নিতির গল্প

উপন্যাস ১০

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ০৬, ২০২০

নিতি দীপের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি স্টাটাস দিয়ে, দীপকে ট্যাগ করে দিল। নিতি দীপকে বুঝিয়ে দিল, তার সামাজিক সংস্থার, ধর্মীয় মূল্যবোধ, পারিবারিক গৌরব, ব্যক্তিগত আবেগ বা বাঙালি মেয়ের চিরকালের ধ্যানধারণা তাকে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে বাধা দিচ্ছে। যৌনতার যে সংজ্ঞা দীপ দিয়েছে তা নিতির নীতিবিরুদ্ধ।

লেখাটা ফেসবুকে পোস্ট হলে নিতি মোবাইলটি বেডের উপর রাখল। খুব ধীরলয়ে টাওয়েলটা নিয়ে বাম হাতের কনুইয়ের ভাঁজে ধরল। যেন কোনও ব্যস্ততা নেই জগৎসংসারে, এমন ভঙ্গিতে স্নানের জন্য ওয়াশরুমে দরজা খুলল। ওদিকে দীপের একটি ফোন এসেছে। সিঙ্গাপুর থেকে। দীপের মামা দীপ কেমন আছে খোঁজ খবর নিচ্ছে। মামার ফোন পেয়ে দীপের হার্টবিট বেড়ে গেছে। দীপ জানে নিতি এখানে তার সাথে আছে এটা মামা জানবে না। তবুও অজানা ভয় তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। একদিকে নিতির ভিন্নতর আচরণ, অন্যদিকে পারিবারিক ভয় দীপকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে।

দীপের বাবার জুয়েলার্সের ব্যবসা। যশোরে প্রসিদ্ধ মার্কেটে দোকান। মার্কেটটিও দীপদের। তিনি স্থানীয় জুয়েলারি মালিক সমিতির সভাপতি। স্থানীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত। বেজপাড়ায় বড় পৈত্রিক বাড়ি। হাতের আঙুলে অনেকগুলো পাথর বসানো আঙটি। গলায় মোটা সোনার চেন। ধূমপানে আগ্রহ আছে, তবে নেশা নেই। নাম দীপেন মজুমদার। নিউ মজুমদার & সন্স জুয়েলার্সের সত্ত্বাধিকারী।

উত্তরাধিকার সূত্রে সবই দীপের। দীপের একটি বিবাহযোগ্যা বোন আছে, কিন্তু আইনত সম্পত্তিতে তার কোনও অধিকার নেই। এ আইনটি বেআইনি কিনা তা নিয়েও সমাজের কারো মাথাব্যথা নেই। বরং আইনে ছেলেমেয়ের সম্পত্তিতে সাম্য আনতে চাইলে যে মহলটি সবার আগে বাধ সাধে, দীপেন বাবু তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। এইতো, এই ক’দিন মাত্র হলো তারা একটা মানববন্ধন করেছে এ বিষয়ে। তারা চায় না সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার সমান হোক। তাদের এ বিষয়ে বিস্তর যুক্তি আছে। অনেক আশংকা আছে। আতঙ্ক আছে। কিন্তু এ যুক্তি কতটা যৌক্তিক সে বিষয়েও ডিবেট আছে, পক্ষে বিপক্ষে মতামতও আছে।

নিতিদের থেকে অর্থে বিত্তে দীপের বাবা অনেক এগিয়ে। বাবা রাশভারি মানুষ। এক কথার মানুষ। দীপের ধারণা ছেলে সন্তান হবার পরও দীপের ওপর বাবার দুর্বলতা নেই। এমনকি কোনও সন্তানের উপরই নেই। বাবা একটা মহীরুহ হয়ে পরিবারে অবস্থান করছেন। সবাইকে ছায়া দেন কিন্তু তাকে ছায়া দেবার কেউ নেই।

দীপের মা সাধারণ গৃহিণী নন। স্থানীয় একটা গানের স্কুলের অধ্যক্ষ তিনি। সমাজের নানা ধরনের কাজ করে বেড়ান। আবার ঘরকন্যাও সামলান। প্রবল ব্যক্তিত্ববোধ ভদ্রমহিলার। আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে পছন্দ করেন। দীপের থেকে দীপের বোনের প্রতি তার খেয়াল বেশি। বোধহয় একটু বেশিই ভালোবাসেন বোনকে। সাধারণত ছোট সন্তান বা ছেলে সন্তানের প্রতি মায়েদের দুর্বলতা থাকে, এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এমন সব ক্ষেত্রেই ভদ্রমহিলার আচরণের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তিনি শ্বশুর বাড়ি আসর পর নাম নিয়েছেন পার্বতী মজুমদার। আগে পার্বতী বিশ্বাস ছিলেন।

দীপের মামার বাড়ি ফরিদপুর। মামাদের বর্ধিষ্ণু পরিবার। দীপের মাতামহ বড় মনের মানুষ। তারা সাত ভাই। সকলে একসাথে আছেন। বড় বড় হাড়ি কড়াইয়ে রান্না হয়। একসাথে পঞ্চাশ জনের পাত পড়ে। এলাহি ব্যাপার। দীপের দাদু সবার বড় ভাই। তিনিই পরিবারটি এক সুতায় বেঁধে রেখেছেন। অনেক ত্যাগে, অনেক সহনশীলতায়।

দীপের মামারা তিন ভাই। ফরিদপুরের স্থানীয়। বড় দুই ভাই পৈত্রিক পেশা নিয়ে আছে। ছোট ভাই অ্যাভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ার। যার বাসায় দীপ নিতিকে এনে রেখেছে বা নিতি দীপের কাছে এসে রয়েছে। দীপের মামার পরিবারের সবাই কমবেশি শিক্ষিত। তবে ছোটখাটো চাকরি কেউ করেনি। পৈতৃক পেশা ব্যবসাকেই পাথেও করেছে। দীপের বাবা-কাকারাও তিন ভাই। তাদের কেউই চাকরিতে নেই। সবার পৈতৃক জুয়েলার্সের ব্যবসা।

দীপের মেজো কাকার বড় ছেলে দীপের বড়। সেও জুয়েলার্সের ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেছে। ছোটটা অবশ্য পড়ছে। ছোট কাকার দুই ছেলেই ছোট, তারাও পড়ছে। পরিবারে বাবা-কাকার তিন ভাইয়ের ছয় সন্তান। তার মধ্যে দীপের দিদি একমাত্র কন্যা সস্তান। নাম রাখি। রাখি মজুমদার। রাখির অদৃশ্য রাখিবন্ধনে বাঁধা পড়ে আছে সবাই। পরিবারের এক মেয়ে হওয়ায় সকলেই তাকে ভালোবাসে। পরম স্নেহ দিয়ে আগলে রাখে। দীপের দিদি দীপের থেকে মাত্র এক বছর পাঁচ মাসের বড়। সেও অনার্স পড়ে। যশোর সরকারি মহিলা কলেজে। এক মেয়ে হওয়ায় বাবা-কাকার চিন্তা একটু বেশি। দিদি মেধাবী ছাত্রী। তবুও কোনও ভার্সিটিতে পরীক্ষা দেয়নি।

সত্য বলতে, পরিবার থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। রাখি যথেষ্ট স্মার্ট। সুন্দরী ও সুগায়িকা। দিদির জন্য মনে মনে পাত্র খোঁজা চলছে। ঠিকঠাক সম্বন্ধ পেলে দিদির বিয়ের সানাই বাজতে দেরি নেই। ওদিকে নিতির স্কুল শিক্ষক বাবা প্রতিদিনের মতো আজও স্কুলে গিয়েছেন। নিতিশ বাবু ক্লাস শেষ করে সদ্য বের হলেন। শিক্ষকদের বিশ্রামকক্ষের দিকে যাচ্ছেন। এমন সময় সুমন বাবু তার পথ আটকালেন।

তিনি একই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক। একগাল হেসে বললেন, কেমন আছেন? নিতিশ বাবুও হেসে বললেন, ভালো, আপনি কেমন আছেন? সুমন বাবু বললেন, ভালো। এরপর সুমন বাবু গোপন কথা থাকলে মানুষ যেমন করে কাছে এসে দাঁড়ায়, তেমন একটা ভাব করে কাছে এসে দাঁড়ালেন। নিতিশ বাবুর দিকে আন্তরিক চোখে তাকিয়ে বললেন, বাবু এসএসসির ফরম ফিলাপ তো শুরু হয়েছে। নিতিশ বাবু ঘাড় নাড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ। সুমন বাবু আবার বলে উঠলেন, অনেক গরিব ছাত্রছাত্রী তো আছে যাদের টাকা দেবার সামর্থ নেই, যদি এমন কেউ থাকে আমার কাছে আসতে বলবেন। আমি তাদের সাহায্য করতে পারব। জানেনই তো আমার খাওয়ার লোক তেমন নেই। তবে পৈত্রিক সম্পত্তি কিছু আছে। তবে ব্যপারটা একটু গোপন রাখবেন। বেশি ছেলেমেয়ে প্রার্থী হলে আমি আবার দিতে পারব না।

সুমন বাবুর প্রপিতামহ ইংরেজ সরকার থেকে রায়বাহাদুর পদবি পেয়েছিলেন। ছিলেন স্থানীয় জমিদার। তার সম্পর্কে সুনামের চেয়ে দুর্নাম বেশি ছিল। পিতামহের আমলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়। পিতার আমলে যুদ্ধে সমস্ত সম্পদ লুণ্ঠিত হয়। তবে এখনো পুরান পৈত্রিক বাড়িটি আছে, জমিজমাও বেশ আছে। বংশ গৌরব যেমন আছে, তেমন বহুমাত্রিক অন্যায়ের সাথে তার পূর্বপুরুষ জাড়িত। তিনি সেই অপরাধপ্রবণ পূর্বপুরুষের রক্ত বহন করছেন।

প্রকৃতির একটা বিচার থাকে। আজ যে অত্যাচার করে, শোষণ করে, কালের বিবর্তনে তাকেই অন্যের অত্যাচার ভোগ করতে হয় বা শোষিত হতে হয় বা তার উত্তরসূরী তার হয়ে সে অত্যাচার ভোগ করে। প্রকৃতির প্রতিশোধ স্বরূপ পূর্বপুরুষের অর্জিত সম্পদের বেশিরভাগ তছনছও হয়ে গেছে। সুমন বাবু বছর তিনেক আগে বিবাহ করেছিলেন কিন্তু সে বিবাহ অজানা কারণে টেকেনি। এরপরও বিয়ে করবার চেষ্টা করেছেন অনেকবার, তবে এখনো সফল হননি। হাসিখুশি ভালোমানুষ হিসাবে তার সুখ্যাতি আছে।

সাদাসিধা নিতিশ বাবু সুমন বাবুর কথায় খুশি হলেন। আসলেই তো এমন গরিব ছাত্রছাত্রি অনেকে আছে। তারপর বললেন, ঠিক আছে বাবু, তেমন কেউ পেলে আপনার কাছে টাকা আনতে যেতে বলব। দুজনের মধ্যে এতটুকুই কথা হলো। এরপর স্কুলের দুজন শিক্ষক দু`দিকে চলে গেলেন। এদিকে মামার সাথে দীপের দীর্ঘক্ষণ কথা হলো। মামা বলল, মামি বলল, মামাতো ভাইবোন বলল। সকলের সাথে কথা হয়ে যখন ফোনটা ওপ্রান্ত থেকে রেখে দিল, তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। চলবে

৫ মে ২০২০