জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধা গোবিন্দ চন্দ্রর আজ জন্মদিন

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জুলাই ১৬, ২০২৫

জ্যোতির্বিজ্ঞান রাধা গোবিন্দ চন্দ্রর আজ জন্মদিন। ১৮৭৮ সালের ১৬ জুলাই অবিভক্ত বাংলার যশোর সদর উপজেলার বকচর গ্রামে তার জন্ম। বাবা গোরাচাঁদ স্থানীয় চিকিৎসকের সহকারী ছিলেন। মা পদ্মামুখ ছিলেন গৃহিণী।

বকচর পাঠশালায় অধ্যয়ন শেষে রাধাগোবিন্দ যশোর জিলা স্কুলে পড়াশোনা করেন। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিল না। বরং রাতের আকাশের প্রতি আকর্ষণ ছিল বেশি। পড়াশোনায় অমনোযোগের কারণে তিনবার তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও উত্তীর্ণ হতে পারেননি।

১৮৯৯ সালে ২১ বছর বয়সে মুর্শিদাবাদের গোবিন্দ মোহিনীকে তিনি বিয়ে করেন। মোহিনীর বয়স ছিল ৯ বছর। বিয়ের পর রাধাগোবিন্দ শেষবারের মতো প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিলেও অকৃতকার্য হন। বারবার অকৃতকার্য হয়ে তিনি পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন।

ছোটকাল থেকেই রাধা আকাশের তারা সম্বন্ধে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তার পাঠ্যবই ছিল চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ। এই গ্রন্থে অক্ষয়কুমার দত্ত রচিত প্রবন্ধ ছিল ‘ব্রহ্মাণ্ড কি প্রকাণ্ড’। এই প্রবন্ধ পড়ে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।

আত্মজীবনীতে রাধা গোবিন্দ লিখেছেন, ‘অক্ষয়কুমার দত্তের চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ পড়িয়া নক্ষত্রবিদ হইবার জন্যে আর কাহারো বাসনা ফলবর্তী হইয়াছিল কিনা জানি না, আমার হইয়াছিল। সেই উদ্দাম ও উচ্ছৃঙ্খল বাসনার গতিরোধ করিতে আমি চেষ্টা করি নাই।’

১০ বছর বয়সে যশোর জিলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি তিনি তারা দেখা শুরু করেন। বকচরের একতলা বাড়ির ছাদ থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি আকাশ দেখতেন। কিন্তু উপযুক্ত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক শিক্ষা না থাকায় প্রথমদিকে তিনি বেশ সমস্যায় পড়েন।

১৪ বছর বয়সে তিনি আকাশের তারা চেনার ব্যাপারে সিদ্ধ হয়ে ওঠেন। এই সময় যশোর শহরের উকিল কালীনাথ মুখোপাধ্যায় তাকে সহায়তা করেন। পড়াশোনা শেষ করার পর প্রথম দুই বছর তাকে বেকার জীবন কাটাতে হয়। এরপর যশোর কালেকটরেট অফিসে খাজাঞ্চির চাকরি পান।

এসময় তার মাসিক বেতন ছিল মাত্র ১৫ টাকা। এ থেকে পরে তিনি ট্রেজারি ক্লার্ক ও কোষাধ্যক্ষের পদে প্রমোশন পান। অবসর নেবার সময় তার মাসিক বেতন ছিল ১৭৫ টাকা। ১৯১০ সালে হ্যালির ধূমকেতু আকাশে আবির্ভূত হয়। প্রথমে খালি চোখে ও পরে একটি বাইনোকুলার দিয়ে রাধাগোবিন্দ তার পর্যবেক্ষণ লিখে রাখলেন।

পরে এই নিয়ে লিখলেন একাধিক প্রবন্ধ। তার এই প্রবন্ধ হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। শান্তিনিকেতনের বিজ্ঞান শিক্ষক জগদানন্দ রায় তাকে দূরবীন কেনার পরামর্শ দেন। ১৯১২ সালের দিকে রাধাগোবিন্দ তার বেতনের টাকা ও খানিকটা জমি বিক্রির টাকা দিয়ে দূরবীন সংগ্রহ করেন। এটি ৩ ইঞ্চি ব্যাসের প্রতিসরণ দূরবীন ছিল।

১৯১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দূরবীনটি ইংল্যান্ডের F. Bernard থেকে মেসার্স কক্স সিপিং এজেন্সি লিমিটেডের মাধ্যমে রাগাগোবিন্দের কাছে আসে। রাধাগোবিন্দকে খুব হিসাব করে চলতে হতো। সাংসারিক খরচের দায়িত্ব থেকে আকাশচর্চায় যা ব্যয় হতো তা তিনি লিখে রাখতেন।

দূরবিীটির দাম পড়েছিল ১৬০টাকা ১০ আনা ৬ পাই। এই হিসাবটি তার খাতায় লেখা ছিল। প্রথমে মূল দূরবীনটির টিউব ছিল কার্ডবোর্ডের তৈরি। পরে তিনি আরও ৯৬ টাকা ১০ আনা খরচ করে ইংল্যান্ডের মেসার্স ব্রহহার্স্ট অ্যান্ড ক্লার্কসন থেকে পিতলের টিউব আনিয়ে নেন এবং দূরবীনটির উন্নতি সাধন করেন।

রাধাগোবিন্দ নথিপত্রে লিখে গেছেন, ‘সন ১৩১৯ সালের আশ্বিন মাসে দুরবীন আসার পরে চন্দ্রের নক্ষত্রবিদ্যা অনুশীলনের ৪র্থ পর্ব আরম্ভ হয়। এই সময়ে আমি কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভূগোলচিত্রম’ ও ‘তারা’ পুস্তকের সাহায্যে এটা-ওটা করিয়া যুগল নক্ষত্র, নক্ষত্র-পুঞ্চ নীহারিকা, শনি, মঙ্গল প্রভৃতি গ্রহ দেখিতেন।

পরে জগদানন্দ রায়ের উপদেশ মতো স্টার অ্যাটলাস ও ওয়েব’স সিলেসিয়াল অবজেক্ট ক্রয় করিয়া যথারীতি গগন পর্যবেক্ষণ করিতে আরম্ভ করি। কিন্তু ইহাতেও আমার কার্য বেশিদূর অগ্রসর হয় নাই। তবে এই সময়ে আমি গগনের সমস্তরাশি নক্ষত্র ও যাবতীয় তারা চিনিয়া লইয়াছিলাম এবং কোন নির্দিষ্ট তারায় দূরবীন স্থাপনা করিতে পারতাম।’

১৯১৮ সালের ৭ জুন রাধা গোবিন্দ আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখতে পেলেন যা তার নক্ষত্রের মানচিত্রে ছিল না। তিনি তার এই পর্যবেক্ষণের কথা হাভার্ড মানমন্দিরে জানান এবং এভাবেই নোভা অ্যাকুইলা-৩ ১৯১৮ আবিস্কৃত হয়। পরে তাকে আমেরিকান এসোসিয়েসন অফ ভেরিয়েবল স্টার অবজারভার American Association of Variable Star Observers (AAVSO)) সম্মানসূচক সদস্যপদ প্রদান করে।

১৯১৯ থেকে ১৯৫৪ এর মধ্যে তিনি ৩৭২১৫টি পরিবর্তনশীল নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন এবং এসব তথ্য আভসোকে প্রদান করেন। তার এই কার্যক্রমের জন্য তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত আভসোর তালিকাভুক্ত হন, যাতে আরও ২৫ জ্যোতির্বিজ্ঞানী যারা ১০,০০০ বেশি পরিবর্তনশীল তারা দেখেছেন।

পূর্ববঙ্গে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটালেও ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের পরে পাকিস্তান ও ভারত সৃষ্টির কিছুকাল পর তিনি ভারতে চলে যান। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে তিনি ১৯৬০ সালে ভারতে যান। এসময় তিনি অবসর জীবনযাপন করছিলেন। যশোরের তৎকালীন জেলা কমিশনার এম.আর. কুদ্দুসসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা তাকে ভারতে চলে যেতে বলেছিলেন।

মার্কিন সরকার তাকে একটি দূরবীন উপহার দিয়েছিল। এছাড়া তিনিও জমি বিক্রি করে একটি দূরবীন কিনেছিলেন। ভারতে যাবার সময় তিনি দূরবীন নিয়ে যান। কিন্তু বেনাপোল বন্দরে কাস্টম্‌স তার দূরবীন জবরদস্ত করে। এরপর ভারতে যেয়ে তিনি আমেরিকা ও ফ্রান্স সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন। যশোরের ডিসি বাড়িতে এসে তার দূরবীন ফেরত দিয়ে যান।

১৯২৬ সালে হার্ভার্ড মানমন্দির থেকে তাকে ছয় ইঞ্চি ব্যাসের দূরবীন পাঠানো হয়। দূরবীনের সঙ্গে হাভার্ড মানমন্দিরের পরিচালক হ্যারলো শ্যাপলির লেখা চিঠি, বিদেশ থেকে পরিবর্তনশীল নক্ষত্র সম্পর্কে আমরা যেসব পর্যবেক্ষণ মূলক তথ্য পেয়ে থাকি তার মধ্যে আপনার দান অন্যতম। আপনাকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।”

ফরাসি সরকার ১৯২৮ সালে পরিবর্তনশীল নক্ষত্রের ওপর তার কাজের জন্য তাকে OARF (Officer d`Academic Republic Francaise) পদক প্রদান করে।

১৯৭৫ সালের এপ্রিল ৩ তারিখে ৯৭ বছর বয়সে একরকম বিনা চিকিৎসায় ভারতের বারাসাতে রাধাগোবিন্দ মারা যান। শেষ বয়সে তার বেশ আর্থিক অনটন দেখা দিয়েছিল।

তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে, ধূমকেতু, সৌরজগৎ, তারা চিনিবার উপায়, নক্ষত্র জগৎ এবং সবিতা ও ধরণী।