মডেল: সুস্মিতা দাশ অনুরাধা

মডেল: সুস্মিতা দাশ অনুরাধা

নিতির গল্প

উপন্যাস ৫

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ০১, ২০২০

ফজরের আজান শুনে ঘুম ভাঙল নিতির। পাশের মসজিদের মিনারটি বেশ সুন্দর ও উঁচু। বাসা থেকে দেখা যায়। আজান হয়ে যাবার পর আবার চারদিকে সুনসান নীরবতা। একটা মায়াবী আলো-আঁধার।

ভোর ও সন্ধ্যার আজান সঙ্গীতের মতো শ্রুতিমধুর লাগে নিতির কাছে। নিতির গ্রামের বাড়ির কাছাকাছি মসজিদ নেই। প্রায় হাফ কিলোমিটার দূরে মসজিদের একটি মাইক থেকে আজানের ধ্বনি অনুরণিত হতো আকাশে বাতাসে। এক সম্মোহনি সুর ভেসে আসত। বড় ভালো লাগত সে সুর।

ভোরে ঘুম ভেঙে বেশ ভালোই লাগছে। দু’তিন ঘণ্টার বেশি ঘুম হয়নি নিশ্চয়। তাতে কি? বিকেলের অনেকটা সময় তার ঘুমিয়ে কেটেছে। নিতি জানালার পর্দা সরাল। ভোরের আঁধার কেটে এক মোহময়তা তৈরি হচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর সেই অনুভূতি।

নিতি ওয়াশরুমে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর বের হয়ে হলো। টাওয়েলে হাত-মুখ মুছে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এরই মধ্যে মনোরম আলো ফুটে উঠেছে। ভোরের বাতাসে এক স্বর্গীয় ভালোলাগা আছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই ভালোলাগার অনুভূতিটুকু টের পাচ্ছে।

সবকিছুই ভালো লাগছে নিতির। মিষ্টি আলো, বাতাসের শীতল পরশ। শুধু মশার কামড় বড় অসহ্য বোধ হচ্ছে। শহরে মশক নিধন নামকে ওয়াস্তে। লক্ষ লক্ষ মশা তাদের হুল বের করে অপেক্ষা করে নগরবাসীর জন্য। শহরের শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ থেকে শুরু করে সামগ্রিক পরিবেশ দূষণের সবই বর্তমান। মশা সেই দূষণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নগরবাসীর ভোগান্তির কারণ হয়েছে।

এত সুন্দর ভোর, এত মিষ্টি আলো শুধু মশার কারণে বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যাবে না? এর থেকে মানসিক গ্লানি আর কি হতে পারে? বছরের পর বছর যাচ্ছে, পৃথিবীর আমূল পরিবর্তন হচ্ছে, সব শহর এগিয়ে যাচ্ছে, শুধু আমরা পারছি না। একি অদৃষ্টের দোষ, না অব্যবস্থাপনা?

নগরবাসীর সব মুখ বুজে সহ্য করে। তারা হয় নিরুপায়, না হয় নির্বোধ। হয় তাদের কিছুই করার ক্ষমতা নেই, না হয় কিছু করার ইচ্ছাটা নেই। এক বোবা অসহায়ত্ব। নিতি মশার অত্যাচারে আবার ঘরের ভিতর চলে এলো। ঘরের ভেতরও মশা আসে। জানালায় নেট দেয়া, তবু কোন ফাঁক দিয়ে চলে আসে, কে জানে?

নিতি ভাবতে শুরু করল, কি করবে এখন? আবার ঘুমাতে যাবে? নাহ্, এখন আর ঘুম আসবে না। কি দরকার এত ঘুমিয়ে! নিতি রুমের দরজা খুলল। দীপ এখনো ঘুমাচ্ছে। করিডোরের কম আলোর লাইটটা জ্বলছে। একবার ভাবল দীপকে ডাকবে। পরক্ষণেই মনে হলো, না থাক। প্রয়োজন কি ভোরের আরামের ঘুমটা নষ্ট করে। দীপ একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে। ওর আদুরে ঘুমটা নিতির অদৃশ্য আদর পেয়ে আরো গভীর হলো না জেগে উঠল, তা বোঝা গেল না।

ওপর থেকে একজন দীপের প্রতি নিতির অনুভূতির গভীরতা নিশ্চয় বুঝতে পারলেন। কিন্তু তিনি তার সেই বোঝবার ক্ষমতা দীপকে প্রদান করলেন না। দীপ আগের মতোই ঘুমাতে থাকল। রাগে, অভিমানে। হাঁটতে হাঁটতে কিচেনে এলো নিতি। গতকালের বাসি বাসন পড়ে রয়েছে। নিতি সেসব পরিষ্কার করে ধুয়ে মুছে রেখে দিল। বাঙালি মেয়েরা যত আধুনিকই হোক না কেন, কোথায় যেন একটা মমতা লুকিয়ে আছে। তাদের অন্তরের গভীরে। সে মমতা সংসারী করে তোলে। সে মমতা মাতৃস্নেহে আগলে রাখে। সে মমতা ছেলেদের থেকে মেয়েদের আলাদা করে। মেয়েদের করে তোলে মমতাময়ী।

নিতি কিচেনে এসে চাল ও দুটো আলু ধুয়ে নিল। একটা ছোট হাড়িতে চাল, জল, আলু দিয়ে গ্যাস অন করল। এরপর মসুরের ডাল ধুয়ে ছোট কড়াইয়ে করে পাশের চুলায় বসাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকালের খাবার প্রস্তুত হয়ে যাবে। মসুরের ডাল, আলু ভর্তা, ডিম ভাজি আর ভাত। ভেরি সিম্পল।

হালকা খাবার নিতির পছন্দ। ডায়েট কন্ট্রোল করে না নিতি, তবে ওর খাদ্যাভ্যাসে অটো ডায়েট কন্ট্রোল হয়ে যায়। ওয়েলি ফুড, জাঙ্ক ফুড বা ফার্স্ট ফুড, যে নামেই নামকরণ হোক না কেন, নিতির ওগুলো পছন্দ না। যে মেয়ে মাঝে মাঝে সিগারেট টানে, সে মেয়ের মাঝে এই বৈপরীত্যে নিতি নিজেই অবাক হয়।

সাধারণ গ্রাম্য পরিবেশে জন্ম নিতির। মা আর দশটা গ্রাম্য মায়ের মতো বাড়িতে ঘরকন্যার কাজ করে। আমরা যাকে গৃহিণী বলি। নিতির মা তার থেকে বেশি কিছু নয়। বাবা স্কুল মাস্টার। গ্রামের মানুষ তাকে যথেষ্ট ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে। কিছু পৈত্রিক সম্পত্তি আছে। স্কুলে শিক্ষকতা, সম্পত্তি দেখাশোনা আর বাড়ির বারান্দায় সকালে দু`একটা ছাত্র পড়িয়ে তার সময় কেটে যায়।

দারিদ্র্য নেই সংসারে, আবার সম্পদের বাড়বাড়ন্তও নেই। সাধারণ গ্রাম্য মধ্যবিত্ত পরিবার। সামান্য সম্মান ও সীমিত সম্পদে খুশি। খুব বেশি কিছু চাওয়ার নেই। পাওয়ারও নেই। নিতির একটা ছোট ভাই আছে। নিতি বেশ বড় হলে ভাইয়ের জন্ম হয়। সে এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। গ্রামের স্কুলে ফার্স্ট হয়। সবমিলিয়ে আপাদমস্তক সুন্দর একটা পরিবার। এই পারিবারিক পরিচয় থেকে উঠে এসেছে সে।

পারিবারিক সংস্কার ও ঢাকার উদ্যাম নগরজীবন, এই দুই বিপরীত ধর্মী জীবনবোধের প্রভাব পড়েছে নিতির মনস্তত্ত্বে। এক বোধ দীপের কাছাকাছি এনেছে, ঘনিষ্ঠ হতে বলছে। এক বোধ দীপের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

সকালের খাবার প্রস্তুত হয়ে গেছে। হকার খবরের কাগজ দিয়ে গেল। দীপ ঘুম থেকে উঠেছে। খবরের কাগজ নিয়ে পাতা উল্টাল। একটা বাচ্চা মেয়ের ধর্ষণের খবর দেখে দীপের মনটা বিগড়ে গেল। অস্ফুটে নিজের মনেই বলে উঠল `শুয়োরের বাচ্চা`। এগুলোকে গুলি করে মারা উচিত। শব্দটা ঠোঁট দিয়ে বের হলেও নিতির কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারল না। দীপের চোখেমুখে আগুন। জোর করে একটা শিশুর সাথে এই জঘন্য অপরাধ করতে পারে মানুষ! পুরুষ জাতি হিসেবে এসব কারণে নিজেকেও অপরাধী মনে হয় দীপের। পুরুষের এই জঘন্য মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারার কারণ কোনোভাবেই বুঝতে পারে না দীপ।

হঠাৎ নিতির গলা শুনে উৎকর্ণ হলো দীপ। নিতি ডাকছে, `খেতে এসো, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।` দীপ পেপারটা ভাঁজ করে ডাইনিং টেবিলে এসে বসল। চলবে

৩০ এপ্রিল ২০২০