ট্রাম্প, হিরো আলম এবং দেশি ডাক্তার
অপূর্ব চৌধুরীপ্রকাশিত : জুন ১৯, ২০২০
ডোনাল্ড ট্রাম্প আমাদের হিরো আলমের চেয়েও কম জানে দুনিয়াকে। আমেরিকান লোকদের জন্যে এ নিয়ে মায়া হয় মাঝে মাঝে। আজ সকালে বিশ্ব জানলো যে, ট্রাম্পের প্রাক্তন সামরিক এডভাইজর জন বোলটন বোম্বা সেল মেরেছে যে, ট্রাম্প নাকি এতদিন জানতো না ইংল্যান্ড একটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার। মজার হলো, গত শতকের সত্তরের দশকে ইংল্যান্ডই রাশিয়া-আমেরিকাকে রাজি করিয়েছিল নন নিউক্লিয়ার চুক্তি করতে।
মাঝে সারা বিশ্ব দেখেছে ট্রাম্প শুধু প্রেসিডেন্ট নয়, বিশ্বের মানুষের দৈনন্দিন বিনোদনের খোরাক! টয়লেট পরিষ্কারের ব্লিচ শরীরে ইঞ্জেকশান করে করোনা ভাইরাস মারতে পরামর্শ দিয়েছিল তিনি। পাশেই বসে ছিল তার স্বাস্থ্য এডভাইজর মহিলা কর্মকর্তা। শুনে মূর্ছা যাবার উপক্রম হয়েছিল। দুই দিন আগে জানলাম, ট্রাম্প দাবি করেছে এইডসের বিরুদ্ধে যেমন করে এইডস ভ্যাকসিন বের করেছে বিজ্ঞানীরা, তেমনি অচিরেই আমেরিকান বিজ্ঞানীরা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন বের করবে। সংবাদ সম্মেলন শেষে ট্রাম্পের হেলথ সচিব প্রেসিডেন্টকে জানালো যে, এইডসের ভ্যাকসিন এখনো কেউ বের করতে পারেনি। এইডসের কোনো ভ্যাকসিন নেই এখনো পর্যন্ত।
মজার হলো, ১৯৮১ সালে এইডসের ভাইরাস HIV আবিষ্কার হওয়ার পরে আজ চল্লিশ বছর হয়ে গেল, অনেকেই জানে না যে, এইডসের কোনো ভ্যাকসিন এখনো পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি বিজ্ঞানীরা। প্রসঙ্গ আসায় মজার কিছু কথা বলি। ধারণা করা হতো, ১৯৮১ সালে বা তার কাছাকাছি সময়ে প্রথম মানুষের শরীরে HIV ঢোকে বা পাওয়া যায়। কিন্তু এটাও সঠিক নয়। ইংল্যান্ডের University of Oxford এবং বেলজিয়ামের University of Leuven যৌথভাবে ২০১৪ সালে কঙ্গোতে এক গবেষণায় দেখতে পান যে, HIV মানুষের শরীরে শিম্পাঞ্জি থেকে ১৯২০ সালের দিকে ঢোকে। কঙ্গো বেলজিয়ামের প্রাক্তন কলোনি ছিল।
যাই হোক, অবশ্য এসব কথা সাধারণ মানুষ জানে না বা জানার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু লাফানোর সময় একেকজন এমন লাফ দেয় মনে হয়, জ্ঞানের চাপে বেশি লাফাতে পারছে না। এমনকি দেশি অনেক ডাক্তারকেও দেখেছি, মেডিক্যাল বিষয়ে বেসিক এত দুর্বল যে, মাঝে মধ্যে শংকিত হই, এরা রোগী মেরে ফেলে নাকি রোগী মেরে ফেলার প্রতিযোগিতা করে। তাদেরকেও দেখেছি, জানে না যে এইডসের ভ্যাকসিন নেই এখনো। ট্রাম্প যেমন করে জানে না ভ্যাকসিন আর মেডিসিনের পার্থক্য, তেমনি দেশি অনেক ডাক্তারকেও আবোল তাবোল বকতে দেখেছি। নামের আসে পাশে ডিগ্রি আর পদবি দেখে লজ্জা পেয়েছি। কয়েকজনকে বিদেশে বসে ফাঁকা বুলি চিবোতে দেখেছি।
না জানা অপরাধ নয়। সবাই সবকিছু এক জীবনে জানতে পারে না। আমিও সব কিছু জানি না। কিন্তু না জেনে দাবি করাটা অনেক বড় মূর্খতা। জানার চেষ্টাটুকুই জ্ঞান। না জানলে জেনে নিলেই হয়। বলতে ভুলে গেছি, এইডসের মেডিসিনের কথা।
প্রথমত: এইডসের কোনো ভ্যাকসিন এখনো পর্যন্ত নেই। বিজ্ঞানীরা এখনো পারেনি কোনো ভ্যাকসিন তৈরি করতে এইডসের বিরুদ্ধে। এইডসের HIV ভাইরাস খুব খতরনাক ভাইরাস। অনেক ভাইরোলজিস্ট ইদানীং বলছে, করোনা ভাইরাসও এমন এক খতরনাক ভাইরাস। খতরনাক এখানে বিপজ্জনক অর্থে। খতরনাকের আরো অর্থ আছে।
দ্বিতীয়ত: এইডসের বিরুদ্ধে কার্যকরী একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞানীরা। এই পদ্ধতিকে বলে PrEP। এটাই এইডসের এখন একমাত্র ভালো চিকিৎসা। ভাঙলে হয় Pre-exposure prophylaxis। সহজ করে বললে হয়, রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগেই চিকিৎসা। এই PrEP পদ্ধতিতে দুটো মেডিসিনের মিশ্রণে শরীরকে HIV ভাইরাস মুক্ত রাখতে অ্যাটাক করা হয়। মেডিসিন দুটো হলো Tenofovir disoproxil এবং Emtricitabine। PrEP পদ্ধতিতে ওষুধ দুটিতে কার্যকারিতা ৯৯%। বলা হয়, ভ্যাকসিনের চেয়েও কার্যকারিতার দিক থেকে শক্তিশালী।
তৃতীয়ত: মেডিসিনগুলো আগে থেকেই ছিল। কিন্তু সেগুলোকে ইফেক্টিভ উপায়ে এইডসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে PrEP পদ্ধতি বুঝতে এবং বের করতে বিজ্ঞানীদের ২০ বছর লেগেছিল। ২০১২ সালে আমেরিকায় প্রথম অনুমোদন দেয়। WHO আংশিক অনুমোদন দেয় ২০১৪ তে প্রথম এবং ২০১৭ তে পূর্ণাঙ্গ। ইংল্যান্ডে ২০১৮ থেকে আংশিক অনুমোদন পেলেও পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন পায় গত বছরের জুন মাসে। এখন সারা পৃথিবীতেই ব্যবহার করা হয় এই ড্র্যাগ ককটেল এইডস প্রতিরোধে।
হে চিকিৎসকগণ, নিজেদের আপগ্রেড করুন। রোগী আপনার প্রজ্ঞার কাছে মাথা নত করবে শ্রদ্ধায়। দুঃখজনক যে, রোগীরা আপনাদের পিটিয়ে মেরে ফেলে এখন! দেশে থাকতে দেখতাম, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও আপনাদের পেটাতো! কিন্তু কেন! একবারও কি চিন্তা করেছেন সেটা! মানবিক সেবা দিতে গিয়ে সবচেয়ে অমানবিক হন আপনারা। মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে সেবার কাজটুকু না দিতে পারলে পেশার অভাব নেই। সেগুলোতে যান। টাকা বানাতে ইয়াবার ব্যবসা খোলেন। দরকার পড়লে দু’চারটা কন্ট্রাক্টরি করে রডের বদলে বাঁশ ঢুকিয়ে দেয়ার ঠিকাদার হয়ে যান। অনেক টাকা কামাবেন। সেই টাকা দিয়ে আমার মতো দুচারটা ডাক্তার পালতে পারবেন।
সামর্থ থাকলে দেশের মানুষগুলো আপনাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে বিদেশ যায় চিকিৎসা নিতে কেন! সেটা আর করবে না তারা, যখন দেখবে আপনারা আবোল তাবোল বকছেন না! ট্রাম্প কিংবা হিরো আলমের মতো হাসি তামাশার পাত্র হচ্ছেন না। নিজেরা দাবি করছেন সেবা দিচ্ছেন, কিন্তু কি সেবা দিচ্ছেন, নিজেরাও সেটা জানেন না।
চেয়ারের সাথে পা বেঁধে পিজির লাইব্রেরিতে বসে এমসিকিউ মুখস্ত করে এফসিপিএস পাশ করা যায়, ভালো ডাক্তার হওয়া যায় না। সেটার জন্যে PrEP এর মতো জ্ঞান এবং কমন সেন্সের কম্বিনেশন শিখতে হয়, জানতে হয় এবং মানতে হয়।
























