নিতির গল্প

উপন্যাস ৩০

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুন ০৫, ২০২০

দীপ ঢাকায় আসার পরদিন নিতির সাথে দেখা করতে এলো। দীপের চেহারা জেলখাটা আসামির মতোই বিধ্বস্ত। অনেকদিন রোগে ভুগলে মানুষের চোখ যেমন কোটরাগত হয়ে যায়, তেমনই চোখগুলো কোটরাগত। পরিচিত কেউ হঠাৎ করে দেখলে থমকে দাঁড়াবে, প্রশ্ন করবে, তুমি কি অসুস্থ দীপ? কোনোকিছু না ভেবে হঠাৎ একই প্রশ্ন নিতিও করে ফেলল। নিতির প্রশ্ন শুনে দীপ একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বলল, না, তেমন অসুস্থ না, তুমি তো সব জানো, এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি?

নিতি মনে মনে একটু লজ্জিত হলো। হ্যাঁ, সে তো সবকিছুই জেনেছে। এই পরিস্থিতিতে কোনো মানুষেরই স্বাস্থ্য ঠিক থাকতে পারে না। নিতির মুখের দিকে তাকিয়ে দীপও একই কথা বলল, তোমার স্বাস্থ্যটাও অনেক খারাপ হয়ে গেছে নিতি। তোমার উপরেও ধকলটা তো কম গেল না। ।

ওরা কথা বলছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, টিএসসির গাছে গাছে পাখিদের কলরব থেমে যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের চায়ের আড্ডায় হাসির তুবড়ি ফাটছে। দুটো মাল্টা চা নিয়ে এলো দীপ। চা খেতে খেতে অনেকদিন পর সিগারেট ধরাল। জেলে থাকার সময়টাতে সিগারেট ছিল না কাছে। কয়েকটা টান দিয়ে নিতির কাছে সিগারেটটা বাড়িয়ে দিল। নিতি সিগারেটটা নিয়ে দু`একটা টান দিয়ে ফেলে দিল। অনেকদিন পর সিগারেট তেমন একটা টানল না। একে অপরের পারিবারিক সঙ্কটের কথা বলতে বলতেই সময় পার হয়ে গেল। রাত নটার দিকে নিতি উঠে গেল। দীপ নিতির সাথে হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর গিয়ে নিতিকে বাসে তুলে দিয়ে হলে ফিরে এলো।

রাধাদের কলেজে আজ ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্রের চিহ্নিত চিত্র অঙ্কন এবং পর্যবেক্ষণের ব্যবহারিক ক্লাস। স্যার গতকাল ক্লাস শেষে সবাইকে কুনোব্যাঙ ধরে আনতে বলেছিল। রাধা রাহেলা খালাকে বললে খালা ওর জন্য একটা কুনোব্যাঙ ধরে এনে দেয়। একটা পলিথিনের প্যাকেটে কুনোব্যাঙটা নিয়ে রাধা কলেজে এসেছে। ক্লাসে আজ হাসির হল্লা বয়ে চলেছে। ছেলেরা ব্যাঙ ছেড়ে দিচ্ছে মেয়েদের দিকে, মেয়েরা কেউ কেউ লাফিয়ে, চিৎকার করে ক্লাস মাথায় তুলছে। কোনও কোনও মেয়ে আবার সেই ব্যাঙ ধরে ছেলেদের জামার পকেটে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ব্যাঙ বেচারির অস্বস্তির সীমা নেই। সে না পারছে এদের হাত থেকে পালাতে, না পারছে এদের নির্যাতন সহ্য করতে।

ছেলেমেয়েদের বালকসুলভ আচরণে যখন ক্লাস কম্পমান তখন স্যার ঢুকলেন। স্যার আসাতে শিক্ষার্থীরা শান্ত হয়ে বেঞ্চিতে বসল। স্যার হাসি হাসি মুখ নিয়ে, তোমাদের জন্য আজ একটা সারপ্রাইজ আছে। ছেলেমেয়েদের কৌতূহলি হয়ে সমস্বরে প্রশ্ন করে উঠল, কি সারপ্রাইজ স্যার? স্যার বললেন, আজ আমাদের কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, ডা. সুনন্দ আসছে তোমাদের ব্যবহারিক ক্লাস নিতে। আমি তো তোমাদের ক্লাস নিয়েই থাকি। আজ একজন ডাক্তারের কাছ থেকে শিখে নাও ডাক্তারি বিদ্যার প্রথম ধাপ।

ছাত্রছাত্রীরা খুব খুশি করতালি দিয়ে ক্লাস কাঁপিয়ে তুলল। ডা. সুনন্দ এ কলেজের গর্ব। স্যারেদের মুখে তার কথা আগেও শুনেছে ওরা, আজ চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা হবে। কথা বলতে বলতেই ডা. সুনন্দ এসে হাজির। সকলে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান প্রদর্শন করল। স্যার সসম্মানে তার পাশের একটা চেয়ারে বসতে দিলেন তাকে। নিজেদের মধ্যে দু`একটা কথা বলে, শিক্ষার্থীদের নাম শোনার পর, ক্লাস শুরু হলো। ব্যবহারিক পরীক্ষা করার টেবিলে সবাই যার যার আনা ব্যাঙ রাখল। সামনের একটা টেবিলে স্যারের সাথে ডা. সুনন্দ দাঁড়িয়েছে। পেছনের টেবিলগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা জায়গা নিয়েছে।

ডা. সুনন্দ ব্যাঙগুলো পলিথিন থেকে বের করে কাচের জারে রাখতে বললে শিক্ষার্থীরা তাই করল। সে একটা তুলার টুকরো ক্লোরোফর্মে ভিজিয়ে মুখবন্ধ জারের মধ্যে থাকা ব্যাঙটিকে অজ্ঞান করে নিল। রাধারা সেটা দেখে একইভাবে নিজেদের ব্যাঙগুলোকে অজ্ঞান করে নিল। এবার একটা ব্যবহারিক ট্রেতে ডা. সুনন্দের দেখাদেখি ওরা অজ্ঞান হওয়া ব্যাঙটাকে রাখল। ব্যাঙটা ট্রেরের উপর চিৎ করে রেখে সামনের ও পেছনের পায়ের তালুর মধ্যদিয়ে আনপিন গেঁথে ট্রের মোমের সাথে আটকে দিল। ট্রেতে পরিষ্কার পানি ঢেলে দিল এমনভাবে, যেন ট্রের মধ্য থাকা ব্যাঙটি সম্পূর্ণভাবে ডুবে যায়। এরপর ওরা দেখাদেখি চিমটির সাহায্যে নিচের চামড়া টেনে, মধ্যরেখা বরাবর কাঁচি দিয়ে কেটে, ব্যাঙটার চামড়া আলাদা করে ফেলল।

ধীরে ধীরে ব্যবহারিক ক্লাস এগিয়ে চলল। অন্যরা ব্যবহারিক ক্লাসের নিয়মানুযায়ী ব্যাঙের বৃক্ক, হৃদপিণ্ড ইত্যাদি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে কেটে আলাদা করলেও রাধা সেটা করল না। সে ব্যাঙের চামড়া সাবধানতার সাথে কেটে ওভাবেই রেখে দিল। ডা. সুনন্দ ব্যপারটা দেখে কৌতূহল বশত রাধার কাছে এগিয়ে এলো, তুমি ব্যাঙটা পুরোপুরি কাটছ না কেন?
আমি ব্যাঙটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
কেন?
মেরেও তো কোনও লাভ নেই?
তা নেই, কিন্তু এটাও তো প্র্যাকটিক্যালের একটা অংশ?
তা ঠিক? তাই বলে এতগুলো ব্যাঙকে মারতে হবে? একটা কেটে দেখলেই তো হয়।
তোমার কি ধারণা এই ব্যাঙটা বাঁচবে?
চেষ্টা করে দেখলে দোষ কি?
কি করবে এটার?
সেলাই করে ছেড়ে দেব। যদি বাঁচে?
ঠিক আছে সেলাই করো, আমি দেখি তুমি কেমন সেলাই করতে পারো।

রাধা ব্যাঙটির কাটা পেট সেলাই করে, পায়ের পিন তুলে যত্নকরে ট্রের উপর রাখল। কিছুক্ষণ পর ব্যাঙের জ্ঞান ফিরে এলো। রাধা ব্যাঙটা মাটিতে নামিয়ে রাখলে, সেটা লাফাতে লাফাতে বাইরে চলে গেল। এ দৃশ্য দেখে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা হাততালি দিয়ে উঠল। ডা. সুনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তোমার নামটা যেন কি বলেছিলে? রাধা তার নাম বলল, বাড়ি জানতে চাইলে বাড়ির ঠিকানা দিল। তারপর ডা. সুনন্দ বলল, তুমি কি আগে থেকে আমাকে চিনতে?
হ্যাঁ।
কীভাবে?
আমার মা আপনাদের বাড়িতে কাজ করে। কথাগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল রাধা। কোনও জড়তা নেই। লজ্জা নেই। ব্যপারটা ভালো লাগল ডা. সুনন্দের। রাধার প্রতি একটা স্নেহের আবরণ তৈরি হলো। চলে যাবার সময় রাধাকে ডেকে বলল, প্রতি শুক্রবারে আমি বাড়ি থাকি, লেখাপড়ার ব্যাপারে তোমার কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে তোমার মায়ের সাথে আমাদের বাড়িতে এসো। সঙ্কোচ করো না।

রাধা ঘাড় নাড়িয়ে মুখ খুলে শান্ত স্বরে বলল, হ্যাঁ, কিছু বুঝতে না পারলে আসব।
এর মাঝে এক মাস কেটে গেছে। রিমি ওর মেসে বসে জীবনানন্দের কবিতা পড়ছে। হঠাৎ একটা ফোন এলো। রিসিভ করতেই আদনানের কণ্ঠ, কেমন আছো রিমি? চলবে