নিতির গল্প

উপন্যাস ২

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৮, ২০২০

যখন ঘুম ভাঙল তখন মসজিদে মাগরিবের আজান হচ্ছে। নিতি চোখ মেলে চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখল। মশারি টাঙানো। গায়ে পাতলা চাদর দেয়া। এসি চলছে। ঘরের লাইট বন্ধ। পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরে হালকা আলো আসছে। গাছের পাখিগুলো ডেকে চলেছে। সন্ধ্যা নামতে দেরি নেই। নিতির মাথার সেই ঝিমঝিম ভাবটা চলে গেছে। বেশ ফ্রেশ লাগছে। একটু খিদেও লেগেছে। মনে পড়ল দুপুরে কিছু খায়নি সে। দীপ নিশ্চয় ঘরে এসেছিল। এসব মশারি, চাদরের ব্যবস্থা ওই করেছে। বালিশে মাথা ছিল না। পা মেঝের উপর ছিল। নিশ্চয় দীপ ওকে খাটে তুলে বালিশের উপর মাথা রেখে গেছে। এতকিছু হয়ে গেল, তবু নিতি টের পেল না! ও কি তবে জ্ঞান হারিয়েছিল? নিশ্চয় জ্ঞান ছিল না ওর।

এমন তো আগে হয়নি! তবে আজ কেন হলো? তাহলে কি কোনও কঠিন অসুখ বাসা বেঁধেছে ওর শরীরে? নিতি সেটা টের পায়নি। ভেতরে ভেতরে ও এতটা অসুস্থ! নিতির আবার ভয় করতে লাগল। এমন সময় দরজা খোলার শব্দ হলো। নিতি সচকিত হয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে উঠে বসল। দীপ ঘরের আলো জ্বালালো। মশারির দড়ির প্রান্ত খুলল। মশারিটা একপাশে সরিয়ে রেখে খাটের কোনায় এসে বসল। এরপর নিতির মুখের দিকে তাকিয়ে স্বসঙ্কোচে প্রশ্ন করল, শরীর কি এখনো খারাপ লাগছে? নিতি অস্ফুট স্বরে বলল, না। এখন ভালোই লাগছে।

দীপের মুখটা পাংশু বর্ণ হয়েছিল। গভীর দুশ্চিন্তায় কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছিল। চুলগুলো উসকোখুসকো। নিতির কথাটা শোনার পর মুখটা গোল হলো, ঠোঁটের কোনায় একটু হাসির রেখা ফুটে উঠল। দীপ নিতিকে যথেষ্ট ভালোবাসে। যথেষ্ট কেয়ারিং। দীপের সেন্স অব হিউমার দারুণ। নিতি এগুলো বুঝতে পারে। মেয়েদের অনুভূতি শক্তি প্রখর। ছেলেদের থেকে সেটা কয়েকগুণ এগিয়ে। কয়টা ছেলে, কখন, কোথায় আড়চোখে দেখেছে, সেটা একদম গবেট মেয়েও চোখবুজে বলতে পারে। আর প্রেমে পড়লে ছেলেরা এমনিতেই বোকাবোকা হয়ে যায়। মেয়েদের চোখে সেটা চুম্বকের মতো ধরা পড়ে। বেশিরভাগ মেয়েই এটা উপভোগ করে। মনে মনে সবই বুঝতে পারে। কিন্তু ধরা দেয় না। ছেলেগুলো একটু পাগল, একটু আবেগি হয়। মেয়েরা সামান্য পাত্তা দিলে অনেকদূর ভেবে নেয়।

মেয়েদের তাতে অসুবিধা হয়। বিব্রত হতে হয়। সে কারণে সহজে মেয়েরা ধরা দেয় না, তবে সহজেই ছেলেরা ধরা পড়ে যায়। নিতিও ধরতে পারে। দীপের গোপন ইচ্ছে পূরণ করতে চায়। উদগ্র বাসনা বুঝতে পারে। আবার প্রেমটাও টের পায়। দীপের ব্যক্তিত্ব সাংঘাতিক। সহজে অপমানিত হতে চায় না। এমন কথা, এমন কিছু বলে না, যাতে নিতি কষ্ট পাবে। বরং নিতি যা শুনতে চায়, মনে মনে দীপ যেন তা টের পেয়ে যায়। দীপের মুখের থেকে সে কথায় শোনে। দীপ যেন মায়াজাল বিস্তার করে রেখেছে নিতির উপর। নিতির নিয়তির উপর।

আজ এখানে আসার ব্যাপারেও নিতির পূর্ণ সমর্থন ছিল। দীপের প্রবল আগ্রহ, অভিমান, হালকা ঝগড়া, সবকিছু ছাপিয়ে নিতির আগ্রহটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিতিকে তো কিডনাপ করে আনা হয়নি বা ব্ল্যাকমেইলও করা হয়নি। তবুও নিতির মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মনে কোনও আনন্দ পাচ্ছে না বরং একটা তেতো বিস্বাদ। মাগরিবের নামাজ হয়ে গেছে। এখন বাইরে একটু মানুষের আনাগোনা শোনা যাচ্ছে। এলাকাটা এমনি নিস্তব্ধ, শীতল। ঢাকার বুকে এমন সবুজ কমই আছে। শহরে দু`একটা ছুটির দিন ছাড়া আর সবসময়ই কোলাহলে পরিপূর্ণ। এ জায়গাটা তেমন নয়। একেবারেই ফাঁকা, সুনসান।

দীপ বলে উঠল, খাবে তো। দুপুরে তো কিছুই খাওনি। নিতি মৃদু স্বরে জানাল, খাবে। এরপর খাট থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেল। দীপ খাবার সাজাতে ডাইনিং রুমে চলে এল। প্রায় মিনিট দশ পর নিতি ডাইনিং রুমে আসল। চেয়ার টেনে বসল। শরীরটা দুর্বল লাগছে, তবে আগের থেকে অনেক সতেজ। দীপ দাঁড়িয়ে ছিল। মুখে বিস্ময়। নিতি মুখ তুলে দীপের মুখের দিকে চেয়ে জানতে চাইল, তুমি খেয়েছ? দীপ বলল, খেয়েছি। এরপর আর কথা বলল না। নিতি নিজেই বোল থেকে কয়েকটি পদ তুলে নিল। এগুলো দীপের রান্না। দীপ ভাতের ডিশ সাজিয়েই রেখেছিল। ভাতটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তবে তরকারি গরম। দীপ নিশ্চয় এগুলো গরম করে রেখেছে। দীপ রাঁধতে পারে। তবে খুব ভালো না। লবণ-হলুদ এগুলো ঠিকঠাক দেয়। তবে পাকা হাতের যে স্বাদ সেটা আসে না। দীপের রান্না এর আগেও নিতি খেয়েছে।

সেদিন এমনি শুক্রবার ছিল। ওরা কয়েকজন বন্ধু গাজীপুরের একটা রিসোর্টে গিয়েছিল। সকালে গিয়ে বিকেল নাগাদ ব্যাক করে। সেদিন দুপুরে দীপ অন্যদের বসিয়ে রিসোর্টের কিচেন ব্যবহার করে চিকেন টোস্ট, চিকেন কারি এসব করেছিল। নিতান্ত শখের বসে। দীপের অন্যান্য বন্ধু, নিতি সবাই মিলেই দীপকে হেল্প করেছিল। সাধারণত বেড়াতে যেয়ে এমনটা হয়নি কখনো। সেই প্রথম, সেই শেষ। রান্না করতে গেলে বেড়ানোর প্রথম আনন্দটায় মাটি হয়ে যায়। দীপ সেবার এই মহার্ঘ্য কথাটাই ভালো করে বুঝেছিল।

নিতির খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে আবার খাটে গিয়ে বসল। দীপের মনটাও কেমন যেন হয়ে গেছে। এ কয়েক ঘণ্টায় দীপ যা আশা করেছিল তার উল্টোটাই হচ্ছে। নিতিকেও সে ঠিক চিনতে পারছে না। নিতি মাঝে মাঝে সিগারেট টানে। বাসায় আসার পর একটুও সেদিকে হাঁটছে না। পোষাক বদলায়নি। সাতদিন যে মেয়েটা থাকবে বলে এখানে এসেছে, তার আচরণ আধাঘণ্টার গেস্টের মতো। পানসে ও তেতো। গেস্টের আপ্যায়নের তাড়াহুড়ো আছে, কিন্তু আন্তরিক কথা বলার ফুরসৎ নেই। কেমন পরপর। দূরের দূরের।

নিতিকে আজ বড্ড দূরের মনে হচ্ছে। ভীষণ অচেনা লাগছে। দুপুরে যে ভয়টা নিতিকে পেয়ে বসেছিল, এখন সেটা দীপকে পেয়ে বসেছে। দীপ আলমারি খুলে গতকাল মেডিকেল সপ থেকে যেগুলো কিনেছিল সেগুলোতে একবার চোখ বুলাল। দোকানের ছেলেটা নির্লজ্জ ভাবে হেসে বলেছিল, ভাই কাজের আধাঘণ্টা আগে খাবেন। ও একটা সাইটে দেখেছিল দুধ ও মধু মিশিয়ে খাওয়ার আধাঘণ্টা পর ঔষধ খেলে ফল ভালো পাওয়া যায়। হঠাৎ সজোরে শব্দ করে আলমারিটা বন্ধ করে দিল দীপ। এরপর অস্পষ্ট স্বরে নিজের মনেই বলে উঠল, বালের চিন্তা করছি। ওদিকে অসুস্থ রুগী এদিকে এসব, দূর।

আবার নিতির ঘরে এলো দীপ। কী বলবে ভাবতে পারছে না। এবার নিতির পাশে বসল। নিতি, দীপ বসাতে দীপের থেকে একটু দূরে সরে গেল। কয়েক ইঞ্চি। তবে দীপের বুকটা তড়িৎ গতিতে কেপে উঠল। একটা সূক্ষ্ম অপমান নিজের থেকেই গায়ে মেখে নিল। কিছু যদিও বলল না। বেশ কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ থাকল। ঘরে পিনপতন নীরবতা। এরমধ্যে রাত নটা বেজে গেছে। দীপ মোবাইলে ফেসবুক ওপেন করল। কিছুক্ষণ ম্যাসেঞ্জারে ঘোরাঘুরি করে আবার ফোনটা বন্ধ করে রাখল। নিতি এক দৃষ্টিতে ঘরের একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। এবার দীপ নিতির দিকে তাকিয়ে গলার সুর একটু উঁচুতে উঠিয়ে প্রশ্ন করল, তোমার কি হয়েছে, একটু ক্লিয়ারলি বলবে?

নিতি প্রশ্নের কোনও উত্তর করল না। দীপ এবার নিতির একটা হাত টেনে নিয়ে, নিতির দিকে একটু ঝুঁকে একটা মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বলল, কি, বলবে না কি হয়েছে?

এবারও কোনও কথা বলল না। দীপ এবার দু`হাতের বাহুদুটি ধরল। দীপের ইচ্ছে হচ্ছিল সজোরে একটা ঝাঁকি দিতে, কিন্তু পারল না। নিতির চোখের দিকে তাকিয়ে হাত ছেড়ে দিল। নিতির চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। অশ্রুর কোনও ভাষা নেই, অশ্রু নির্বাক। তবুও সে অনেক কথা বলতে পারে। তারই দু`চারটে কথা বলল, দীপ কিছু বুঝল, কিছু বুঝল না। চলবে

২৭ এপ্রিল ২০২০