
নিতির গল্প
উপন্যাস ৩৪
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুন ১০, ২০২০
এটা হয়তো কেউই প্রত্যাশা করেনি। অথচ অপ্রত্যাশিত দেখাটা হয়েই গেল। দীপের সাথে নিতির এই দেখা হওয়াতে ভালো হলো না মন্দ হলো, সেটা কে বলতে পারে? সময়ই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। হয়তো ভালো হয়েছে, হয়তো হয়নি। ফলাফল যাই হোক, দেখা হওয়াটা তো কারো হাতে ছিল না, অথচ দেখা হলো।
জীবনটা এমনই। আমরা না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে যাই, আবার যা প্রত্যশা করি, অনেক সময় সেটা আমাদের থেকে দূরে পালিয়ে যাই। কোনও সমীকরণ দ্বারা জীবনকে বাঁধা যায় না। বই কিনতে এসেছিল, অথচ সেই বইটিই কেনা হলো না। দুজনের একই প্রশ্নে, দুজনেরই খেই হারিয়ে গেল। উত্তর দিতে পারল না।
হঠাৎ আসা কথার সংকট কাটিয়ে উঠতে নিতি বলে উঠল, চলো একটা কফি শপে গিয়ে বসি। সেখানেই কথা বলি।
দীপ না করল না। বলল, চলো।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বই কেনার পরিবর্তে দুজন একটা কফি শপে ঢুকল। কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে দীপ আগের প্রশ্নটা আবার করল, কি বই কিনতে এসেছিলে?
প্রাইমারি সহকারী শিক্ষক নিয়োগ গাইড।
মানে? তুমি এখনই চাকরি করবে?
আগে তো পাই?
পেলে করবে?
করবো বলেই তো আবেদন করেছি। তুমি কি বই কিনতে এসেছিলে?
ইংলিশ স্পিকিং, আইইএলটিএস, এসব বিষয়ের কিছু বই।
ওহ্, বেশ।
তুমি প্রাইমারিতে আবেদন করলে, আমাকে কিছু বললে না তো কিছু?
তুমিও তো কিছু বললে না। আইইএলটিএস করছো।
বলতাম।
আমিও বলতাম।
একই কথা হয়ে যাচ্ছে।
তাহলে বাদ দাও, তার থেকে বলো, কোন দেশে ট্রাই করবে?
কানাডা।
শেষ পর্যন্ত কানাডা চলে যাবে? নিতির কণ্ঠে অভিমানের সুর
আগে তো ভিসা পায়?
তুমি দেশের বাইরে যেতে চাচ্ছ কেন?
যে করণে সবাই যায়।
মানুষ তো অনেক কারণেই যায়, তুমি কি কারণে যাচ্ছ?
দেখ, যেতে চাচ্ছি, যেতে পারব কিনা তা তো জানি না।
তবুও তো যেতে চাচ্ছ?
হ্যাঁ, কিন্তু তুমি প্রাইমারিতে আবেদন করেছ কেন?
এ বিদ্যায় এর থেকে বেশি আর কি পাব?
চাকরিটা কি খুব দরকার ছিল?
তুমি তো সবই জান। বাবার অই অবস্থা। আমি কিছু করতে পারলে বাবার উপর চাপ কমবে।
চাকরি করলে তো তোমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে?
হয়তো হবে। এছাড়া কি উপায় আছে?
দীপ, নিতি দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। নীরবতা ভেঙে নিতি প্রশ্ন করে উঠল, তোমার দিদির খবর কি? তিনি কেমন আছে?
আছে এক রকম। তাড়াহুড়া করে বিয়ে দিয়ে দিল! দীপের কণ্ঠ গম্ভীর। কথাগুলো বলতে গিয়ে চোখ উদাস হয়ে এলো। মুখে বেদনার ছায়া। নিতি সেটা লক্ষ্য করে প্রশ্ন করে উঠল, কোনও সমস্যা আছে কি?
শুনেছি ছেলেটি ড্রিঙ্ক করে।
কি বলো? নিতির কণ্ঠে বিস্ময়!
হ্যাঁ, ওদেশে তো বেশিরভাগ ছেলেদের এ অভ্যাস আছে। তবে দিদির বর শুনছি মাঝেমধ্যে আউট অব কন্ট্রোল হয়ে যায়।
কী বলো, এ তো সাংঘাতিক খবর, কেবলই বিয়ে হলো? কথাটা শুনে নিতির শরীর শক্ত হয়ে এলো।
হ্যাঁ, সাংঘাতিক ব্যাপারই তো। দিদিটাও এমন একটা কাজ করে বসল?
তোমার বাবা-মা দেশে এসেছে?
না, ওরা ওদেশে রেশন কার্ড, আধার কার্ড, আই কার্ড, এসব করছে?
কি বলো, ওদেশে চলে যাবে নাকি?
জানি না। করছে তো। আমাকেও করতে চাপ দিচ্ছে। আমার ওদেশে যাবার কোনও ইচ্ছে নেই। শেষ পর্যন্ত যদি বাবা-মা ওদেশে চলে যায়, আমি কানাডা চলে যাব।
সেজন্যই ব্রিটিশ কাউন্সিলে ভর্তি হলে?
হয়তো হ্যাঁ, কানাডিয়ান কাউন্সিল তো নেই? তাই আপাতত ব্রিটিশ ল্যাংগুয়েজটাই শিখি। কিছু কাজে লাগবে।
শেখো। সময়ই বলে দেবে কতটা ঠিক করছি আমরা, কতটা বেঠিক করছি।
হ্যাঁ, সময়ের উপরই সব নির্ভর করছে। দেখি সময় কোথায় নিয়ে যায়।
রাত হয়ে যাচ্ছিল। কথা বেশি দূর আর এগোল না। দুজন যেমন দু`দিক থেকে এসেছিল, তেমনি আবার দু`দিকে চলে গেল। বুকের ভেতর একটা শূন্যতা নিয়ে।
সমুদ্র স্নান করার অভ্যাস কারো ছিল না। ঢেউয়ের প্রথম ধাক্কাতেই সবার অবস্থা কাহিল। কেউ নোনা জল গিলে ফেলল। কেউ ঢেউয়ের আঘাতে ছিটকে পড়ল। রিমির চোখে মুখে জল-বালি ঢুকে একাকার অবস্থা। কানে জল ঢুকে কিছুক্ষণ কান বন্ধ হয়ে থাকল। কানে একটা বিশ্রি শা শা শব্দ শুনতে থাকল। মাথার দপদপানি মাত্রা ছাড়াল।
এতকিছুর পরেও তপু তুলি ওয়াটার বাইকে উঠে কয়েকটা চক্কোর দিয়ে এলো। ভাড়াটে ফটোগ্রাফার দিয়ে কয়েকশো ছবি তোলা হলো। শোভা একটা টিউবের উপর উঠে শুয়ে থাকল, রিমি টিউবটা ধরে ঢেউয়ের তালে তালে মৃদু দুলুনির রোমাঞ্চ টের পেল। প্রায় দু`ঘণ্টা ধরে সমুদ্র স্নান করে যখন ওরা উঠে আসল, ওদের কাউকেই চেনা যাচ্ছে না। চুলে একগাদা বালি, পোষাকে বালি, স্যান্ডেল যেন বালির বস্তুা। হোটেলের আউটারে পা ধুয়ে রুমে চলে এল। বাথরুমে স্নান করতে আরো এক দেড় ঘণ্টা চলে গেল।
দুপুরে খাবার সময় সবাই এক জায়গায় একত্রিত হলো। পাশে একটা দেশীয় খাবারের নামকরা রেস্টুরেন্টে আছে। সেটার উদ্দেশে রওনা দিল।
ড. সুনন্দের বাড়ি আসাটা রাধার একপ্রকার রুটিন ওয়ার্ক হয়ে দাঁড়াল। এ ব্যপারে কোনও সন্দেহ নেই, ডা. সুনন্দের চাওয়াতেই এটা হচ্ছে। তবুও, রাধা চঞ্চলতা অনুভব করছে, মনের মধ্যে একধরনের সুখের অবেশ তৈরি হচ্ছে। রাধার জীবনের লক্ষ্য বদলে যাচ্ছে। জীবনকে নতুনভাবে দেখার, নতুনভাবে চেনার, এ এক মস্ত লোভ। রাধা মুখে সেটা বলতে পারছে না, মনে মনে অনুভব করছে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বাইরে একটা অন্য হৃদয় তৈরি হচ্ছে। সেই হৃদয়ের বসন্ত বাতাসে লাল-নীল ঘুড়ি উড়ছে। যার লাটাই ডা. সুনন্দের হাতে, রাধা শুধু সুতোর টানে উড়তে পারে। চলবে