নিতির গল্প

উপন্যাস ২৪

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ৩০, ২০২০

খালাম্মার মহিলা হোস্টেলে রিমি উঠে গেল। আজ সকালে রমেশ বাবু এসেছিলেন। মেয়েকে রুমে তুলে দিয়ে যশোরের উদ্দেশে রওনা দিলেন। রিমির একার জীবন শুরু হলো। এর আগে কখনো একা থাকেনি সে। বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করেছে। পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গেল। ডিভোর্স হলো। বড় অল্প সময়ে জীবনের সুতোগুলো এক এক করে ছিঁড়ে গেল। স্বপ্নগুলো ধুলোয় মিশে শূন্যে হারিয়ে গেল। বিয়ে জীবনের একটা অংশ হতে পারে, নাও হতে পারে। তাই বলে বিয়ে জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। অথচ বাঙালি মেয়েদের জন্মই যেন বিয়ের উদ্দেশ্যে। স্বামী, সংসার, সন্তান— এর থেকে বেশি কিছু ভাবতে শেখে না অনেকে। এর বেশি কিছু ভাবতেও চায় না। বেশিরভাগ বাঙালি মেয়ের মতো রিমির জীবনটাও বিয়ের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে নষ্ট হয়ে গেল।

রিমি সেই নষ্ট জীবন নতুন করে সাজাতে এসেছে। নতুন করে জীবনের কেটে যাওয়া সুর সাধতে এসেছে। বাঁধতে এসেছে নতুন বীনা। সমস্ত সংস্কার, সমস্ত পশ্চাৎপদতা এক ফুৎকার উড়িয়ে ফেলে জীবনটা যদি নতুন করে বাঁধা যেত, রিমি ভাবছে। রিমির ভাবনায় নিজের সমস্ত অতীতটা ভুলে যাবার প্রত্যয় আছে। নিজের স্বপ্ন নিজের হাতে সত্য করে তোলবার প্রতিশ্রুতি আছে। না, আর বাবার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে না সে। রাখবে না কোনও পিছুটান। বাবা তো অনেক করেছে তার জন্য। ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছে। নিজের সমস্ত সঞ্চয় খরচ করে দেনাপাওনা দিয়েছে। মেয়ের সুখের জন্য যা যা করা দরকার মনে করেছে, তার সবই করেছে। তবুও তো সুখী হলো না সে। না, আর মানুষটার রক্ত চুষে নিজের সুখের জন্য অর্থ ব্যয় করতে দেবে না সে। নিজের চলার মতো, নিজেকে চালিয়ে নেবার মতো কিছু একটা করতে হবে। যে কোন মূল্যে।

আজ ছুটির দিন। শুক্রবার হওয়াতে মেয়েরা সব রুমেই রয়েছে। ওদের ফ্লাটে ছয়জন মেয়ে থাকে। এক একটি রুমে তিনজন করে। একটা বেড খালি ছিল। রিমি সেই শূন্যস্থান পূরণ করল। ছোট ছোট দুটো রুম। রুমের সাথে এটাস্ট ওয়াশরুম, বারান্দা। মাঝে একটা কিচেন, একটু খোলা স্পেচ। চাইলে ডাইনিং টেবিল পাতা যায়, পাতা নেই, কেউ কখনো রাখবে বলেও মনে হয় না। মেয়েরা মন চাইলে নিজের রান্না নিজেরাও করতে পারবে, চাইলে বুয়ার হাতেও খেতে পারবে। একজন রান্নার বুয়া আছে। সকালে সাদা ভাত, মুসুর ডাল, আলু ভর্তা করেছিল, দুপুরে বিফ রান্না হয়েছে। এ ফ্লাটে আগে থেকে যে পাঁচজন আছে তাদের কারো বিফে এলার্জি নেই, স্বাচ্ছন্দ্যে রান্না হতো। ও নতুন সদস্য, আজ ওর কথা ভাবার অবকাশ কেউ পায়নি অথবা ভাবতে চায়নি।

রিমি দুপুরের খারার খেতে এসে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশের মধ্যে পড়ল। একটু মন খারাপও হলো। একটা অভিমান দানা বাঁধল। পরক্ষণেই মনে হলো, কার উপর অভিমান করবে? কোন অধিকারে? অভিমান তো যে ভালোবাসে তার উপরেই করা যায়। ভালোবাসার মানুষটার উপর দাবি করে দু’কথা শুনিয়েও দেয়া যায়। যেখানে ভালোবাসা নেই, যেখানে বন্ধুত্ব নেই, যেখানে সম্পর্কটা সাময়িক প্রয়োজনে সৃষ্ট, একে অপরের বেঁচে থাকার জন্য যেখানে একসাথে থাকা, সেখানে মান-অভিমান, রাগ-ক্ষোভ, এসব বাতুলতা মাত্র। মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব থেকেও যে মানুষটা একটা মেয়ের জীবনে বড় হয়ে ওঠে, সেই মানুষটাই যখন আপন হলো না, কলঙ্ক লাগিয়ে দূরে সরে গেল, তখন আর আপন মানুষ খোঁজার চেষ্টা কেন? তখন আর ভালোবাসার সুতো খুঁজে মালা গাঁথার চেষ্টা কেন? রিমি সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে নিল।

রিমি ভাবতে থাকল, একটা ভিন্ন দেশে বেড়াতে যেয়ে অচেনা কোন হোটেলে উঠেছে সে, নিজের দেশের কোন হোস্টেলে না। বাইরে গেলে বাইরের মতো চলতে হয়, ‘যষ্মিনদেশে যদাচরণ’। মা বলতেন, ‘যেখানে যেমন, সেখানে তেমন। যাকে যেমন, তাকে তেমন।’ দেশের বাইরে গিয়ে সূচিবায়গ্রস্থ হলে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। মেনে নেয়া, মানিয়ে নেয়ার গুণ না থাকলে মানুষ সামাজিক হতে পারে না। সর্বজনীন ভাব গ্রহণ করতে পারে না। জীবনের জন্য ফিটেস্ট হতে পারে না। বলা হয়, সারভাইভাল দ্যা ফিটেস্ট। রিমি এই শহরের উপযুক্ত হয়ে উঠতে চায়। পর্ক, বিফের মতো রেডমিট খায় না এমন একটা পরিবারে জন্ম নেয়ার কারনে রিমির এসব মাংসের স্বাদ কখনো নিতে হয়নি। খাবার সুযোগ হয়নি, প্রয়োজন পড়েনি, এমনকি ইচ্ছাও ছিল না। ইচ্ছাতো সংস্কার থেকেই আসে! সংস্কার বাধা দিলে ইচ্ছাও বাধাগ্রস্থ হয়। যারা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়, তাদের কথা আলাদা। তারা পৃথিবীর সব কিছুর স্বাদ নিতে চায়। তারা জগৎকে তাদের মতো করে চিনতে চায়। সে তো তাদের মতো না।

আজ দুপুরে সবাই যার যার মতো খেয়ে নিল। অন্যেরা বিফের বাটি তুলে নিলেও তাকে কেউ অনুরোধ করল না। আফটারঅল রিমি নতুন, অন্য ধর্মের। ঠাট্টা করেও কেউ কিছু বলল না, এত অল্প সময়ের মধ্যে সেরকম সম্পর্ক কারো সাথে তৈরিও হয়নি। কি করবে সে? দুপুরে খাবে কি? রিমি একটা ডিম ভাজল। সকালের মুসুর ডাল কিছু ছিল, সেটা গ্যাসে গরম নিয়ে নিল। ব্যাচ, ডিম ভাজি, মুসুর ডাল হয়ে গেল, এটা দিয়েই দুপুরের খাবারটা খেয়ে নেয়া যাবে। রিমির মুখে একটা স্বস্তির হাসি ফুটল। রিমি খেতে শুরু করল। সংগ্রাম করতে যখন এসেছে তখন এতটুকু সংগ্রাম তো করতেই হবে। এ তো সংগ্রামের শুরু। বাড়ির বাইরে যখন পা দিয়েছে, তখন আরো অনেক সংগ্রাম, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হবে। নতুবা বাড়ি ফিরে গিয়ে কোন দোজবরের জন্য মালা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। রিমি নতুন করে আর বিয়ের বাঁধনে নিজেকে জড়াতে চায় না। না, অন্তত এখনই না।

ভাত খেতে খেতে তার মনে একটা বিপরীত চিন্তার উদয় হলো। রিমি ভাবতে শুরু করল, কি হবে এই সংস্কার মেনে? কি হবে এই ছুঁৎমার্গে? কি হবে খাদ্যাখাদ্যের শুদ্ধতা বিচার করে? কি হবে এই ধর্ম ধর্ম করে? ধর্ম, সমাজ, সংস্কার এসব বড় বড় বুলি আমাকে কী দিল? একজন স্বামী পরিত্যাক্তা? একজন ডিভোর্সি? একজন একা হয়ে যাওয়া নিঃসঙ্গ মেয়ে? এর থেকে বেশি আর কি দিয়েছে সমাজ? কি দিয়েছে ধর্ম? রিমি খাবারের প্লেট রেখে উঠে গেল। বুয়া তার ব্যপারে পুরোটা জানতো না, শুধু জেনেছে আজ থেকে একটা মিল বেশি হবে, সে ছটা বাটিই করে রেখে চলে গেছে। ওর জন্য রেখে দেয়া বাটিতে কেউ হাত দেয়নি। রিমি বাটিটা নিয়ে এলো। বাটি উপুড় করে তুলে নিল বিফের একটা টুকরো। জন্ম থেকে সংস্কারের কারণে প্রথমে একটু অস্বস্তি হলো, একটা কটু গন্ধ লাগল নাকে, তারপর সব ঠিক হয়ে গেল। বিফের টুকরায় একটা কামড় বসানোর সাথে সাথে, রিমির এতদিনকার সংস্থার, ধর্ম বিশ্বাস, পারিবারিক জড়তা, সব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। এখন পর্ক, বিফ কেন? অন্য কোন অপরিচিত খাদ্যেই রিমির ভেতরের আমি বিদ্রোহ করে উঠবে না। রিমির মন নতুন ভাবে প্রস্তুত হলো। মনটাই তো আসল। খাবার ভেবে গ্রহণ করলে সব খাবারই খাওয়া যায়। মন গ্রহণ না করলে শরীর সে খাবার বমি করে বের করে দেয়। রিমির গা গুলিয়ে উঠল না। সে কূপমণ্ডুকতা থেকে বেরিয়ে বিশ্বজনীন খাদ্যাভ্যাসের একজন টেস্টার হয়ে উঠল। তার নতুন জন্ম হলো। প্রথা ভেঙে মনের কোনে আলোর রেখা ফুটে উঠল। সে আলোয় রিমির জাগ্রত যৌবনে বসন্তের হিমেল বাতাসের শিরশির অনুভূতি এনে দিল। রিমি মুক্ত হলো। জীবনের স্বাধীনতা পেল।

রাধার বন্ধুরা প্র্যাকটিক্যাল খাতা নিয়ে রাধার বাড়ি হাজির। সামনে খাতা জমা দিতে হবে। রাধা খুব সুন্দর ছবি আঁকে। বন্ধুদের ক্লাস নাইনের প্র্যাকটিক্যাল খাতাতেও ও ছবি এঁকে দিয়েছিল। সেই বন্ধুরাই আবার এসেছে। রাধা না করতে পারে না। আবার বন্ধুরাও খালি হাতে আসে না। বন্ধুদের সাথে রাধার এ এক মধুর সমস্যা। কেউ বিস্কুট, কেউ চানাচুর, কেউ চকলেট, কেউ গল্পের বই নিয়ে এসেছে। বন্ধুরা টাকা আনে না। লজ্জা পায়। রাধাও টাকা আনলে নিতে পারতো না। বন্ধুদের থেকে কীভাবে টাকা নেবে সে? প্রকৃতি অনেক নিগুর্ণীকে সুখে রেখেছে অথচ রাধার মতো এমন গুণী মেয়ের জীবনে লিখে রেখেছে একরাশ দুঃখ। বাড়িতে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে দেখে রাহেলা খালা এগিয়ে এলো।
কি ব্যপার রাধারাণী, বন্ধুরা আবার ছবি আঁকাতে এসেছে?
রাধা ঘাড় দুলিয়ে, হ্যাঁ খালা।
তুই এবার এঁকে দিস নে? তুই এঁকে দিবি, আর নাম হবে ওদের, সেটা হবে না। রাহেলা খালা ঠোঁট টিপে হাসল। বন্ধুরাও হাসল। রাহেলা খালার সাথে কিছুক্ষণ খুনসুটি করে খাতা-পেন্সিল রেখে বন্ধুরা চলে গেল।

ছেলেমেয়েদের বন্ধুদেরকে মায়েরা ভালোবাসে। তাদেরকেও সন্তান স্নেহে আদর করে। রাহেলা খালাও রাধার বন্ধুদেরকে ভালোবাসে। ওরা কখনো বাড়িতে এলে রাহেলা খালাও চলে আসে। গল্প করে, খুনসুটি করে, বন্ধুদের কাছে রাধার স্কুলের খোঁজ-খবর নেয়। বন্ধুরা চলে যাবার পর রাহেলা খালা রাধার শরীর সংলগ্ন হয়ে বসল। পাশে বসে নিজের মনে বলে উঠল, জানিস রাধা, দাদি বলতেন, অতি বড় সুন্দরী, না পায় বর। অতি বড় ঘরণী, না পায় ঘর। তুই সুন্দরীও, আবার বড় ঘরণীও, আমার তাই ভয় হয় রে! বাপের বাড়ি তো লাথি ঝেঁটা খেয়ে আছিস? শ্বশুর বাড়িটা ভালো হবে তো! আল্লা তোর জন্য এ কথাটা যেন মিথ্যে প্রমাণ করে। আল্লা ধৈর্যশীলদের পছন্দ করেন, ধৈর্য ধর মা, বুকে বল আন। আল্লা নিশ্চয় তোর ভালো করবেন।

কথা ক’টা বলে খালা চোখ মুছল, ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাধাকে বুকে টেনে নিল। রাধা, খালার বুকে মুখ লুকিয়ে নীরবে কেঁদে উঠল। রাধার চোখের জলে খালার বুক ভিজে গেল। চলবে