হেগেল
চিন্তা কিভাবে করতে হয়, হেগেল তা শিখিয়ে গেছেন
মিনহাজুল ইসলামপ্রকাশিত : আগস্ট ২৭, ২০২০
ইতালিয়ান দার্শনিক ও চিন্তাবিদ বেনেদিত্তো ক্রোচের আত্মজীবনী পড়েছিলাম। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এবং সাজানো গোছানো আত্মজীবনী। মনে হয়েছিল যে, আত্মজীবনী নয় বরং সেটা কোনও খাঁটি দর্শনের কিতাব। ১২০ পৃষ্ঠার আত্মজীবনীতে বেনেদিত্তো ক্রোচে একজন দার্শনিকের নাম বারবার টেনেছেন, তিনি হলেন জর্জ উইলহেম ফ্রেডরিক হেগেল। ক্রোচের লেখা আমি খুবই কম পড়েছি, কম বলতে আত্মজীবনী ছাড়াও আরও দুই তিনটা বই পড়েছি। পড়ে বুঝেছিলাম যে, এই লোক দর্শন রচনা করতে যতটা না চেষ্টা করেছেন, তার চেয়ে বেশি দর্শনের ইতিহাস ও দার্শনিকদের তত্ত্ব কাটাছেঁড়া করতে বেশি ওস্তাদ। এক কথায় বেনেদিত্তো ক্রোচের মতো সমালোচক গত পাঁচশো বছরে দুই তিনজন ছিল কিনা সন্দেহ।
প্লাতোন আরিস্ততল কান্ট থেকে শুরু করে হেগেল মার্কস কেউ রেহাই পাননি তার হাত থেকে। প্রত্যেক দার্শনিকের দর্শনের গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন। কয়েকজনকে তো খারিজই করে দিয়েছেন। মোদ্দা কথা, তার মূল্যায়নের মাপকাঠি খুবই কঠোর এবং ক্রিটিকাল। চিন্তার জগতে কাউকে ছাড় দেন নাই। কিন্তু এই নাক সিটকানো দার্শনিক পর্যন্ত একজনের নাম আজীবন জপেছেন, যদিও সমালোচনা করেছেন ব্যাপক, তারপরও সে বারবার হেগেলের নাম নিয়েছেন তার বিভিন্ন লেখায়। বলাই বাহুল্য, সে হেগেলের স্ট্রং ক্রিটিক করেও হেগেলকে ছাড়তে পারেননি। কারণ ক্রোচে হেগেলের পা দেখেছিলেন হাত দেখেননি, কিংবা হাত দেখলে ও চোখ দেখেননি, চোখ দেখলেও নাক দেখেননি।
হেগেলিয়ান যে এবসলুট আইডিয়ালিস্টিক ধারণা থেকে বের হওয়ার জন্য আজীবন চেষ্টা চালিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত পারসেপশন এবং ইন্দ্রিয়গত আধ্যাত্মিকতার উপর ছেড়ে দিয়েছেন, তাও হেগেলের থেকেও বের হয়ে নয়। ক্রোচের মূল্যায়ন খুবই কঠোর। সেই কঠোর মূল্যায়নের মাপকাঠিতেই সে হেগেল সম্পর্কে বলেছিলেন যে, হেগেলই একমাত্র দার্শনিক যে দর্শন চর্চা করার একটা পদ্ধতি বের করেছেন। তারচেয়েও বড় বিষয় হলো, হেগেল চিন্তার যে একটা প্যাটার্ন আছে, পদ্ধতি আছে, লাইনআপ আছে সেটা আবিষ্কার করেছেন এবং চিন্তা করার একটা মেথড বের করেছেন। পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান চর্চা করার জন্য যেমন সুনির্দিষ্ট কিছু মেথড, সিস্টেম রয়েছে হেগেল দর্শনের ও সেরকম কিছু পদ্ধতি, সিস্টেম তৈরি করেছিলেন। এটা হেগেলের দর্শন ও দর্শনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অবদান, যা তাকে আরিস্ততল কিংবা প্লাতোনের পর্যায়ে অর্থাৎ ক্লাসিকাল দার্শনিকদের কাতারে ফেলে।
এইরকম মূল্যায়ন ছিল ক্রোচের মতো একজন জাত ক্রিটিকের হেগেলের প্রতি। জার্মান দার্শনিক হেগেল সম্পর্কে আমার ধারণা এবং জ্ঞান খুবই স্বল্প এবং নিম্নমানের। হেগেলের লেখাও আমি খুবই কম পড়েছি। তবে যতটুক পড়েছি ততটুকুর ভিত্তিতে বলা যায় যে, দর্শনের ইতিহাসে একটা নতুন স্টেশন এবং প্লাটফর্ম হেগেল দিয়েছেন, একটা নতুন যুগের জন্ম দিয়েছেন, যে যুগ কখনও শেষ হবে কিনা জানি না। মানুষ প্লাতোন, আরিস্ততলের নাম নেয়ার সাথে হেগেলের নামটাও যে নিবে, সেই রকম কর্ম হেগেল করে গেছেন। হেগেলের প্রতি এর থেকে বেশি কথা বলার মতো পাণ্ডিত্য আমার নাই। আমার মতে, হেগেল চিন্তা কিভাবে করতে হয় তা শিখিয়ে গেছেন। অন্তত আমি মনে করি।
দার্শনিক ক্রিটিকাল চিন্তা কিভাবে করতে হয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হেগেল। এদেশের অনেকেই বলেন যে, হেগেল খুবই দুর্বোধ্য, পড়া যায় না, বোঝা খুবই কঠিন। তাদের প্রতি আমার আকুল আবেদন যে, তাদের দর্শন পড়া ছেড়ে দিয়ে নিয়মিত সাইন্স ফিকশন ও কৌতুক-ধাঁধার বই পড়া উচিত। কারণ হেগেল একটা চর্চার বিষয়, কোনও ভাষা না যে ছয় মাসের কোর্স করে শিখে ফেলা যাবে। মার্কসের মতো চিন্তাবিদের একটা দীর্ঘ সময় লেগেছে হেগেলের দর্শন বুঝতে। অথচ মার্কস নিজেই হেগেল যে জ্ঞান তাত্ত্বিক ট্রাডিশন ও সংস্কৃতির (জার্মান আইডিয়ালিজম), মার্কস সেটারই প্রোডাক্ট। আর হেগেলের দর্শন সব ঘরানার লোকজনদের জন্য পড়া জরুরি আমি মনে করি। যেরকমটা প্লাতোন কিংবা আরিস্ততলের বই পড়া উচিত।
আমাদের সমাজে অনেক নীটশেবাদীকে দেখি এনলাইটেনমেন্টের ক্রিটিক করে। কিন্তু এনলাইটেনমেন্ট কি জিজ্ঞেস করলে তোতলায়। আরও কিছু ঘরানার লোকজন আছে যারা ইউরোপীয় দর্শন ও দার্শনিকদের নাম শুনলেই নাক সিটকায়, আমার তাদের প্রতি করুণা। ইউরোপীয় চিন্তা, চিন্তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিয়ে ফেসবুকে অনেক চিন্তাবিদকে দেখি লেখালেখি করতে, হাসি পায়। বাপের জন্মেও যদি ইউরোপীয় কোনও চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের লেখা পড়ে থাকতো এরা! আমি বলছি না যে, ইউরোপীয় দার্শনিকদের লেখা পড়া ফরয, কিন্তু সেই ভূখণ্ড ও সংস্কৃতি নিয়ে ক্রিটিক এবং আলোচনা করতে হলে অবশ্যই চার পাঁচটে সেখানকার লোকেদের কিতাব পড়া অত্যাবশ্যকীয়। আবার অনেক আলেম আছেন যারা ইউরোপীয় ইতিহাস ও দর্শনে অসাধারণ পাণ্ডিত্য রাখেন, এবং সেই সকল জ্ঞানের আলোকে ইউরোপের ইতিহাস আলোচনা করেন, তাদেরকেও আজকাল দেখি ফেসবুকীয় আলেম রা সুবিধাবাদী, ইজরায়েলের দালাল, কাফির, স্বল্প জ্ঞান সম্পন্ন এরকম ট্যাগ দিতে।
আমি আসলে খুবই কম জানি এবং কম বুঝি। কিন্তু এই ফেসবুকীয় আলেম ও চিন্তাবিদদের দেখলে এবং এদের লেখা পড়লে মনে হয় যে, আমি এক ফোঁটা হলেও তো জানি। এরা তো তাও জানে না। হেগেল একটা স্টাডির বিষয়। বর্তমান সময়ের অনেক অনেক বিখ্যাত, কুখ্যাত, ডমিনেন্ট চিন্তা ভাবনার গোড়াটা হেগেলের কিতাবে পাওয়া যায়। আর হেগেল তার দর্শনের মতোই হোলিস্টিকালি চিন্তা করেছেন, সব বিষয় নিয়ে লিখেছেন, চিন্তা করেছেন। ইউনিভার্সালিটি আছে তার চিন্তায়। পার্টিকুলারিটি তার চিন্তায় নেই বললেই চলে। কারণ পার্টিকুলার অ্যাজ এ পার্টিকুলার হতে পারে না, পার্টিকুলারকে বুঝতে হলো টোটালিটিকে বুঝতে হবে, ইউনিভার্সালিটিকে বুঝতে হবে। হেগেল আজকে বেঁচে থাকলে তার বয়স ২৫০ বছর হইতো!
























