
নিতির গল্প
উপন্যাস ২৬
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুন ০১, ২০২০
মানুষের জীবন থেকে সময় বড্ড দ্রুত পালিয়ে যায়। এর মধ্যে একমাস চলে গেল। বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। চারদিকে গাছপালা বৃষ্টির জলে সতেজ হয়ে উঠেছে। বসন্তে একবার গাছে কচি পাতা আসে, বর্ষায় নতুন করে কচি পাতার দল আনন্দ কলরবে মেতে উঠেছে। নতুন সবুজের আগমনে গাছে গাছে প্রাণের উৎসব, জীবনের জয়গান।
নিতিদের বাড়ির পাশের নদীটি জলে টইটম্বুর। আগে যেখানে গেলে পায়ের পাতা ভিজতো, এখন সেখানে গলাজল। নবগঙ্গায় নবিন জলের জোয়ার এসেছে। জেলেদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। প্রতিদিনই একটু একটু করে নদীতে জল বাড়ছে, অথচ কখনোই জলকে বিপদজনক মনে হচ্ছে না। বরং একজন নিকট আত্মীয় বাড়িতে এলে যেমন আনন্দ হয়, জল বাড়ায় তেমনি আনন্দ হচ্ছে।
নিতিশ বাবু হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে বাড়ি চলে এসেছেন। নিতি বাড়িতেই রয়েছে, বাবার দেখাশোনা করছে। বাবা এ ধাক্কায় বেঁচে গেলেও মানসিক ভাবে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। হয়তো কখনো হতে পারবেনও না, মনের কোণে পঙ্গুত্বের অসহায় যন্ত্রণা তাকে আমরণ কুড়ে কুড়ে খাবে, যন্ত্রণায় দগ্ধ করবে। একা হাঁটতে পারেন না তিনি। ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছেন, সেখানেও সাহায্য করার মানুষ লাগে। স্থায়ী পঙ্গুত্ব একটা অভিশাপ। যে পঙ্গু হয়, শুধু সে নয়, তার পুরো পরিবারটিই এই পঙ্গুত্বের ভার বহন করে। জীবনে বাটারফ্লাই ইফেক্ট শুরু হয়। একের পর এক আঘাত আসতে থাকে। আঘাত সামলাতে সামলাতেই মানুষটি হিমসিম খায়। সুস্থভাবে বাঁচার স্বপ্ন আর মাথাতে আসে না।
এদেশে দুর্ঘটনার হার পৃথিবীর অন্য যেকোন দেশের থেকে বেশি। রাস্তায় অব্যবস্থাপনা, ড্রাইভারের প্রশিক্ষণের অভাব, পরিবহন সেক্টরের অদক্ষতা, অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণ, সব মিলিয়ে রাস্তা যেন এক মৃত্যুফাঁদ, জীবন্ত বিভীষিকা। প্রতিদিন নিয়ম করে মানুষ মারা যাচ্ছে। অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে, সম্পদের ক্ষতিসাধন হচ্ছে। অথচ পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। বরং দিন দিন তা মন্দ থেকে অরো মন্দের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর থেকে মুক্তি নেই, এই অব্যবস্থাপনার মধ্যে কেউই নিরাপদ নয়।
মানুষ সুস্থ থাকতে বোঝে না, জীবনে সুস্থতার মূল্য কতখানি। অর্থ, সম্পদ, সম্পর্ক কোনও কিছু দিয়েই একজন পঙ্গু রোগীকে সুখী করা যায় না। তার স্থায়ী অসুখের রেশটা ক্রমে পরিবারের সবার মাঝে সংক্রমিত হয়। সবাই ক্রমাগত সংগ্রাম করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে। একটা সময় অই পঙ্গু ব্যক্তিকে পরিবারের বোঝা মনে হয়, এমনকি পঙ্গু ব্যক্তি নিজেও হীনমন্যতায় ভোগে, অন্যের গলগ্রহ মনে করে। নিতিশ বাবুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মানুষটা এরই মধ্যে খিটখিটে হয়ে গেছে। অল্পতেই রেগে যাচ্ছেন। মুখে হাসি নেই, নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন। একদিকে আকণ্ঠ দেনায় ডুবে আছেন, তারপর অসুস্থতা, পঙ্গুত্ব, সবমিলিয়ে পৃথিবীটা নিতিশ বাবুর কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তিনি বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছেন না। সম্পর্কগুলোকে স্বাভাবিক করতে পারছেন না। ভেতরে ভেতরে তার প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
মা আগের মতোই ঘর সংসার সামলাচ্ছেন। ভাই স্কুলে যাচ্ছে। কিছুদিন পর নিতিশ বাবুকেও ক্রাচে ভর দিয়ে স্কুলে যেতে হবে। এমপিওভুক্ত স্কুল, না গেলে চাকরি থাকবে না। তৃণমূলের যে শিক্ষকরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের সুযোগ-সুবিধা সবচেয়ে কম। কোনও রকমে বেঁচে আছে তারা। নিতান্ত বাধ্য না হলে এ ব্যবস্থার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে চায় না কেউ। শেষ পর্যন্ত যারা যুক্ত হয়, তারাও এক সময় মনোবল হারিয়ে ফেলে। অনেকে পরিবারে স্বাচ্ছন্দ আনতে কোচিং, প্রাইভেটের দিকে এগিয়ে যায়, ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে না, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয় শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষকের মনের মধ্যে আনন্দ না থকলে ছাত্রদের আনন্দ প্রদান করবে কি করে? সুযোগ সুবিধাহীন নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন যাপন করা শিক্ষকেরা নিরানন্দের জীবন কাটিয়ে আনন্দের ফেরিঅলা হয়ে উঠতে পারে না। পারে না বলেই ক্রমশ উৎসাহহীন, নিরানন্দ একটা শিক্ষাব্যবস্থার জাঁতাকলে পড়ে কোমলমতি শিশুরা পিষ্ট হচ্ছে। জাতীয় জীবনে তার প্রভাব পড়ছে। কিশোর অপরাধ বাড়ছে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। এমনকি উন্নত, উদার, ক্রিয়েটিভ সামাজিক মস্তিষ্ক গড়ে উঠছে না দেশে। অন্তঃসারশূন্য একটা জাতিতে পরিণত হচ্ছে দেশ। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গবেষণায় দেয়া দরকার। তা না হলে একসময় জাতীয় মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে।
অনেকক্ষণ ধরে অবিন্যস্তভাবে নানা কথা ভাবার পর নিতির মনে হচ্ছে, এত কিছু ভেবেই বা সে কি করবে? তার যা ক্ষতি হবার সে তো হয়েই গেল। এ ক্ষতি আর কখনোই পুষিয়ে নেয়া যাবে না। হয়তো কোনও ক্ষতিই পুষিয়ে নেয়া যায় না। আমরা ক্ষতি পুষিয়ে নিলাম ভেবে নিজের মনে সান্ত্বনা দিই মাত্র। এটা এক ধরনের হিপোক্রেসি, নিজের সাথে নিজের। সজ্ঞানে নিজেকে নিজেই প্রতারিত করা। এভাবে বাড়িতে আর কতদিন থাকবে? নিজেকেও ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। পড়াশোনার যে ক্ষতি হলো, বেশি পরিশ্রম করে তাকে একটা জায়গায় নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। সময় বয়ে যাবে, কিন্তু সবকিছু কি আগের মতো হবে? হবে না। নিতি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, আগের ছন্দে তার জীবন আর কখনোই ফিরবে না।
এই একমাস দীপের সাথে কোনও যোগাযোগ নেই। যেদিন দীপের দিদিকে দেখতে আসার কথা ছিল, সেদিন সন্ধ্যার পর দীপকে ফোন দিলেও দীপ ফোন ধরেনি। তারপর থেকে দীপের ফোন বন্ধ। দীপ যোগাযোগ করেনি, নিতির পক্ষেও দীপের বাড়ি যেয়ে খোঁজখবর নেওয়াটা সমীচীন মনে হয়নি। দীপের পরিবারের কারো সাথে তার তেমন পরিচয়ও নেই, যে সূত্র ধরে সে যেতে পারতো। এক প্রকার অনিশ্চয়তা, মানসিক পীড়ন, হতাশা নিতিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। নিতির পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।
রাখিরা দুর্ঘটনায় পড়ার পর স্থানীয় লোকজন ওদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। অ্যাক্সিডেন্টাল কেস, হাসপাতাল থেকে থানায় খবর দেয়া হয়। থানা থেকে পুলিশ এসে তদন্তের স্বার্থে আয়ানের মানিব্যাগ চেক করে। আয়ানের ড্রাইভিং লাইসেন্সে বাড়ির ঠিকানা যশোর দেখে, যশোর কোতোয়ালিতে যোগাযোগ করে। যশোরের পুলিশ এমনিতেই তাদেরকে খুঁজছিল। খোঁজ পাবার পর রাখি আয়ানের পরিবারকে সংবাদটা পৌঁছে দেয়া হয়। আয়ানের বাবাকে লকাপ থেকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছিল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। ওখানে ওরা কেন গিয়েছিল তা জানা যায়নি। হয়তো দূরে কোথাও কিছুদিন পালিয়ে থাকতে চেয়েছিল। দুর্ঘটনা সেটা হতে দিল না। দীপদের যশোর থেকে উল্লাপাড়া যেতে মধ্যরাত হয়ে গিয়েছিল। সেই রাতেই ওরা রাখিকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলে। যশোর পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে যায়। বাড়ির সকলের ইন্ডিয়ান ভিসার মেয়াদ ছিল। রাখিকে উন্নত চিকিৎসা করানোর কথা বলে পরদিনই বেনাপোল বর্ডার ক্রস করে ইন্ডিয়া নিয়ে আসে। বাড়ির সবার ব্যবহার ছিল স্বাভাবিক। রাখিকে কোনও জেরা করা হয়নি। রাখির সাথে দুর্ব্যাবহারও করা হয়নি। ভারত যাত্রায় পরিবারের বাকি সদস্যরা রাখির সঙ্গী হয়েছিল।
দু`দিন পরে অনেকটা সুস্থ হয়ে আয়ান বাবার সাথে যশোর চলে আসে, তারপর এই একমাস ধরে সে বাড়ির বাইরে যায়নি। নিজেকে একপ্রকার স্বেচ্ছা গৃহবন্দি করে রেখেছে। যে মেন্টাল শক সে পেয়েছে, তা যে তাকে আরো অনেকদিন তাড়া করে বেড়াবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। রাখির আপত্তি করার কোনও সুযোগ ছিল না। পারিবারিক চাপে কলকাতা থেকে চিকিৎসা নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে বারাসাত চলে আসতে হলো। দীপেন বাবু রাখির পাসপোর্ট নিজের কাছে সরিয়ে রাখলেন, এরপর একদিন শুভ লগ্নে ধুমধাম করে রাখির বিয়ে হয়ে গেল। রাখির বর পছন্দ করার কোনও সুযোগ ছিল না। প্রতিবাদ করারও কোন উপায় ছিল না। কলের পুতুলের মতো তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো। একটা অজানা অচেনা পুরুষকে জীবন সঙ্গী করে তার হাত ধরে শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হলো।
এই একমাস ধরে দীপেন বাবুরা বারাসাতেই রয়ে গেলেন। শীঘ্র দেশে আসার কোনও লক্ষণও দেখা গেল না। পার্বতী দেবীর গানের স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। দীপেন বাবুর সোনার দোকান তালা বন্ধ থাকল। পার্বতী দেবীর বাবা রাখির পালানোর কথা শুনে সেই যে হাসপাতালে গেলেন, বৃদ্ধ আর সুস্থ হলেন না, সবাইকে কাঁদিয়ে একপ্রকার চাপা অভিমান নিয়েই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। এই সংবাদ পার্বতী দেবীকে দেয়া হলো না। তিনি মেয়ের বিয়ে নিয়ে যেমন আছেন, তেমনি ব্যস্ত থাকলেন। বৃদ্ধ মারা যাবার পনেরো দিন না পেরোতেই শ্রাদ্ধের দিন ভায়ে ভায়ে কথা-কাটাকাটি করতে দেখা গেল। ভোজের দিন পার হলে সেই মান-অভিমান বিরোধে রূপ নিয়ে, অত বড় পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। শেকড় উপড়ে আগের যৌথ পরিবারের গৌরব হারিয়ে তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবারে রূপান্তরিত হলো।
রাধার এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। যতটা ভালো হবার কথা ছিল, তার থেকে অনেক বেশিই ভালো হচ্ছে পরীক্ষা। রাহেলা খালার গরুর বাছুর হয়েছে। এই এক মাস খালা রাধাকে এক গ্লাস করে দুধ দিয়ে যাচ্ছেন। দুধ জ্বাল দিয়ে গ্লাসে করে এনে নিজের হাতে খাইয়ে যান। দু`টো একটা কথা বলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার দোয়া করে, ভরসা দিয়ে, বাড়ি ফিরে যান।
নন্দ বাবু যে ভরসা নিয়ে গৌরীশঙ্কর বাবুর দোকানে গিয়েছিলেন, সেটা হলো না। পাত্র ন্যূনতম একজন ভার্সিটির লেকচারার না হলে গৌরী বাবু মেয়েকে বিয়ে দেবেন না। নন্দ বাবুর এক বন্ধুর কাছে তিনি বলেই ফেলেছেন, মেয়ে এমএস করে এমফিল করছে, ছেলে কেবল এমবিবিএস পাশ করেছে, মেয়ের থেকে অল্পশিক্ষিত হয়ে যাচ্ছে না! বন্ধুটি সে কথার কোনও উত্তর দেয়নি। হয়তো দেবার প্রয়োজন মনে করেনি। ডা. সুনন্দ, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, বুয়েটে পরীক্ষাই দেয়নি। ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হবার, লক্ষ্য ঠিক রেখে মেডিকেলেই অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছিল, লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। এখন সরকারি মেডিকেল অফিসারের চাকরির পাশাপাশি মেডিসিনে এফসিপিএস করছে, দু-এক বছরের মধ্যেই কমপ্লিট হয়ে যাবে।
বুয়েটের শেষের সারির একটা সাবজেক্টে পড়ে তৃতীয় গ্রেডের একটা সরকারি ভার্সিটির লেকচারারের কাছে যদি ডা. সুনন্দ অযোগ্য হয়, তবে কিছু বলার থাকে না। অর্ধশিক্ষিত গৌরীশঙ্কর দত্ত আর তার পরিবারের উপর বনেদি পরিবারের নন্দ বাবুর ঘৃণা জন্মে গেল। অযোগ্য, অর্ধশিক্ষিত লোকের আস্ফালন তার মোটেও ভালো লাগল না। নিজেকে চরম অপমানিত বোধ করলেন। রিমি এই একমাসে বেশ ধাতস্থ হয়ে গেছে। রুমমেটদের সাথেও তার যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তার এক রুমমেট রিক্তা ঢাকার একটা শপিং মলে পার্টটাইম সেলস গার্লের কাজ করে। তাকে ধরে রিমিও সেলস গার্লের একটা কাজ যোগাড় করে নিল। বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা, চারঘন্টা। মঙ্গলবার ছুটি। সেখান থেকে যে টাকা পাবে তা দিয়ে তার থাকা খাওয়া কোনোরকমে চলে যাবে। একান্ত দরকার না হলে বাবার কাছে সে আর টাকা চাইবে না। রিমি নিজেকে সবরকমভাবে মানিয়ে নেবার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। রিমি খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে, সংগ্রাম ছাড়া আর যাই পাওয়া যাক, এদেশে নারীর স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। চলবে