নিতির গল্প

উপন্যাস ২৯

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুন ০৪, ২০২০

দীপের কণ্ঠ শুনে নিতির শ্বাস কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিতে সময় লাগল। কান্না পেল, দুচোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ল। কি বলবে নিতি? এখন কি বলতে পারে? এই কয়েক মাস তার জীবনের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেল, তার কোনও খবর রাখল দীপ? ও কেন এমন করল?

দীপ বলে চলেছে, নিতি শুনতে পাচ্ছ আমার কথা? আমি এইমাত্র জেল থেকে ছাড়া পেলাম।
নিতির বুক কেঁপে উঠল। জেল থেকে ছাড়া পেলাম মানে? দীপ কি জেলে গিয়েছিল? কেন? কীভাবে? এক মুহূর্তে হাজারটা প্রশ্ন মাথায় এলেও কিছু বলতে পারছে না নিতি। কানে মোবাইলটা ধরে সে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। একটু ধাতস্থ হলে নিতি বলে উঠল, জেলে গিয়েছিলে মানে! জেলে কেন?

দীপ বলে চলেছে, কেন জেলে গিয়েছিলাম সেটা বলছি, তার আগে একটু শোন, তুমিতো জানও তোমার ফোন সেদিন ধরতে পারিনি, এমনকি তোমাকে ফোন দিতেও পারিনি। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, ফোন দেয়ার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। দিদিকে দেখতে আসার দিন ও আয়ান নামে একটা বখাটে ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে সাংঘাতিক অবস্থা, কারো খাওয়া ঘুম ছিল না।

দীপের কথা শেষ না হতেই নিতি বলল, দিদি পালিয়ে গিয়েছিল? তুমি জেলে, কি বলছ এসব? এতকিছু ঘটে গেল, আমি কিছু জানি না? নিতির চোখেমুখে উৎকণ্ঠা।

তোমাকে বলব কি করে? সে মানসিক অবস্থা কি ছিল, না সিচুয়েশনে তেমন ছিল? একটা ভ্যাগাবণ্ড ছেলে, চালচুলো নেই। এমনকি, নাম শুনে তো বুঝতে পারছ? কি বলব আমি?
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি!
আমরা খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। পুলিশও খুঁজছিল। হঠাৎ থানা থেকে খবর এলো, উল্লাপাড়ার রাস্তায় ওদের মটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
কী বলো, অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল? কী সাংঘাতিক! এত দুর্ঘটনা একসাথে?

হ্যাঁ, ট্রাকের কোণায় বাড়ি খেয়ে পাশের ডোবায় পড়ে না গিয়ে গাছপালার সাথে ধাক্কা লাগলে হয়তো বাঁচত না। আমরা উল্লাপাড়া থেকে দিদিকে নিয়ে অ্যাস্বুলেন্সে করে যশোর চলে আসি। সেখান থেকে পরদিন সকালে কলকাতা নিয়ে গিয়েছিলাম।
কলকাতা কেন? নিতির কথায় বিস্ময়!
চিকিৎসার দরকার ছিল, তাছাড়া এখানে কি আর বিয়ে দেয়া যেত? একটা দুশ্চিন্তাও ছিল আবার যদি পালিয়ে যায়। আমাদের তো সমাজে মুখ দেখানোর উপায় নেই, মানুষজন ছি ছি করছে, শহরে মুখরোচক গল্প ছড়িয়েছে। কি করার ছিল আর?
হ্যাঁ, তা ঠিক, ব্যপারটা খুবই সেনসেটিভ। আচ্ছা দিদি এমন করলো কেন?
কে জানে? এতটা বোকা দিদি, এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন, ভাবতেই পারছি না?
আচ্ছা দিদির বিয়ে কি কলকাতাতেই হয়েছিলে, না অন্য কোথাও?
না, কলকাতায় সাতদিন থেকে, পরে দিদিকে বারাসাত নিয়ে আসে বিয়ে দেবার জন্য।
ও বেশ, তারপর কি হলো? তুমি জেলে গেলে কিভাবে?
জেলে বলা যায় কলকাতায় পৌঁছেই গিয়েছিলাম।
কি বলে?
হ্যাঁ, প্রথমদিনই দুর্ঘটনাটা ঘটল। আমি শিয়ালদা রেলস্টেশনে নেমে ট্যাক্সি খুঁজতে একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমার কাঁধে যে ব্যাগটা ছিল তাতে আমার পাসপোর্ট, কিছু টাকাপয়সা ছিল। ট্রেনে তো খুব ভিড় হয়, পকেটমার হতে পারে এই ভেবে মোবাইল মানিব্যাগটাও ব্যাগেই রেখেছিলাম। একটু বেখেয়াল হয়ে গিয়েছিলাম বোধহয়! ছিনতাইকারীরা চোখের নিমিষে ব্যাগটা নিয়ে পালালো। আমি ট্যাক্সি নিয়ে ফেরত এসে ওদেরকে তুলে দিয়ে থানায় গেলাম অভিযোগ করতে, উল্টো অনুপ্রবেশকারী বলে আমাকেই লকাপে পুরে দিল।
কি বলো, এটাতো জঘন্য ব্যপার, তারপর কি হলো?
থানা থেকে আত্মীয়ের বাসায় যোগাযোগ করেছিল, বাবাকে নিয়ে ওরা এসেছিলও, পাসপোর্ট তো দেখাতে পারলাম না, পুলিশও শুনল না। কেস কোর্টে তুলল।
তারপর! তারপর কি হলো?
তখন দিদিকে হাসপাতালে নিতে হবে, দিদিকে শীঘ্র বিয়ে দিতে হবে পাশাপাশি আমার কেস। আমার ব্যাপারে চেষ্টা করেও পরিবার থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করতে পারল না।
দিদির বিয়ে তোমাকে ছাড়াই হলো?
কি আর হবে? দুর্ভাগ্য! আমার থাকা হলো না। দিদির বিয়ের পর বাবা বাংলাদেশ হাইকমিশনারে যোগাযোগ করে, বর্ডার থেকে বৈধ ভাবে প্রবেশের তথ্য নিয়ে, আইনি প্রক্রিয়ায় ছাড়া পেতে এতদিন লেগে গেল।
কি বলো, এতকিছু হয়ে গেল?
হ্যাঁ, জীবনটা আচমকাই পাল্টে গেল? সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। তোমারও, আমারও।

নিতি দীপের কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, তুমি যে নাম্বার থেকে কথা বলছ, এটা তো ইন্ডিয়ান নাম্বার, দেশে আসবে কবে?
মা-বাবার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ওরা চলে গিয়ে নিয়ম অনুযায়ী একমাস থেকে নতুন করে ভিসা করে আবার এসেছে। আমি যেহেতু আজ ছাড়া পেলাম, জেলগেটের তথ্য নিয়ে, কাগজপত্র সাথে নিয়ে আগামীকাল দেশে ফিরব।
দেশে এসে কি ঢাকায় আসবে?
হ্যাঁ, আসব। তোমার বাবার খবর কি? তিনি এখন কেমন আছেন?
বাবা এখন ভালো আছেন। ক্রাচে ভর দিয়ে হাটতে পারেন। ভ্যানে স্কুলে যাচ্ছেন।
তুমি কোথায় আছে?
আমি দু’একদিন হলো ঢাকায় এসেছি। মন খারাপ ছিল। তোমার কথা শুনে আরো খারাপ হয়ে গেল।
চিন্তা করো না। আমি ঢাকায় ফিরে আসি। দেখবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
তাই যেন হয়।
নিতি, আমি ফোন রাখছি, দেশে ফিরে কথা হবে। ভালো থেকো। নিজের দিকে খেয়াল রেখো।
আচ্ছা, তুমিও ভালো খেকো। নিজের দেখে খেয়াল রেখো। দেশে ফিরে ফোন দিও।
দেব, রাখছি এখন।
রাখো।

দীপ ফোন রাখল। দীপ জেলে গেছে, দিদিকে নিয়ে এতসব ঘটনা, বাবার পঙ্গুত্ব, এত সবকিছুর পরও, সবকিছু ছাপিয়ে নিতির মনটা ভালো হয়ে গেল। দীপের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যপারটা বুকে পাথরের মতো চেপে বসেছিল। আজ সেই অনঢ় পাথরটা বুক থেকে নেমে গেল। নিজেকে হালকা লাগছে।

মহম্মদপুরে গৌরীশঙ্কর বাবু হঠাৎ চালু দোকান বন্ধ করে দিল। গ্রামের রাশেদুল মন্ডল মালামাল সহ চালু দোকানটা কিনে গৌরী বাবুর এতদিনকার গদিতে বসল। গৌরী বাবুর বড় জামাই চাকরি ছেড়ে সপরিবারে বেহালা চলে গেল। হঠাৎ এমন একটা ঘটনায় বাজারে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। গৌরী বাবুর বাড়ি কেনার জন্য অনেকে প্রতিবেশির বাড়িতে তদবির শুরু করেছে। ব্যপারটা বড় বিদঘুটে। নন্দ বাবু দোকানে বসে বন্ধু ননী গোপালের সাথে ব্যপারটা নিয়ে আলাপ করছে। ননি গোপল গৌরী বাবুর প্রতিবেশী।

কি রে ননী, গৌরীশঙ্করের ব্যপারে যা শুনছি তা কি সত্যি সত্যিই ঘটেছে?
আমার তো মনে হয় ঘটেছে। তা না হলে এমন চালু দোকান কেউ বন্ধ করে দেয়?
বাড়িঘর কি বেচে দেবে?
এটা ঠিক করে বলা মুশকিল! গভীর জলের মাছ! দেখি শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
শুনছি স্বামী-স্ত্রী মন্দিরে খুব যাচ্ছে?
হ্যাঁ, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে! আগে বিজয়া দশমীতে সবাই লুচি মিষ্ট দিয়ে আপ্যায়ন করতো। ওদের বাড়ি গেলে হালিম, ছোলার ঘুগনি, নুডুলস এসব! মন্দিরে তো বছরে একদিনও যেত না।
বড় বাড় বেড়েছিল। বুঝলি ননী, আমার ঠাকুরমা বলত `অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে ভেঙে যাবে।` দেখলি তো কেমন ভাঙল।
ভাঙতে তো হবেই নন্দ। হিন্দু হয়ে হিন্দু রীতিনীতি ভালো লাগত না। অহংকারে মাটিতে পা পড়ত না। এখন বোঝ, একেই বলে ভগবানের বিচার!
ছেলেটা করে কি?
শুনলাম একটা বি গ্রেডের ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ।

নন্দ বাবু ফিক করে হেসে বললেন, কি বললি, ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ, তাও আবার বি গ্রেডের? হা হা হা। মেয়ে সরকারি ভার্সিটির লেকচারার ছাড়া বিয়ে দেবে না, শেষে কিনা রিপ্রেজেন্টেটিভ? হা হা হা। নন্দ বাবু অট্টহাসি দিয়ে দোকান কাঁপিয়ে তুলল। ছেলেটার নাম কি? জানতে পারলি কিছু?

পাড়ার মানুষ তো বলছে তৌহিদুল ইসলাম। মানিকগঞ্জ বাড়ি, ওর ব্যাচমেট।
বেশ, মেয়ে ভালো জামাই জুটিয়েছে। এখন বরণ করে জামাইকে ঘরে তুলতে বল।
তোমার ইচ্ছা থাকলে তুমি বলো। আগের সমাজ থাকলে ব্যাটাকে একঘরে করতাম।
ব্যাটাকে মন্দিরে উঠতে দিচ্ছিস কেন? ঘাড় ধরে নামিয়ে দিতে পারছিস নে?
কে নামাবে এখন কি আর সে দিন আছে?

নন্দ বাবুর মনে আজ প্রচুর শান্তি। তার ছেলে ডাক্তার হবার পরেও ছেলের সাথে গৌরীশঙ্কর বাবু মেয়ে বিয়ে দিতে না চাওয়াতে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, তার যেন উপযুক্ত জবাব হয়েছে। দোকানে টাঙানো নারায়ণের ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, হরি, তুমি অন্তর্যামী। তুমি আজ মানির মান রাখলে। বলে চোখ বন্ধ করে হাত জোড় করে নারায়ণের ছবিতে ভালো করে একটা প্রণাম করল। চলবে