নভেরা হোসেনের রোজনামচা ‘মায়া মদমিদমখিলং’

পর্ব ১

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৭, ২০২০

আমরা কে কে যে
কজন বা কত
ভুলে হয়ে গেছি আমাদের মতো
     মা’র সঙ্গে বাক্যালাপ —শামীম কবীর

২ অক্টোবর ১৯৯২
ঘরের ভেতর কার্বন পোড়া ঘ্রাণ। বেশ ঝাঁজালো গন্ধ। নাসিকারন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করে মস্তিষ্কের নিউরন পর্যন্ত চলে গেছে মনে হয়। দুকান দপদপ করছে। কারা যে এসব করে অথবা কখন করে, টের পাই না। দিনের প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাইতো ঘরের মধ্যে থাকি। অবশ্য কী-বা বুঝতে পারি? চারদিন ধরে বাড়িঅলা কেন যে বেসিনের কল বন্ধ করে রেখেছে, কে বলতে পারে! আর এ বিষয়ে তাকে কিছু বলেও কোনো লাভ আছে বলে মনে হয় না। এর অজস্র প্রমাণ আছে। এপ্রিলে যখন ফ্রিজের স্ট্যাবিলাইজার কাজ করছিল না তখনই সন্দেহ হয়েছিল এর পেছনে লালগুল্ফবিশিষ্ট চতুর বাড়িঅলার হাত আছে। কিন্তু কাউকে কোনো কথা বিশ্বাস করানো এত কঠিন! চাচার ধারণা, ফ্রিজের কলকব্জা বিকল করে আমি নিজেই বাড়িঅলার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি।

ঘরের ভেতরের গুমোট আবহাওয়ায় আর থাকা সম্ভব না। বেরোতেই হলো। বাইরে ঝিরঝিরে বাতাস, একটু শীত শীত। পুলওভারটা আনা দরকার ছিল। রাস্তায় একদম শুনশান। রাত আটটা বাজতে না বাজতেই লোকজন সব সটকে পড়েছে নাকি? মোড়ের দোকানে ভিড় নেই। সত্যি কথা বলতে কী, চাইছিলাম কারো সাথে কথা বলতে। কিছুদিন ধরে ঝিম ধরা সময়টা একদম ছিবড়ে বানিয়ে ছেড়েছে। সহপাঠীদের সাথে কথা বলতে এমন ক্লান্ত লাগে। ওদের সাথে কদাচিৎ দেখা হলে চোয়ালের মাংস ঝুলে পড়ে, জিভে স্বাদহীন অনুভূতি। মাসরুর একমাত্র বন্ধু যার সাথে কথা বলা যায়। ওর সিক্সথ সেন্স খালি ভালো না, নাইনথ্, টেনথ্ পর্যন্ত সেন্সও আছে। যদিও ইউনিভার্সিটি ওকে ছাড়িয়ে দিল অনিয়মের দোহাই তুলে। ডিজগাস্টিং।

৩ ডিসেম্বর
কয়েকদিনে যা ঘটল! কী বলব, এমনটা ইহজনমে ভেবেছিলাম বা ভাবতাম বলে মনে হয় না। চারপাশে যেমন সব দেখছি একটু সন্দেহ হয় অ্যাসাইলামগুলো কি তুলে দেয়া হলো নাকি? ঢাকা সিটিতে শুনেছি সরকারি, বেসরকারি মিলিয়ে গোটা পনেরো প্রতিষ্ঠান এসব জনসেবামূলক কাজ করছে। তাদের কাজকর্ম রীতিমতো আমাকে থ বানিয়ে দিল। ফার্মগেট ওভারব্রিজ পার হতে গিয়ে জঘন্য। পেছন থেকে এসে একেবারে জাপটে ধরল। নাকি, টাকা চাই— দুবেলা না খেয়ে আছে। কোটের কোণা ধরে রেখেছে। টাকা না দেয়া পর্যন্ত নো ছাড়াছাড়ি। ইউনিভার্সিটি এলাকা হলে অন্য কথা ছিল। মৃণালদা, মিল্টনরা তো বন্ধু, তস্য বন্ধু হলেও কাগজের নোটের ব্যাপারে ফকিরিবাদের চর্চা করে আসছে বহুদিন। আর তাছাড়া উপায় তো নাই। দেড়শো টাকার পিডি কিনতে হচ্ছে আড়াইশো টাকায়। রেশনিং চলছে সব জায়গায়। সেদিন দেখি বর্ষা-বাদল জুটি পাবলিক লাইব্রেরির চিপার সিঁড়ি থেকে উড়তে উড়তে এলো। বর্ষার গাঢ় কালো চোখদুটো আমাকে দেখে কেমন অদ্ভুত আচরণ করতে লাগল যেন বিয়েত্রিচের দান্তে স্বয়ং দাঁড়িয়ে। ওই পরিস্থিতিতে নিজের ব্যক্তিত্ব যত প্রখর হোক না কেন, তা জঘন্য। উল্টাপাল্টা হয়ে যায় সব। আমিও সচরাচর যা করি না, তাই করলাম। বর্ষার হাত দুটো স্পর্শ করলাম। এতে আমার কী দোষ হলো বুঝতে পারলাম না। বাদল তো বটেই, বর্ষাও এমন ব্যবহার করল আমি যেন কুষ্ঠ রোগী। গায়ে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা। ছ্যাৎ করে উঠল। বুঝি না ওরা আমাকে বুঝতে ভুল করছে নাকি আমি করছি ভুলটা? এমনিতে এসব নৈতিকতার বালাই আমার নাই। কিন্তু রিফ্লেকশন বলতে যা বোঝায় তার ক্ষেত্রে পার্ফেকশন কিছুটা হলেও আছে, মানে তাই তো জানা ছিল। না এখন দেখছি শাহেদের ডজ থিওরিটা সত্যি হয়ে যাচ্ছে। হা... হা... হা...

৮ ডিসেম্বর
ড্রিপ ড্রপ ড্রিপ ড্রপ ড্রপ ড্রপ ড্রপ
বাট দেয়ার ইজ নো ওয়াটার ...
মাথার যন্ত্রণাটা আবার বেড়েছে। তিনদিন পেন্কিলার, ট্রাঙ্কুলাইজার সমানে খাচ্ছি। কোনো পরিবর্তন নাই।

১ জানুয়ারি, ১৯৯৩
হ্যাপি নিউ ইয়ার টু মি। চিয়ার্স। থ্রি চিয়ার্স।

২৪ জানুয়ারি
আজ কার যেন জন্মদিন! সেঁওতির? কী জানি। আমার নিজের না তো? মনে নেই। বুয়েটের হল থেকে কবে এই ছাপড়া মসজিদের গলিতে এলাম? কতদিন? মাস? একি এই শতাব্দীর ঘটনা? কাল বাসে যেতে যেতে দেখলাম ডেড হোয়াইট স্কিনের এক তরুণীকে। ঝলমলে পোশাক, চোখে-মুখে দুরতিক্রম্য আহ্বান। একি আমার জন্য? ফাক্ ইট। আজকাল কী সব ট্র্যাশ্ মাল পড়ে ধাঁধাই শুধু দেখছি। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার রুমে ফিরে ভাত খাওয়ার সময় দেখি নতুন বুয়া আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। না হে এ দৃষ্টি অপরিচিত নয়। খুব বেশি পরিচিতও নয়। গতকল্য যে তরুণীকে দেখলাম এ তার চোখ। পাণ্ডব বর্ণ, ভাবলেশহীন চোখ। কী আশ্চর্য! এটা কী করে সম্ভব? মেমোরি ক্যান বি ডিসেপ্টিভ্। হ্যাঁ, তাও তো মিথ্যে নয়। কিন্তু নিজের চোখকে কী করে ধুলো দিই? মনে হচ্ছে এ দুজন মেয়ের মধ্যে কোনো একটা যোগাযোগ আছে কোথাও। এক্ষেত্রে শাহেদের ডজ থিওরি বোঝার দরকার হয় না। ক্লোনিং! শুনেছি ক্লোন করা হচ্ছে বা হয়ে গেছে। হ্যাঁ মানুষ। কিন্তু এরা যে এত তাড়াতাড়ি যত্রতত্র শহরগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মালুম হয় না। যাক এ বিষয়ে গভীর পড়াশোনা ছাড়া সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না।

১৩ ফেব্রুয়ারি
রোদন ভরা এ বসন্ত সখী কখনো আসেনি বুঝি আগে। এসেছে, হ্যাঁ এসেছিলই তো, কিন্তু কোথায় সে কাদম্বরী, কোথায় সে শকুন্তলা?

এসেছিল মনে। হ্যাঁ মনে মনে এসেছিল, মন তাকে তৈরি করেছিল। মনই মনকে তৈরি করে। আর কঙ্কালটা সবার জন্য সাধারণ। আমার মনেও বসন্তের ছোঁয়া লাগল। ভোরবেলা ঘর থেকে বেরিয়ে ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া...’ কলিম শরাফী? কিছু মনে পড়ছে না। চারপাশে একেবারে গৈরিক বসন্ত। বিকালে মেলায় গেলাম। বইমেলায় এবার প্রথম। টিএসসি থেকে বাংলা একাডেমী; সারি সারি দোকান, বই-পুস্তক, গান, চিৎকার, রঙ, চারিদিকে রঙিন শাড়ি পরা তরুণী, কিশোরী, প্রৌঢ়া...

গাঢ় বাসন্তি শাড়িতে ছাইবর্ণ বিমূর্ত জলরঙ, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, পোড়া কাঠের তৈরি এক মেয়ে হেঁটে গেল সামনে দিয়ে। অবয়বে আফ্রোদিতির ছাপ নয় একটা অচেনা দৃষ্টি, কিছুটা বিষণ্ণ, উদাসীন। চোখে একটা ঝিলিক কিন্তু তা স্বল্প সময়ের মধ্যেই মিলিয়ে গেল। তার চোখের দৃষ্টি বৃক্ষের কথা মনে করিয়ে দিল। নিজের মনের মধ্যে যেন ডুবে আছে, চারপাশে কী হচ্ছে দেখছে না, একটা ধ্যানের মতো কিন্তু কোথায় যেন একটা বিক্ষিপ্ততা। বিকেলের হালকা গোলাপি আলো তার সব শূন্যতাকে শুষে নিচ্ছে। কিন্তু এ মেয়ে তো নেশায় একদম চুর। কোনো হুঁশ নাই। আহ! কী সব ভাবছি। অচেনা সব মানুষ দেখলে মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে ওঠে আর পরিচিতরা মনে বিতৃষ্ণা জাগায়। তাদের চুলের ভেতর বিষাক্ত কেউটে ওত পেতে থাকে। ওদেরকে আমি ঘেন্না করি। সবকটাকে।

ব্লা... ব্লা... ব্লা... ব্লা... ব্লা...

২৬ ফেব্রুয়ারি
জোসেফের কথা খুব মনে পড়ছে। অদ্ভুত ছেলে। বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমার অতীত ভুল। একটা সড়ক ধরে যাচ্ছিলাম দুজনে, দুবন্ধু। কবেকার কথা মনে নেই। ঊননব্বই, আটাশি, সাতাশি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বিকলাঙ্গ মনের যত কথা! সে শুনতো আমার কথা। প্রতিটা শব্দ, বর্ণ— গোগ্রাসে গিলত, এর মধ্যে কোনো ফাঁকি ছিল না। যা ছিল তাকে বলা যায় প্রেম। একই লিঙ্গের প্রতি প্রেম। না এ প্রেমকে সহজে কেউ ভালো চোখে দেখে না। অথচ এ সম্পর্ক চলে এসেছে সৃষ্টির আদি থেকে। এই ঘনিষ্ঠতা সবসময়ই আছে। কিন্তু তা যেন কেউ দেখতে পায় না, দেখতে চায় না। একথা জানাজানি হলে তাদের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে ঘর ও বাইরের বাতাস। আমার প্রতি জোসেফের এ টান, আমারও তো ছিল। কিন্তু তবু তাকে আমি চরমভাবে আঘাত করেছি। পাশ থেকে বন্ধুর লাশ নয়, বন্ধুকেই ফেলে দিয়েছি।

মোটরবাইকে পিষে মেরেছি যেন তাকে। ধুলোর মতো ছেলেটি ধুলোয় মিশে গেছে আর জানতে পারিনি তার খোঁজ। আসলে জানতে চাইনি, আগ্রহ বোধ করিনি। বলা যায়, একপ্রকার ভুলেই থেকেছি। হৃদয়হীনের মতো ব্যবহার করেছি। এটা ভাবলে আশ্চর্য লাগে, যারা আমাকে সত্যিকারের বন্ধু ভেবেছে, অনুভব করেছে, সহযাত্রী হয়ে চলেছে বন্ধুর পথ ঠিক তাদের প্রতিই বিকর্ষণ। অথচ যেখানে অনেক ছলচাতুরী, ভুলুক-ভালুক অসারতা, মনের দূরত্ব— সেইসব মানুষ, কথার দিকে বারবার ছুটে গেছি। এ হয়তো মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। লাকা সাহেব ভালো বলতে পারতেন, সলিমুল্লাহ্ সাহেবও ফুটনোটসহ মুগ্ধ করে রাখতে পারবেন মনে হয়। কিন্তু তাদের থেকে ভালো আমি জানি, বিশেষত এই বিষয়ে। জোসেফের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত আধুনিক অবয়বের সামনে গেলে নিজেকে আয়নার ভেতর দেখতে পেতাম। ও ছিল আবলুস কাঠ দিয়ে বাঁধানো স্বচ্ছ এক আয়না। ওর চোখের দিকে তাকালে বুঝতে পারতাম, আয়না আমাকে দেখছে, আমি দেখছি তাকে। এ লিভিং মিরর। কিন্তু আয়নায় নিজের আক্ষরিক প্রতিচ্ছবি দেখতে ভালো লাগত না। জোসেফের কাছে লুকানোর কিছু ছিল না। ও বুঝে নিত স্বাভাবিক নিয়মে। নিজের ত্রিশঙ্কু দশাটি দেখতে চাইতাম না ওর আরশিতে। সেজন্য ওকে এক পর্যায়ে অসহ্য লাগত। ইচ্ছে করত ঢিল মেরে চৌচির করে দিই আয়নাটি। সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেই তিতুমীর হলে এসে হাজির হতো জোসেফ। কায়েৎটুলি থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসত প্রায় প্রতিদিন। আমার তখন ঘুমে দিশেহারা অবস্থা। প্রজেক্টের কাজে পুরো রাত জেগে চারটা পাঁচটার দিকে ঘুমাতে যেতাম। ভোর আটটার মধ্যে জোসেফর উপস্থিতি। মাঝে মাঝে মনে হতো, জোসেফ কেউ নয়। কে সে? আমারই মনের ভুল নাতো? দিনরাত কার সাথে যেন কথা বলতাম। হলের ছেলেরা বলত, আমার স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে, চাঁনখারপুলে গিয়ে টাইট দিয়া আনতে হবে। হা... হা... হা... চলবে