সুশান্ত সিং রাজপুত

সুশান্ত সিং রাজপুত

চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৬২

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুন ১৫, ২০২০

সুশান্ত সিং রাজপুত আত্মহত্যা করেছেন নাকি কালপবল হোমিসাইডের ভিকটিম, সেটা অন্য বিষয়। এভিডেন্স তা প্রমাণ করবে। কিন্তু আলোচ্য বিষয় যদি হয় `মেন্টাল ওয়েলনেস` এর, তবে কয়েকটি বিষয় আমাকে ভাবালো। ডিপ্রেশন তথা মানসিক অবসাদের বিষয় নিয়ে অনেকেই সচেতন। কিন্তু কেউ কেউ বলছেন, ডিপ্রেশন আছে মানেই তো সে `পাগল` নয়। তাই লুকিয়ে না রেখে কাউকে না কাউকে বলাটা দরকার, সে হোক কোনও চিকিৎসক কিংবা বন্ধু। যেন ডিপ্রেশন অবধি ব্যাপারটা এক্সকিউজেবল কিন্তু `পাগল` হলে আর নয়।

আচ্ছা এই `পাগল` হওয়া ব্যাপারটা আসলে কি? ওই যে সেই লোকগুলো যারা আপন মনে বকবক করতে করতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়? মাথার চুলে জট? গায়ে অনেক সময়েই জামাকাপড় থাকেনা? প্রায় অর্ধোলঙ্গ? কিছু বললেই বড় বড় নখ নিয়ে তেড়ে আসে? দেখেই মনে হয়, অনেক দিন স্নান করেনি? ডিপ্রেশনের ওপর মানুষের সামান্য যেটুকু বা নিয়ন্ত্রণ থাকে, এদের তো নিজেদের ওপর তাও নেই। এরা তো ডিপ্রেশনের থেকেও জটিল মানসিক অসুখের শিকার, হতেও বা পারে স্কিৎজোফ্রেনিয়া! শরীরে আলসার হলে যেমন চিকিৎসা হয়, ক্যানসারেরও তো হয়। তেমনি এই তথাকথিত `পাগল`গুলোও তো চিকিৎসাই দাবি করে, যেমন দাবি করে ডিপ্রেশন। কারণ অসুখ মাত্রই কারোরই তো ইচ্ছাধীন নয়!

বেশ কিছু বছর আগে অবধিও শুনেছি স্কিৎজোফ্রেনিয়ার তেমন কোনও চিকিৎসা ছিল না (এখন আছে, ওষুধে সুস্থ হয়)। ফলত বাড়ির লোকের হলে হয় তাকে রাখা হতো পরিবারেই অথবা বাড়ির থেকে দূরে অ্যাসাইলামে, যাকে আমরা তাচ্ছিল্যের সাথেই বলে থাকি `পাগলা গারদ`। এই `পাগল গারদ` ব্যাপারটা কি? অর্থাৎ যে সমস্ত মানুষ স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা আরও কোনও জটিল মানসিক অসুখে ভুগছেন, যাদের পরিবারের মধ্যে রেখে চিকিৎসা করার মতো পরিস্থিতি নেই, তাদের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে দূরে কোনও হোমে রেখে চিকিৎসা করা। কিন্তু আমাদের রাজ্যে মেন্টাল অ্যাসাইলামগুলোর কি পরিস্থিতি তা আমাদের অবগতির বাইরে নেই। জটিল মানসিক অসুখে ভোগা এই ছাপ্পা আঁটা `পাগল`রা পরিবার ও পরিবারের বাইরের মানুষদের দ্বারা কী ভয়ানক অবহেলা ও অত্যাচারের শিকার হন তাও আমার জানা।

অথচ এই মানুষগুলোর তো কোনও দোষ নেই। দোষ শুধু এটুকুই যে, এরা বিস্মৃত হন এদের পরিচয় কি, দৈনিক কর্তব্যগুলো কি কি। একটা অদ্ভুত ফিকশনাল দুনিয়ায় বাস করতে করতে এরা ভুলে যান সত্যাসত্যের ফারাক। এরা পাগল, শেয়ানা পাগল নন। রেগেমেগে মানুষকে আঘাত করে দিতে হয়তো এরা পারেন, কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় কারো পিঠপিছে ছুরি গেঁথে দিতে পারেন কি এরা? পারেন কালো বলে কোনও মানুষকে খুন করে দিতে? কিংবা দেশে দেশে যুদ্ধ বাঁধাতে?

শুনেছি আধুনিক মনোবিজ্ঞানের গবেষণা অনুযায়ী, সব মানুষের মধ্যে স্কিৎজোফ্রেনিয়া আছে, মাত্রাভেদে তা সামান্য। কাজেই শেষ অবধি যা দাঁড়ালো গিয়ে, কেউ কেউ পাগল নয়, আসলে সকলেই পাগল!

দুই.
নাহ্, আপনার চেনা পরিচিত যে কেউ হঠাৎ যদি শোনেন আত্মহত্যা করেছেন, অবাক হবেন না। অবাক হওয়ার কি আছে? মানুষ ভালো নেই। মানুষ ভালো থাকতে চেয়েও সব সময় পারে না। নিজের খারাপ থাকার ওজন শেষ অবধি বয়ে বেড়ানো সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। অবসাদ একটা দীর্ঘ মেয়াদি অবস্থা। দিন দিন প্রতিদিন সেটার সাথে লড়তে হয়। আমাদের চেনা পরিচিত বৃত্তের মধ্যে এমন অনেক মানুষই আছেন, যাদের আমরা সস্তার লেকচার দিয়ে ক্ষান্ত হই। ভালো থাকাটা আসলেই একেবারে অন্তর্জগতের ব্যাপার। কে কত রোজগার করে, কে কত সফল, কে কত বিখ্যাত, কার কত ফ্যান ফলোয়ার— সত্যিই এসব দিয়ে নির্ধারিত হয় না।

প্রতিটা মানুষই তো ভালো থাকতে চায়। আর ভালো থাকতে গিয়ে সে একটা কনসেপ্টের পিছনে ছোটে। এ যেন মরীচিকার মতো। তৃষ্ণা কিছুতে মেটে না। কেবলই এসে পড়ে তুল্য মূল্য বিচার। ডিপ্রেশন কখন যে কিভাবে মানুষের অন্তর্জগতে থাবা দেয় তা কেই বা জানে। ভালো থাকার উৎসেচকটি আর তৈরি হয় না মগজে। ডিপ ডিপ্রশনে কেবল ভালো লাগে অন্ধকার, মৃত্যুর সাথে সখ্য পাতাতে ইচ্ছে হয়। দরকার হয় ক্লিনিক্যাল ট্রিটমেন্ট। সেলিব্রিটি হলে তার ডিপ্রেশন থাকবে না, এটা কে বললো? জীবনের যে দৌড় তার যে সাফল্য চাকচিক্য এ সবই তো বাইরের, যারা গ্যালারির বাইরে থেকে হাততালি দেয় তাদের জন্য। আসল সত্য হলো, লড়াই যা প্রতিটা মানুষ লড়ছে। লড়তে লড়তে ছিটকে যাচ্ছে, যেতে পারি আমরা, এই আমি আপনি কিংবা আমাদের যে কেউ।

মানুষের ভেতরটা যদি সত্যি দেখা যেত! তবে অনেক সফল মানুষের জন্যই আপনার করুণা হতো। আত্মহত্যা করে তাঁকে প্রমাণ করে যেতে হতো না যে, সে ভালো ছিল না... ছিল না... ছিল না...

তিন.
আমাদের এই মফস্বলে `নান্টুর মা` বলে সত্যিই কেউ ছিল কিনা কে জানে! তবে যেই হন না কেন, প্রবাদে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। ছেলেবেলায় দেখেছি, পাড়া প্রতিবেশী কেউ যদি বাতিক করত, মানে শুচিবাই, ঘনঘন হাত পা ধোয়া খালি খালি সাবান কাচা, সে হয়ে যেত `নান্টুর মা`! দূর থেকে দেখলেই পাড়ার মিচকে শয়তান টিপ্পনী কেটে পালাতো, ওই দ্যাখ নান্টুর মা!

বিষয়টা মজা করার মতো নয়। মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ধরনের বাতিককে বলা হয়, `অবসেসিভ কমপালভিস ডিসঅর্ডার`। আমার ধারণা, মনের ভেতর দীর্ঘদিন কোনও অস্বস্তি গিল্ট বা ভয়ের ভার বহন করতে করতেই মানুষ এই ধরনের কমপালশন বা বাতিকের শিকার হয়ে পড়ে। বারবার ধুয়ে সে নিষ্কাশন করে ফেলতে চায় ময়লাই কেবল নয়, কোনও এক অদৃশ্য শত্রুকে। মনে আছে শেক্সপিয়ারের `ম্যাকবেথ` নাটকের সেই করুণ দৃশ্য, যেখানে লেডি ম্যাকবেথ বলছেন, অল দ্য পারফিউমস অফ অ্যারাবিয়া উইল নট সুইটেন দিজ লিটল হ্যান্ড।

সে তো তার পাপী অধিশাস্তাকেকে নির্মল করার প্রয়াসেই। অথচ আমাদের সমাজে যে কোনও মানসিক সমস্যাকে নিয়েই মানুষ উপহাস করতে ছাড়ে না। ভুলে যায় ক্রমাগত উপহাস করে আনন্দ পাওয়াও একটা মানসিক অসুখ, একধরনের স্যাডিজম। এইবার যে এখন প্রাণ বাঁচাতে ঘনঘন হাত ধুতে স্নান করতে জামা কাপড় কাচতে বলা হচ্ছে আমাদের, তা ওই করোনারূপী ভাইরাসকে ধুয়ে সিস্টেম থেকে বের করে দেয়ার জন্য । এও তো একটা ভয়, শুধু যে ভয়ের কারণ বাস্তব সুচিহ্নিত ও সুনির্দিষ্ট। কিন্তু এই ভয়ের কারণটাই যদি মনের ভেতর প্রথিত হয়, মৃত্যুভয় নির্মূল হয়ে যাওয়ার পরও যদি মনের ভেতর চলতে থাকে ছায়াযুদ্ধ, কাল্পনিক শত্রুকে পরাস্ত করার জন্য বারবার হাত ধোয়া যদি অনিবার্য মনে হয়, তখন সেই কি হবে উপহাসের পাত্র?

যে কোনও মনোবৈজ্ঞানিক সত্য আসলে একটি কনস্ট্রাকশন। করোনা মৃত্যুর পাশাপাশি সভ্যতাকে আরো একটা জিনিস উপহার দিয়ে যাবে, সে হলো, ভয়। অক্টোপাসের মতোই যার অনেক হাত। চলবে