
নিতির গল্প
উপন্যাস ৩৫
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুন ১১, ২০২০
কক্সবাজারে আসবে অথচ বার্মিজ মার্কেটে যাবে না, এটা কি হয়? হয় না। রিমিদের ক্ষেত্রেও হোটেলে বসে থাকা সম্ভব হলো না। পড়ন্ত দুপুরে রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে ওরা বার্মিজ মার্কেটের দিকে রওনা দিলো। দুটো রিকশায় চারজন। আদনান গেল এয়ারপোর্টে। প্রযোজক আসবে। তাকে রিসিভ করতে হবে। বার্মিজ মার্কেটে এসে রিমির একটু অন্যরকম অনুভূতি হলো। ওদের বাড়ি যশোর। সেখানে মহিলারা দোকানদারি করে না। অথচ বার্মিজ মার্কেটে দোকানদারদের অনেকে মহিলা। স্বাচ্ছন্দ্যে বেচাকেনা করছে। বেশিরভাগই রাখাইন তরুণী। তরুণীদের এই সাহসী দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর।
রিমিরা কিছু আচার, কিছু বার্মিজ চকলেট, কয়েকটা হাতব্যাগ আর কিছু টুকটাক জিনিস দু`একটা করে কিনল। সমুদ্র স্নানের উপযোগী এক জোড়া করে স্যান্ডেল কিনল সবাই। বেশি সময় থাকা হলো না এখানে। সূর্যাস্ত দেখতে হবে! তাড়াহুড়া করে হোটেলে ফিরল ওরা। সী গাল হোটেলটা সমুদ্রের ধারে। ঝাউবনের সামনে। পরিবেশটা চমৎকার। হোটেল থেকে সমুদ্র দেখা যায়। সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়। হোটেল থেকে বের হলে রাস্তা। রাস্তা পার হলে ঝাউবন। ঝাউবনের ভেতর থেকেই সৈকতের মোটা বালিতে স্যান্ডেল আটকে যায়। বালি ঠেলে এগিয়ে গেলেই সমুদ্রের নোনা জলে পা ভিজবে। কী অপূর্ব রোমাঞ্চ! কী অপূর্ব অনুভূতি!
ওরা হোটেলে পৌঁছে একটুও সময় পেল না। বার্মিজ মার্কেট থেকে কেনা জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখার সময়টুকুও না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য ডুবে যাবে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে না পড়লে সূর্যাস্ত দেখা যাবে না। আজ আকাশ মেঘমুক্ত। এই অপার্থিব দৃশ্য চোখে না দেখলে কক্সবাজার আসাটাই যে বৃথা হয়ে যায়। হোটেল থেকে এক প্রকার দৌড়াতে দৌড়াতে বিচে এলো। বিচে আদনান দাঁড়িয়ে আছে। অস্তমিত সূর্যের দিকে চোখ। আদনানের পাশে এক অচেনা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। ওরা আদনানের কাছে এগিয়ে যেতেই, আদনান এক পলক ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই রিমিদের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই, (ভদ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে ইঙ্গিত করে) মিস্টার সাজেদুল ইসলাম শুভ। আমাদের প্রযোজক। আমরা শুভ ভাই বলে ডাকি। তোমারাও শুভ ভাই বলতে পার।
এরপর শুভ ভাইয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, (ওদের দিকে ইঙ্গিত করে) ভাই, এ শোভা, আমাদের পুরান অ্যাক্ট্রেস। ও তপু, পাশের জন তুলি।
শুভ ভাই ওদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে রিমির দিকে তাকাতেই, আদনান বলে উঠল, ভাই, এ রিমি, আমাদের নতুন অ্যাক্ট্রেস। এর কথা ফোনে আপনাকে বলেছিলাম।
শুভ ভাই আচমকা রিমির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। রিমি প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। করলে মানুষটিকে অপমান করা হয়। সঙ্কোচে বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত রাখল রিমি। শুভ ভাই কোমল ভাবে রিমির হাতটা ধরে বলে উঠল, নাইচ টু মিট ইউ।
রিমি মিষ্টি করে হেসে প্রতিউত্তর করল, সেম টু ইউ।
ফরমাল আলাপ শেষ হলো। কথাবার্তায় আর জড়তা থাকল না। শুভ ভাই রিমির ডান হাতটা ধরে আছে। খুব স্বাভাবিক ভাবে রিমিকে বলল, চলো, বিচে একটু হেটে আসি।
শুভ ভাই বেশ আন্তরিক। আমন্ত্রণ রিফিউজ করা যায় না। রিমি বলল, চলুন।
হ্যান্ডশেকের সময় স্বাভাবিক ভাবেই ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। এখন হাত বদল হলো। শুভ বাম হাত দিয়ে রিমির ডান হাত ধরল। দুজন একে অপরের হাত ধরে হেঁটে চলল। চেনা মানুষের মতো সাচ্ছন্দ্যে।
প্রথম আলাপ, অথচ কত সাবলীল। ওরা কিছুদূর হাঁটল লাবনী বিচের দিকে। লাবনী বিচ থেকে ইউটার্ণ নিয়ে এল সুগন্ধা বিচের কাছে। ফাঁকা কাপল কিটকট চেয়ার পেয়ে বসে পড়ল। দুজন একে অপরের বাহু সংলগ্ন হয়ে । এরই মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সমুদ্রের বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে গায়ে। শুভর চল্লিশের কাছাকাছি বয়স, হ্যান্ডসাম চেহারা, শিল্পপতি। পাশে এমন একজন মানুষ বসে আছে, যার কাছে রিমি কিছুই না। তবুও ভয় করছে না, একটুও খারাপ লাগছে না রিমির। শুভ রিমির আঙুলগুলো নিয়ে খেলছে।
বহুদিন কোনও পুরুষের আন্তরিক স্পর্শ পায়নি রিমি। শুভর স্পর্শে সুমনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বিয়ের পরপর সুমন এমন ভাবেই হাত ধরে থাকত। আদর করত। দীর্ঘক্ষণ ধরে লিপ কিসে ডুবে থাকত। আঙুলগুলো নিয়ে খেলত। সেই সুমন অতটা খারাপ হয়ে যাবে! রাগে ঘৃণায় রিমির শরীর শক্ত হয়ে এলো। শুভ রিমির হঠাৎ পরিবর্তনের বিষয়টি লক্ষ্য করল। অঙুলগুলো ছেড়ে দিল। আরেকটু কাছাকাছি সরে এসে বলল, কোনও সমস্যা হচ্ছে তোমার? উঠে যেতে চাও?
রিমির সুমনের কথা মনে পড়েছিল। তাই হয়তো মুখের এক্সপ্রেশনটা অমন হয়েছে। এটা এখানে বলা যায় না। বলতে চায়ও না। বরং সুমনকে ভুলতে চায় সে। যেকোনো মূল্যে। সজোরে ঘাড় নাড়িয়ে বলে উঠল, না না। আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে না। আমি বেশ আছি।
নীলক্ষেত থেকে ফিরে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠল নিতি। ওর কেবলি মনে হতে থাকল, দীপ কানাডা চলে যেতে চাচ্ছে, অথচ তাকে কিছুই বলল না? দীপের উপর একটা চাপা অভিমানে তার সমস্ত হৃদয় শূন্য হয়ে এলো। অপরদিকে নিতির প্রাইমারি স্কুলের আবেদনটা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না দীপ। দীপের কেন জানি মনে হচ্ছে, নিতি ঢাকা থেকে পালাতে চাচ্ছে। ওর কাছ থেকে সরে যেতেই প্রাইমারির আবেদনটা করেছে নিতি। দুজনেই দুজনকে ভুল বুঝল। অবিশ্বাসের একটা মস্ত দেয়াল উঠে বসল আচমকা। মনের অজান্তেই সে দেয়াল আসন গেড়ে বসল দুটি নরম হৃদয়ে।
কোনও এক ওষুধ কোম্পানি ডা. সুনন্দকে একটা স্মার্টফোন গিফট করেছে। ওর একটা ফোন আছে। এটা দিয়ে কী করবে? হঠাৎ ভাবনাটা মাথায় এলো। গিফট পেপার কিনে নিয়ে এলো। সুন্দর করে ফোনের বক্সটা মোড়ক করল। রাধার কোনও মোবাইল ফোন ছিল না। রাধাকে ডেকে গিফট বক্সটা ধরিয়ে দিল হাতে। রাধার মুখে স্পষ্ট লজ্জা। কিছু বলতে পারল না। গিফটটা খুলতেও পারল না সামনে। সামনে কি খোলা যায়? হয়তো যায়, হয়তো যায় না। রাধা সোজা বাড়ি চলে এলো। বাড়ি এসে মোড়কটা খুলে অবাক। এত সুন্দর একটা ফোন! ওকে গিফট করেছে?
আজ রাধার জন্মদিন। রাধার বারবার মনে হচ্ছে, সে কী তাহলে জন্মদিনের কথাটা জানে? জানবে কেমন করে? মা কী কিছু বলেছে? রাধা হিসাব মেলাতে পারছে না। ফোনটা অন করল। কী আশ্চর্য! সিমকার্ড দিয়ে দিয়েছে! নিশ্চয় এটা তারই সিমকার্ড। রাধা কিছুই ভাবতে পারছে না। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা রিসিভ করতেই সুনন্দের গলা, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
রাধা বিস্মিত! তাহলে এটা জন্মদিনের গিফট। রাধা লজ্জায়, বিস্ময়ে বাক হারাল। একটা ঢোক গিলে, নিচু স্বরে, শুধু একটি কথা বলতে পারল, থ্যাংক্স। চলবে