
মডেল: সুস্মিতা দাশ অনুরাধা
নিতির গল্প
উপন্যাস ৩
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৯, ২০২০
দীপ মাস্টারবেডের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। পাশে একটা ছোট পার্ক। শিশুদের জন্য নির্মিত। অরক্ষিত। সকালে কিছু স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ হাঁটে। এক্সারসাইজ করে। দুপুরে ভিক্ষুক, ভবঘুরের দল পার্কের বেঞ্চের দখল নেয়। বিকেলে বাচ্চাদের হাতে হাতবদল হয়। সন্ধ্যার পর অন্যরকম।
পার্কের ছোট বড় পোস্টে বাতি জ্বলছে। গাছের পাতার ফাঁক গলিয়ে কিছু আলো নিচে পড়ছে, কিছু আলো হারিয়ে যাচ্ছে পাতার আড়ালে। মানুষের মুখগুলো চেনা যাচ্ছে না। মানুষের আকার বোঝা যাচ্ছে। কে কী করছে তার কিছুটা আচ করা যাচ্ছে। দীপ এক দৃষ্টিতে পার্কের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে একধরনের ঝাপসা দৃষ্টি। কিছু দেখতে পাচ্ছে আবার মন শূন্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ কয়েকটা ছেলের দিকে চোখ পড়ল। কিছু একটা করছে তারা। কি করছে? দীপ ঠিক ধরতে পারছে না। সিগারেট টানছে? হতে পারে। মাঝের জনও কি ছেলে? ঠিক বুঝতে পারছে না এত দূর থেকে। কে তবে? মেয়ে? রাত দশটা বাজতে চলল। গাছের আড়ালে এতগুলো ছেলের মাঝে মেয়ে?
দীপ ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। এবার একটু মনোযোগ দিল। হ্যাঁ, মেয়েই তো। কি করছে ওরা? দীপের কৌতূহল বাড়ল। ওদের ফ্ল্যাট পার্কের প্রাচীর সংলগ্ন। ভালো বাতাস আসছে। আকাশে একফালি চাঁদ। একটুখানি আলো, অনেকখানি আঁধার। দীপের চোখ আবার ও-ই ছেলেগুলোর দিকে। এদের মধ্যে একটা ছেলের হাত ধরে মেয়েটা পার্কের একটা কোনায় চলে এলো। ওদের প্রাচীর সংলগ্ন কোনা। ছোটবড় গাছের ছায়ায় ল্যাম্প পোস্টের আলো নিচে নামছে না।
ছেলেমেয়ে দুটি প্রাচীর সংলগ্ন একটা বেঞ্চের উপর বসল। এ জায়গাটা ওর ফ্ল্যাটের খুব কাছে। তবুও গভীর দৃষ্টি না দিলে ওদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। দীপের চোখে একটা ঘোর লেগেছে। গা শিরশির করছে। কি করছে ওরা? দীপের মনে হাজারো প্রশ্ন। অসভ্য কৌতূহল। দীপ নিজেকে ভুলে যাচ্ছে। ও একটা ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে, সেটাও ভুলে যাচ্ছে। নিতান্ত সাধারণ চোখের অভ্রভেদি দৃষ্টি ছেলেমেয়ে দুটিকে গিলে খাচ্ছে।
ছেলেটা মেয়েটার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। গায়ে গা লাগিয়ে বসেছে। মেয়েটার কাঁধে ছেলেটা হাত রাখল। মেয়েটা কিছু বলল না। সরল না। হঠাৎ নিতির কথা মনে পড়ে গেল দীপের। কিছুক্ষণ আগে নিতির কয়েক ইঞ্চি দূরে সরে যাবার দৃশ্যটা দীপের চোখের সামনে ভেসে উঠল। দীপের মন গম্ভীর হয়ে গেল। ছেলেমেয়ে দুটির থেকে মন হঠাৎ শূন্যে হারিয়ে গেল। দীপের শরীরে বিশ্রি অনুভূতি হতে লাগল। দীপ বারান্দা থেকে ঘরে চলে এলো।
খাটের দিকে চোখ দিতেই দীপ একটু অবাক হলো। নিতি খাটে নেই। তবে কি ও ওয়াশরুমে গেল? দীপ ঘরের মাঝে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। অনুভব করতে চেষ্টা করল নিতিকে। না, নিতি ওয়াশরুমে নেই। ওয়াশরুমে আলো জ্বলছে না। নিঃশব্দ। দীপ একটু উৎকর্ণ হলো। ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে গেল। না, নিতি নেই। দীপ অন্য তিনটি রুমে তন্ন তন্ন করে খুঁজল। না, কোথাও নিতি নেই। অসভ্যের মতো বাথরুমে উঁকি দিল, রান্না ঘরে, বারান্দায় কোথাও নিতি নেই। দীপের মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট হচ্ছে।
দীপ মোবাইল হাতে নিল। নিতির ফোনে ডায়াল করল। মাস্টারবেডের ওয়ারড্রবের উপর ভাইব্রেশন হতে থাকল। দীপ এগিয়ে এলো শব্দটার দিকে। হ্যাঁ, এই তো নিতির ফোন। ভাইব্রেট হচ্ছে। নিতি মোবাইলে রিংটোন দেয়া পছন্দ করে না। সবসময় ভাইব্রেট মুডে রাখে। এ কারণ অনেক সময় ফোন ধরতে পারে না। এ নিয়ে বিস্তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। যুক্তি পাল্টা যুক্তি হয়েছে। নিতি চেঞ্জ হয়নি। ও নিজের সিদ্ধান্তে অটল। শেষ পর্যন্ত দীপের হার স্বীকার করতে হয়েছে। প্রয়োজনীয় না পিক আপ করা ফোন কল, কল ব্যাকের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। এখন ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে, রাগ হয়, তবুও মুখে কিছু বলে না। ফোন কল ব্যাক হলে হাসিমুখে না বলা প্রয়োজনীয় কথাটি বলে নেয়।
নিতি তাহলে কোথায়? দীপের মন ক্রমে ভারি হয়ে আসছে। নিতি কি চলে গেল, এক মুহূর্তে ভাবল দীপ। পরমুহূর্তেই ভাবল, না, তা হবে কেন! তাহলে ফোনটা নেবে না? দেয়াল ঘড়িটির দিকে তাকালো। রাত এগারোটা। ক্রমে রহস্য বাড়ছে। দীপ নিতির হাত ব্যাগটা লক্ষ্য করল। হ্যাঁ, আগের জায়গাতেই আছে। নিতির কাপড়ের ব্যাগ? ড্রয়িং রুম থেকে দীপই ব্যাগটা এনে ঘরে রেখেছিল। স্টিল কেবিনেটের পাশে। সেদিকে তাকালো, এ ব্যাগটাও একই জায়গায় আছে।
দীপ কয়েকবার নিতি নিতি বলে ডাকল। কোন উত্তর এলো না। বাসার ইন্টারকম থেকে গেটে ফোন দিল। জানতে চাইল একঘণ্টার মধ্যে কোনো মেয়ে বেরিয়ে গেছে কিনা। নিজের পরিচয়, ফ্ল্যাট নম্বর কিছুই বলল না। গেটের ইন্টারকমে নাম্বার ওঠে না। পরিচয় গোপন থাকল। গার্ডও কিছু জানতে চাইল না, কোনোকিছু না ভেবেই জবাব দিল, না স্যার। কয়েকজন বাসায় এসেছে, কিন্তু কেউ বেরোয়নি। ঠিক আছে বলে দীপ ফোনটা নামিয়ে রাখল।
দীপের চিন্তা তল খুঁজে পাচ্ছে না। গভীর সমুদ্রের জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়লে ডুবুরি যেমন ডুবতে থাকে। ডুবতে থাকে। কোনো তল খুঁজে পায় না। হাত নাড়িয়ে, পা নাড়িয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করে। ভেসে থাকার চেষ্টা করে। সেই ফাঁকে নিজের কর্তব্যটুকু সেরে নেয়। দীপের অবস্থা এখন তেমন হয়েছে। কোনো তল খুঁজে পাচ্ছে না, তবু নিতিকে খুঁজতে হবে।
দীপ ড্রয়িং রুমে চলে গেল। এরপর হঠাৎ দরজা খোলা রেখে এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে উঠতে লাগল। এরপর কি মনে করে, মাঝ পথ থেকে আবার ফ্ল্যাটের সামনে ফিরে এলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে চাবি নিল। দরজা লক করে আবার সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। ছাদের দরজা খোলা। দীপের মনে আশায় সঞ্চার হলো। ছাদটা বেশ বড়। একবার চারদিকে তাকিয়ে নিল। একটু দূরে এক কোনায় ছাদের প্যারাফিটের উপর ঝুঁকে পড়ে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পোষাক বোঝা যাচ্ছে না। হালকা মেঘে সেই একফালি চাঁদ অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেই সাথে নিয়ে গেছে চাঁদের কোমল, মোলায়েম আলো টুকুও। মেয়েদের গড়ন আলাদা। অন্ধকারেও তা বোঝা যায়।
দীপ ছায়ামূর্তিটির দিকে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি হলে স্পষ্ট বোঝা গেল। নিতি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দীপ নিতির পাশে দাঁড়াল। নিতি দীপের দিকে একটুখানি তাকিয়ে আবার যেদিকে দৃষ্টি ছিল, সেদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। যেন কিছুই হয়নি। এই এতটুকু ঘটনা, এই সামান্য দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া দীপের বুকে ছুরিকাহতের মতো যন্ত্রণা সৃষ্টি করে উঠল। চলবে
২৮ এপ্রিল ২০২০