
দার্শনিক রেনে দেকার্ত
জগলুল আসাদের প্রবন্ধ ‘করোনামলের দার্শনিকতা’
পর্ব ৩
প্রকাশিত : জুন ০৭, ২০২০
Discourse on Method (1641) এর ‘আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি’ দেকার্তের এই বাক্য পশ্চিমা দর্শনের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত বাক্যসমূহের একটি। দেকার্ত জ্ঞানের নিশ্চয়তা সম্বন্ধে ভাবতে যেয়ে দেখলেন, সব কিছুকেই সন্দেহ করা যায়। তিনি খুঁজলেন এমন কিছু, যা সন্দেহাতীত। তো তিনি ভেবে দেখলেন, এই যে আমি সন্দেহ করছি আর ভাবছি, এইটা সন্দেহাতীত। সব কিছুকেই সন্দেহ করা যায়, কিন্তু যে সন্দেহ করার কাজটা করছে, যে চিন্তা করছে তার অস্তিত্বকে সন্দেহ করা যায় না। আমি যে চিন্তা করছি, এইটাই আমার অস্তিত্বের প্রমাণ। কজিটো আরগো সাম। আই থিংক, দেয়ারফোর, আই এম। এইটা এক সন্দেহাতীত ব্যাপার। সত্যের নিশ্চয়তা লাভে ইন্দ্রিয় ও কল্পনার ভূমিকাকে প্রত্যাখ্যান করলেন দেকার্ত।
হিউম্যানিস্ট চিন্তায় ডেকার্তের অবদান তুচ্ছ করবার মতো নয়। দেকার্তের বেশ কিছু অনুমানকে পরবর্তী কালের দার্শনিকরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। যে আমি ও চিন্তা থেকে তিনি তার চিন্তা শুরু করলেন, সেটি যেন অটোনোমাস, স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত। এই আমির গঠনে, এই আমির চিন্তায় যে বাহ্যপৃথিবী, সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব, তা নজর এড়ায় দেকার্তের। চিন্তার ভেতরেই দেকার্ত দেখেন তার অস্তিত্বের প্রমাণ। আমার চিন্তার উপর আমার নিয়ন্ত্রণ আছে বলে এক ধরনের সার্বভৌম ‘আমি`র ধারণা দেকার্তেতে আছে। যেন আমার ইচ্ছে আমার চিন্তার উপর বিজয়ী, আমার চিন্তা আমারই চিন্তামাত্র। পরবর্তীকালে, ফ্রয়েডের `আবিষ্কার` ও ‘অচেতন’ আমাদের জানালো যে, আমি আছি আমার ‘অচেতনে’, আমি আমার চেতনে থাকি যত তারও বহুবেশি থাকি ‘অবচেতনে’।
মার্ক্স এসে `আমি`র আমাকে চিহ্নিত করলেন আমার ‘শ্রমিকতায়’। আবার সাপির-হোর্ফ হাইপোথিসিসে (Sapir-Whorf Hypothesis) আমরা জানলাম আমি বা আমরা ভাষার অধীন, ভাষাই আমাদের ভেতর দিয়ে কথা বলে, ভাষা আমাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করে নানা মাত্রায়। সুতরাং আমির চিন্তার যে সার্বভৌমত্ব তা বিষর্জিত হতে থাকলো। চিন্তা যে শর্তায়িত, চিন্তার সাথে যে ইতিহাস, সমাজ আর সংস্কৃতির যোগ আছে তার প্রতি নজর এড়িয়ে যায় দেকার্তের।
তবে চিন্তার পদ্ধতিগত দিক হিশেবে কার্তেজীয় পদ্ধতি এখনো কম ক্ষমতাশালী নয়। কার্তেজীয় চিন্তা জগতকে ভাগ করে ফেলে জ্ঞাতা (Knower) আর জ্ঞেয়তে (Knowable)। অর্থাৎ যে জানে আর যা জানা হয়, তা আলাদা। এই ডিভাইড (ভাগ) সম্প্রসারিত হয় দেহ-আত্মা,প্রকৃতি-সংস্কৃতি, নিজ-অপর, মানুষ-প্রকৃতি এমন আরো নানা যুগ্ম বৈপরীত্যে (বাইনারি)। এমনকি জা পল সার্ত্রের Existence precedes essence এই আপ্তকথাতেও অস্তিত্ব ও সারসত্ত্বার পৃথকতা উপস্থাপিত হয়। এইভাবে বাইনারি করে ভাবা চিন্তার জগতে বহু সংকটের জন্ম দেয়।
মানুষ যখন প্রকৃতিকে আলাদা ও অপর ভেবে তার উপর প্রভুত্ব করতে গেল বিশ্বে তখন সৃষ্টি হলো নানা বিপর্যয়। "নিজ’ এর প্রয়োজনে "প্রকৃতি"কে ধ্বংস করা শুরু করলো। নির্বিচারে পাহাড় কাটা ও বন উজার করা শুরু করলো। ফলাফল হিশেবে কোরানিক দর্শন অনুযায়ী, সে যে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলো তা তার ‘দুই হাতের কামাই’। পরিবেশ ধ্বংস করে ও বন উজার করার ফলে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে মানুষ ও প্রাণীর ঝুঁকিপূর্ণ নৈকট্য যা রোগবালাই সংক্রমণের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। প্রকৃতিকে প্রতিপালন ও সৃষ্টির সেবা বা খিদমতে খালকের দায়িত্বকে ভুলে গিয়ে মানুষ যখন প্রকৃতির উপর ভোগবাদী আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করলো তখনি নেমে আসলো আযাব, বিপর্যয়।
প্রাণীর সাথে যৌনক্রিয়ার বিকৃতিও আছে। উদ্ভিদ, প্রাণী, আলো-হাওয়া-পানিসহ মহাবিশ্বের বিবিধ জানা ও অজানা বস্তু বা প্রাণকণারাজি মানুষের বেঁচে থাকার সহায়ক করে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই তো মানুষ সৃজনের বহু বহু আগে মানবের আগমনের প্রেক্ষিত দিয়ে জগত ও মহাবিশ্বকে সাজানো হয়েছে। সুতরাং জগতের সব সৃষ্টির সাথে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে মানুষ সম্পর্কিত। প্রকৃতির যত্ন মানবসত্তার যত্নের অংশ। নবিজী (সাঃ) কেয়ামতের আগেও কারো হাতে যদি একটা চারাগাছ থাকে তাকে রোপণের কথা বলেছেন। প্রবাহিত পানিতে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন। বাক্শক্তিহীন প্রাণীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করতে বলেছেন। (আবু দাউদ)। রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে প্রাণীদের অঙ্গচ্ছেদ করে। (বুখারি)। ফকিহরা বলেন, পিঁপড়া দংশন না করলে তাদের মেরে ফেলা মাকরুহ। পিঁপড়েদের পানিতে নিক্ষেপ করা সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। প্রাণীর পিছু নেয়া, শিকারের বিলাসিতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু বানিও না।’ (মুসলিম)। রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে কোনো প্রাণবিশিষ্ট বস্তুকে লক্ষ্যবস্তু বানায়। হিংস্র জন্তু ও নখরবিশিষ্ট পাখিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করাকে হারাম করা হয়েছে। বোখারির হাদিসে এসেছে, তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর ফলে এক নারী জান্নাতী হয়েছে। বিড়ালকে বেঁধে রেখে না খেতে দিয়ে কষ্ট দেয়ায় একজনের জাহান্নামী হওয়ার কথাও এসেছে বুখারির হাদিসে। শাদ্দাদ ইবনু আওস (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে আমি দুটি কথা মনে রেখেছি। তিনি বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের উপর ‘ইহসান’ অত্যাবশ্যক করেছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে, দয়ার্দ্রতার সঙ্গে হত্যা করবে; আর যখন যবেহ করবে তখন দয়ার সঙ্গে যবেহ করবে। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং তার যবেহকৃত জন্তুকে কষ্টে না ফেলে।
সুরা বাকারার যে আয়াতে (৩০ নম্বর আয়াত) আল্লাহতায়ালা খলিফা সৃষ্টির কথা বলেছেন, সেখানে "রব" শব্দ দিয়ে শুরু করা হয়েছে, "তোমার "রব" যখন ফেরেশতাদিগকে বললেন, আমি পৃথিবীতে "খলিফা" বানাতে যাচ্ছি...."। আবুল হাশিম তাঁর The creed of Islam বইয়ে কুরানিক এই নিগুঢ়তম ভাষা ব্যবহারের অন্যতম এই তাৎপর্য উদঘাটন করেন যে, মানষ "রবুবিয়াত"-এর খলিফা, অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে জগতকে প্রতিপালন ও রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্ব মানব-প্রজন্মকে দেওয়া হয়েছে। সুরা ফাতিহার প্রথম দুই আয়াত থেকে উলামাগণ বোঝান যে, আল্লাহর রহমত তাঁর রবুবিয়াতের ভিত্তি। সেই হিসেবে, জগতকে আমাদের অপর না ভেবে আমাদের মতোই মাখলুক ভেবে তাঁকে ব্যবহার ও হেফাজতের দায়িত্ব আমাদের। অথচ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন ও কনজাম্পশনের নামে আমাদের চোখের অলক্ষে কেএফসি বা ডেইরি প্রতিষ্ঠান, পশুজ চামরার প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রাণীর উপর প্রতিদিন যে নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা চালানো হয়, তাতে আমাদের উপর প্রাণীবাহিত বিপর্যয় আপতিত হওয়াই স্বাভাবিক।
আজ যে Zoonotic disease এর কথা বলা হচ্ছে, সার্স করোনা ভাইরাস যা প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে আগত, তা মানুষের ভোগবাদী ও গাফিল জীবনযাপনের ফল নিসন্দেহে। Laboratory Life খ্যাত ব্রুনো লাতুরের Actor Network Theory (ANT) বলে একটা থিওরি আছে যেখানে প্রাণী ও বস্তুজগতের সবকিছুকেই Actant বলা হচ্ছে। অর্থাৎ জড়বস্তু ও প্রাণী সবকিছুরই এজেন্সি (কর্তাসত্তা) আছে, সবাই সবাইকে বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত করতে সক্ষম। প্রাণী যেমন মানুষকে, মানুষও তেমন প্রাণীকে পারে।
কুরানিক দর্শন মতে, মহাজগত ও নানামাত্রিক জগতসমূহ একটা সিস্টেম মেনে চলে, একক ও অদ্বিতীয় স্রষ্টার "হুকুম" ও হুদুদ (সীমা) সর্বত্র প্রতিপালিত হয়। ইসলাম নির্দেশিত প্রতিটি ভালো কাজই মহাবিশ্বের ওই শৃঙখলার অনুগামী ব`লে জগতব্যাপী ভারসাম্য বজায় থাকে। এমনকি, সালাতেরও কসমিক তাৎপর্য রয়েছে। আমরা যখন সালাতে আনত হই, তখন আসলে মহাবিশ্ব যে-আনুগত্যে নতজানু থাকে, আমরাও সেই আনুগত্য বা আব্দিয়াতের সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাই। আমাদের প্রতিটি পাপ, অন্যায় কর্ম, অবিবেচকের মতো ভোগ-ব্যবহার, অযাচার-অনাচারগুলো শারীরিক-সমাজিক-আত্মিক-আধ্যাত্মিক ও সর্বোপরি মহাজাগতিক শৃঙ্খলার বিপরীতে চলে যায়, ফলে বিপর্যয় ও দুর্যোগের আযাবে হাবুডুবু খাই আমরা। এই জন্যেই কিয়ামত আসবে তখন, যখন জগতে আর কোন মুমিন থাকবেনা। ইমান ও আমালে সালিহ (Righteous deeds) জগত টিকে থাকার শর্ত। আল্লাহভীতি ও সৎকর্মের মধ্য দিয়ে সৃষ্টজগতের সাথে অভিন্ন থাকাতেই মুক্তি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক