
নিতির গল্প
উপন্যাস ২৫
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : মে ৩১, ২০২০
কিরে গণেশ, আজ এত দেরি করে এলি?
একটা সিগারেট দে তো রবিউল।
রবিউল সিগারেট দিলে গণেশ সিগারেটটা ঠোঁটের ফাঁকে রাখল। রবিউল লাইটার বের করে সিগারেটটা ধরিয়ে দিল। তারপর বলে উঠল, কিরে, বললি নাতো, এত দেরি হলো কেন?
আর বলিস নে। সোনাপট্টির দীপেন বাবু আছে না?
আছে, তাতে কি হয়েছে?
ওর বউ, পার্বতী মজুমদার। একটা গানের স্কুল চালায়।
চালায়, তাতে কি?
ও এসেছিল, ঠাকুরের সামনে একঘটি কাঁদল।
আমি তো জানতান ও ঠাকুরটাকুর মানে না, সেকুলার।
আরে না, সেকুলার হলে তো ভালোই হতো, ওরা ধান্দাবাজ।
সে কি রে, দীপেন মজুমদার তোর মন্দিরের সভাপতি না?
হ্যাঁ, তো কি? সভাপতি হলেই সবাই ধার্মিক হয় নাকি? এরা বাবুগিরি করতে চায়, সমাজে নাম কিনতে চায়, কোনও ভক্তিশ্রদ্ধা আছে?
ভূতের মুখে রামনাম। তুই মন্দিরের পূজারি, তোর মনে ভক্তি নেই, ভক্তি থাকবে সভাপতির মনে!
গণেশ চাটুয্যের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। এরপর ফিক করে হেসে বলল, দেখ, আমি পেটের দায়ে এসব করি, তোর মতো মোটরসাইকেলের ডিলারশিপ থাকলে কবেই ও পাট চুকিয়ে দিতাম।
তা আয়, আমার এখানে ম্যানেজারি কর।
তা আর হয় না রবিউল। বাপের আমলের কিছু শিষ্য সাগরেদ আছে, আমারও কিছু জুটেছে, তারা ভক্তিশ্রদ্ধা করে, এসব ফেলে আসব কি করে? আর মন্দিরের প্রণামী, শিষ্যদের দক্ষিণা, এসব মিলে আয়-রোজগারও তো একেবারে কম হয় না।
রবিউল হেসে ফেলল। এভাবে অকপটে সত্য কথা খুব কম মানুষই বলতে পারে, এজন্য অনেক দোষ থাকলেও গণেশকে তার ভালোলাগে, দোষে গুণেই তো মানুষ। যেমন আলো থাকলে আঁধার থাকবে, দিন থাকলে রাত থাকবে, তেমনি মানুষের গুণ থাকলে তার দোষও থাকবে, আবার দোষ থাকলে গুণও থাকবে। এর থেকে কেউ বের হতে পারে না। না আমি পারি, না গণেশ পারে। রবিউল এসব ভাবতে ভাবতে গণেশের পিঠে আলতো করে একটা চর মেরে বলল, তা ঠাকুর, তুমি যে এখানে এসে চুপিচুপি সিগারেট খাও, এটা তোমার শিষ্যরা জানলে তখন কি হবে?
শিষ্যদের গুরুর উপর বিশ্বাস আছে, তারা অত খোঁজখবর করবে না।
না করলেই ভালো। তা পার্বতী মজুমদার কি শুধু কান্নাকাটিই করল, না আরো কিছু করেছে?
অই, মানুষ মন্দিরে এসে যা করে, মেয়ের নামে পুজো দিল, মানসা করল, আমার কাছ থেকে জপের মালা নিয়ে গেল।
বলিস কি? এত একশো আশি ডিগ্রি টার্ন নিয়েছে।
তাই তো বলছি। এবার জব্দ হয়েছে ব্যটারা, আমার বেতন দেয় মাসে আড়াই হাজার টাকা। তুইতো জানিস, এ দিয়ে সংসার চলে?
আরে ঠাকুর, আমার মতো ওরাও জানে, তোমার সংসার কিসে চলে?
তাই বলে বেতন দেবে না?
তুমিতো বিনা বেতনেও থাকবে, সে কি ওরা জানে না?
বাদ দে এসব কথা, আরেকটা সিগারেট দে, রাত হয়ে যাচ্ছে।
বাদ দিলাম। নে আরেকটা টান দে।
গণেশ চাটুয্যে সিগারেট টানা দিয়ে মনে মনে বলে উঠল, বেশ হয়েছে, এবার বোঝ ঠেলা। তারপর রবিউলের দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝলি রবিউল, শহরের যা ভাবগতিক দেখছি, তাতে হিন্দুদের আইবুড়ো মেয়ে আর থাকবে না। বিয়ে পড়িয়ে এবার বেশকিছু টাকা হাতে আসবে মনে হচ্ছে।
বিয়ে বেশি হবে, না পাসপোর্ট বেশি হবে সে দুদিন গেলেই বুঝতে পারবি। দূর্গা কর্মকার, অই যে পাসপোর্ট ভিসা করিয়ে দেয়, বিকেলে এসেছিল। ব্যাটা খোশমেজাজে আছে। আজকেই নাকি কুরি বাইশটা পাসপোর্টর অর্ডার পেয়েছে। কাগজপত্র ফটোকপি করছিল সামনের দোকানে। আমি চা খেতে ডাকলে এসে বসল। তখনই শুনলাম।
কি বলিস, তাহলে তো আমার গুড়ে বালি!
তাইতো বলছি ঠাকুর, এখনই অত নেচো না, দেখো কি হয়।
গণেশ চাটুয্যে মুখে হাত দিয়ে ভাবতে থাকল। রবিউল বন্ধুকে বসিয়ে রেখে প্রচ্ছাপ করতে পাশের বাথরুমের গেট খুলে ভেতরে ঢুকল। হিউম্যান সাইকোলজি বড় বিচিত্র। মানুষ যে কিসে খুশি হয়, আর কিসে হয় না, তা সে নিজেও হয়তো বুঝতে পারে না। এই যে গণেশ চাটুয্যে, রাখি পালিয়ে যাওয়ায় তার দুঃখ পাওয়ার কথা ছিল, অথচ সে তা পাচ্ছে না। বরং একটা পৈশাচিক আনন্দে তার হৃদয় নাচছে, আবার সে তার সুখ-দুঃখ কিছুই পাওয়ার কথা না। কিন্তু সে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। পরিচিত একটা পরিবার ঝড়ের কবলে পড়লে, প্রতিবেশি তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটাই চিরন্তন নয়। চিরন্তন যে কি, তা হয় তো কেউ জানেই না।
আবার পার্বতী মজুমদার, ধর্মনিরপেক্ষতার একটা মুখোশ আছে তার। সেটা যে মুখ ছিল না, মুখোশ ছিল, সংকটকালে সেই সত্য বড় তীব্র ভাবে উন্মোচিত হচ্ছে। হয়তো এ ধরনের পরস্পর বিরোধী আচরণকেই বলে দ্বিচারিতা। বাঙালি মনস্তত্ত্বে এই দ্বিচারিতার প্রভাব বড় ভয়াবহ। আমরা ঠিকঠাক ধার্মিক কিংবা ঠিকঠাক সেকুলার, কিছুই হয়ে উঠতে পারি না। এসব বিক্ষিপ্ত চিন্তা করতে করতে রবিউল বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। তখনো গণেশ চাটুয্যে বসে আসে। বেশ রাত হয়ে যাচ্ছে। শেষ সিগারেটটা ধরিয়ে আনমনে দুই বন্ধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল।
এদিকে রাখি যখন চোখ মেলে তাকাল, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সে একটা হাসপাতালের বেডে সে শুয়ে রয়েছে। হাসপাতালের রঙচটা নোংরা ওয়ার্ডে তার পাশে আরো অনেকে আছে। পুতিগন্ধময় পরিবেশ, যন্ত্রণায় কাতরানো মানুষের বেদনার শব্দ ভেসে আসছে কানে। চোখ মেলে তাকানোর কিছুক্ষণ পর একজন নার্স এগিয়ে এল,
এই তো জ্ঞান ফিরেছে। কথা ক‘টা বলে একটু ম্লান হাসতেই, সে হাসি মুখের গোড়ায় মিলিয়ে গেল। তারপর বলে উঠল, অনেক বাঁচা বেঁচে গেছেন, পাশে ডোবা না থাকলে কি যে হতো?
রাখি যেন কিছু মনে করতে পারছে না। চোখেমুখে উদাস ভাব। বলল, আমার কি হয়েছেল? আমি হাসপাতালে কেন?
আপনার মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছেন। ছিটকে ডোবার পানিতে পড়ায় আঘাত গুরুতর হয়নি। সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলেন, এখন তো সেন্স চলে এসেছে, আর চিন্তা নেই ।
রাখির হঠাৎ করে স্মৃতি ফিরে এল। একে একে মনে পড়তে থাকল সব কথা। বাড়ি থেকে বেরনো, আয়ানের বাইকে ওঠা, দুর্ঘটনা, সব মনে পড়ছে। আয়ান প্রচণ্ড জোরে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল, যেন কেউ ওদের তাড়া করছে। রাখি কয়েকবার আস্তে-ধীরে চালাতে বললেও, ও কথা শুনছিল না। আয়ানের কনফিডেন্স ছিল খুব বেশি। হঠাৎ একটা ট্রাক মোটরসাইকেলের সামনে চলে এল। আয়ান সামলাতে পারল না। তারপর সব অন্ধকার। রাখি যেন লাফ দিয়ে উঠল। তারপর অনেকটা নিজের উপর জোর খাটিয়ে বলে উঠল, আয়ান, আয়ান কোথায়? সিস্টার, আয়ান কোথায়?
সিস্টার কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল, তারপর বলল, আপনি শান্ত হোন, সে ভালো আছে, অন্য ওয়ার্ডে আছে।
ওর সাথে দেখা করা যাবে না? আমার, আয়ানের সাথে দেখা করা খুব দরকার।
না, এখনই না, দু`দিন যাক, আপনি সুস্থ হয়ে নিন, সেও সুস্থ হয়ে নিক, তারপর।
ওর কি খুব লেগেছে? বিপদের কিছু হয়েছে?
সিস্টার মাথা নাড়াল। মুখে বলে উঠল, না, না, সে ভালো আছে, আপনি উত্তেজিত হবেন না।
রাখি তবুও শান্ত হতে পারল না, মনের মধ্যে একটা উত্তেজনা, একটা দোটানা চলতে থাকল। শেষে ক্লান্ত হয়ে বেডের উপর মাথা রেখে দুচোখ বুজল।
মহম্মদপুর বাজারে যে কটা বড় বড় মুদি দোকান আছে, গৌরীশঙ্কর দত্তের দোকানটা তার মধ্যে সব থেকে ভালো পজিশনে। একেবারে বাজারের মধ্যিখানে। প্রচুর বেচাকেনা, কাঁচা টাকা হরদম ক্যাশবাক্সে জমা হচ্ছে। গৌরী বাবুর অবস্থা আগে তেমন ভালো ছিল না। স্ত্রী ভাগ্যে ধনবান বললে বেশি বলা হবে না। বিয়ের পরপরই সম্পদ বাড়তে থাকল। দুই মেয়ে হলো, বাড়ি হলো, বড় দোকান হলো, মেয়েরা মানুষ হলো। বড় সুখী মানুষ আমাদের গৌরী বাবু। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। সে সুখেই আছে। জামাই বিএ পাশ করে কোম্পানির চাকরিতে দু`হাজার টাকার মাইনেই ঢুকে, এখন মাসে দু`লাখ টাকা রোজগার করছে। ছোট মেয়ে বুয়েট থেকে এমএস করে একটা সরকারি ভার্সিটির লেকচারার হয়েছে। দোকান পরিচিত কেউ গেলে, গৌরী বাবু তাকে আদর করে চেয়ারে বসাবেন। তারপর একে একে জামাইয়ের কথা, ছোট মেয়ের কথা উঠে আসবেই। এমন মেয়ে কি সাধারণ মেয়ে মশাই! বুয়েটের এম এস! শোনা যাচ্ছে মেয়ে এমফিল করছে এখন।
রাখির সাথে ডা. সুনন্দের বিয়ে ভেঙে গেলে নন্দ বাবু বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। ইচ্ছা ছিল না প্রস্তাবটা দেওয়ার, তবু হাটতে হাটতে গৌরীশঙ্কর বাবুর দোকানে গেলেন। দোকানে ঢুকতেই গৌরূ বাবু বলে উঠলেন, আরে নন্দ বাবু যে, সূর্য কোনদিক থেকে উঠল, গরীবের ঘরে স্বয়ং নন্দ বাবু এসে হাজির, বসেন বসেন। গলার স্বর উঁচুতে তুলে বললেন, এই ভরত, চেয়ারটা মুছে দে, কী খাবেন বলেন, একটা কফি আনায়?
নন্দ বাবু না হেসে পারলেন না। তিনিও ঘাঘু মাল। মানুষ চড়িয়ে খায়। সারের ডিলারশিপ নিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করছে এই থানাতে। গৌরী বাবুর অতিভক্তি ধরতে পারলেন, তবে মুখে কিছু বললেন না, বরং বলেন, আরে ব্যস্ত হবেন না গৌরী বাবু, আমাদের ধুলোবালির ব্যবসা, এ চেয়ারে বসতে কোন অসুবিধা হবে না। একটু গলা চড়িয়ে বললেন, ভরত, পারলে দুটো রং চা নিয়ে এসো, ওসব কফি-টফির দরকার নেই।
নন্দ বাবু অনেক্ষণ বসলেন। কথা যা হলো তার নব্বই ভাগই গৌরী বাবুর ছোট মেয়েকে নিয়ে। সবই ছোট মেয়ের প্রশংসা। অনেক ধৈর্য ধরে, একপ্রকার উপযুক্ত মেয়ের অভাবের কথা মাথায় রেখেই নন্দ বাবু প্রস্তাবটা রাখলেন। গৌরী বাবু এ কথা শুনে কেন জানি একটু বিমর্ষ হয়ে গেলেন। পরমুহূর্তেই রূপ বদলে বললেন, এ তো ভারী আনন্দের কথা, আমি আজই জামাইয়ের সাথে আলাপ করব, ওর মাকেও জানাব, তারপর সব ঠিক হবে, হাজার কথা না হলে তো বিয়ে হয় না, কি বলেন আপনি?
হ্যাঁ, তাতো অবশ্যই, এখনই না, বাকী কথা পরে হবে, আপনি ব্যস্ত হবেন না। নন্দ বাবু বললেন।
নন্দ বাবুর মনে কেন জানি একটু খটকা লাগল। বয়সটা তো আর কম হলো না, মুখে সে ভাব আনলেন না। মনের ভাব মনেই রেখে, হাসিমুখে গৌরীশঙ্কর দত্তের দোকান থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলেন। চলবে