিনি কারো হয়ে কাজ করেন না। কারো বিপক্ষেও নয়। তিনি নির্বিচার। কিন্তু শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতায় কিংবা বিস্ময়ে যাদের আমরা ঈশ্বর বা সুপার হিরোর সাথে তুলনা করি, মনে রাখা দরকার তারা আসলে মানুষ। কখনো কখনো তারা নিজেকেও ছাপিয়ে যান। কখনো কখনো তাদের ছাপিয়ে যায় অন্য কিছু। এটাই যথেষ্ট মানবিক। কারণ মানুষ কখনোই পুরোপুরি নিরপেক্ষ হতে পারে না। কারণ, মানুষ তো মানুষই, ভগবান নয়।

ছয়.
কবি ও গদ্যকার উত্তম দত্তের সাম্প্রতিক রচনাগুলি একের পর এক চমকিত হতে বাধ্য করে। চমকের রেশ উত্তীর্ণ হলে তার লেখাগুলির প্রাসঙ্গিকতা এই যে, তা ভাবায়। ভাবতে বাধ্য করে।

আজকের গদ্যটিতে লেখক সৃজনশীল হৃদয়ের বোধগম্যতা তথা গ্রহণযোগ্য হওয়ায় যে চাহিদা বিশেষত নিকটজনের কাছে এবং এই অন্তহীন খুঁজে ফেরার যে জার্নি, বিশেষ করে তার কাছের মানুষরা যদি সেই অর্থে সৃজনশীল না হয়ে থাকেন, তার প্যাথোজকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

আমি কোথায় পাবো তারে
আমার মনের মানুষ যে রে...

বিষয়টিকে সহজবোধ্য করতে লেখক কিছু সমসাময়িক কবি লেখক বা চিন্তকের ব্যক্তিগত জীবনের ছবি তুলে ধরেছেন। লেখাটি পড়তে পড়তে মনের ভেতর কিছু শব্দ অনিবার্য ভাবে দানা বাঁধতে শুরু করলো। তাই লেখার চেষ্টা:

আমি অল্পবিস্তর লেখালিখি করে থাকি। আমি যাকে বিবাহ করেছি অর্থাৎ সামাজিক ভাবে আমার সবথেকে কাছাকাছি থাকা মানুষটিও কবি। আমি তাকে নির্বাচন করিনি এ কারণে যে আমার প্রতীতি জন্মেছিল সে আমাকে সবথেকে ভালো বুঝবে। আমি একজনের প্রেমে পড়েছিলাম। ঘটনাচক্রে যার প্রেমে পড়েছিলাম সে কবিতা লেখে এবং সে সময়ের অনেকটা অংশই আমাদের কবিতা নিয়ে কাটতো। কিন্তু এতদসত্ত্বেও প্রেমটা নাও হতে পারতো। কিন্তু শেষ অবধি তা হলো।

জয়দা অর্থাৎ কবি জয় গোস্বামী একবার ব্যক্তিগত আলাপ চারিতায় বলেছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে একটা দারুণ ইনট্যালেকচুয়াল ফ্রেন্ডশিপ আছে।’ ঘটনা এটাই শ্রেয়া আর সুদীপ্ত যখন ব্যক্তি শ্রেয়া ও সুদীপ্তকে ভুলে যেত বা ভুলে যায় তখন তার পরস্পরের কাছে দারুণ বোধগম্য হয়ে উঠতো বা ওঠে। রাত পরের রাত ঘুম টুম ভুলে যখন তারা কবিতা পড়ে, অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে জীবন দর্শনের গভীর আলোচনায় তখন সত্যিই তারা একে অপরকে কমপ্লিমেন্ট করে দারুণ ভাবে।

যে শ্রেয়া ও যে সুদীপ্তকে চোখে দেখা যায় না সেই অপার্থিব অগম্য আলোয় তারা অনবদ্য মরাল মরালি জুটি। কিন্তু জীবন কি শুধু ওইটুকু? কিংবা পরস্পরের কাছে গ্রহণযোগ্য হবার তাগিদ ও চাহিদা? মানুষেরই বা পরিমাপ সম্ভব কি করে, উন্মোচন সম্ভব তার অজস্র সত্তার গোপন অন্তর্জাল?

সবচেয়ে দুর্গম যে মানুষ আপন অন্তরালে
তার কোনও পরিমাপ নেই বাহিরের দেশে কালে

কতবার মনে হয়েছে কোন বোধ অতিক্রান্ত কবিতার উৎসমুখে দাঁড়িয়ে যে মানুষটা আমাকে এত ভালো বোঝে, রক্ত মাংসের মানবী যে শ্রেয়া তাকে সে আদৌ কতটুকু বোঝে? এই বোঝা না বোঝার গ্রে জোনে এসে যে মানুষটি ডানা মুড়ে বসে পড়ে সে কি তার কবি সুলভ ঔদাসীন্যে? মানুষ কোথাও নিজেকে সঁপে দিতে চায়। বারবার প্রেমের কষ্টিপাথরে নানাভাবে নিজেকে যাচাই করে দেখতে চায় সে, খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর...

কিন্তু মানুষের প্রেমের কাছে সঁপে শান্ত হওয়ায় মতো নিরস্ত্র হওয়ার মতো বেদনা কি এক? সে তো একের মধ্যে অনেক। তাই তার বোঝানোর চেষ্টা, অন্যের কাছে বোধগম্য হওয়ায় মতো দুর্বোধ্য সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ও একাধিক। যে মানুষ যত সংক্ষিপ্ত তার খোঁজও তত দ্রুত নিরসনযোগ্য। শেষ অবধি কেউই কাউকে বোঝে না। মানবজীবনের অনেকটাই রহস্য, সম্পর্কের উত্তরণটাও সেরকমই। সৃজনশীল মানুষের তীব্র একাকিত্ব বোধ আলোর ওপিঠে অন্ধকারের মতো, যার ভার অনিবার্য ভাবে ওঠাতে হয়। একজন মানুষের আরেকজন মানুষকে বোঝা আর একজন কবির আরেকজন কবিকে বোঝা সম্পূর্ণ দুটো আলাদা ডায়মেনশন। এরা পরস্পরের নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করে এই আমার বিশ্বাস।

কোথাও কোথাও কবিতা মানুষকে ছাপিয়ে যায় কোথাও মানুষ কবিতাকে।

সাত.
এ বছরের কপালে নাচছে করোনা, যদি কোনও দূরদৃষ্টি বলে তা জানা যেত তবে জীবনের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত একটু অন্যভাবে নেয়া হতো কি? যারা প্রেমে অবিচ্ছেদ্য তারা হয়তো অনেক আগেই বিয়েটা সেরে নিত। ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিত আরও একটু ভেবেচিন্তে। আমি আমার কোমর অবধি লম্বা চুল অবশ্যই কাটতাম না। উফ, রাত্রিবেলা শক্ত করে বিনুনী বেঁধে শোওয়ার যে কী সুখ! ঘাড়ের কাছে ফুরফুর করে হাওয়া খেলার বিস্তর পরিসর।

আমার ওই ঈষৎ কোঁকড়ানো চুল স্টাইল করে ঘাড় অবধি ছেটে ফেলার ঠেলা বুঝিয়ে দিচ্ছে লকডাউন। পার্লার বন্ধ। শেষ ট্রিম করেছিলাম চার পাঁচ মাস হয়ে গেল। আমার চুলের বৃদ্ধি পাওয়ায় বেগ বেশ দ্রুত হওয়ায় চুল ঘাড় ও কাঁধ অতিক্রম করে পিঠের উপর অবধি ক্রমপ্রসরমাণ। যেন বটগাছ ঝুরি নামাচ্ছে দ্রুত। পুনরায় আমাকে শিকড়ে বাকড়ে বেঁধে ফেলতে চায়। কিন্তু তার দৈর্ঘ্য এখন এমন যে বিনুনী বাঁধার উপযুক্ত নয় মোটেই। ফলত ঘাড়ের ওপর অনেকখানি ক্লান্তি নিয়ে আমি বসে থাকি সারাদিন। যেন গোটা একটা পাখির বাসা ডিমের ভারে ন্যুব্জ।

জানি না এই সকল দিন কবে আবার বীতশোক হবে। আবার কবে ডানা মেলবে প্রজাপতি। ততদিনে আবার হয়তো শিকড় বাকড় সমেত একটা হিলহিলে সাপ আমার ঘাড় ছাড়িয়ে কোমর অবধি খেলা করবে। পেছন থেকে কেউ কুনজর দিলেই ফণা তুলে বলবে, ফোঁস! চলবে

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক